ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

ছাত্র আন্দোলন নাকি সন্ত্রাস উৎপাদন?

২০২২ জুন ১৫ ১৪:০০:০১
ছাত্র আন্দোলন নাকি সন্ত্রাস উৎপাদন?

রণেশ মৈত্র


বেশ কিছুদিন যাবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একবারে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এককালের গৌরব পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ মুক্তিযুদ্ধে এবং ভাষা আন্দোলনসহ অতীতের তাবৎ আন্দোলনে ইতিহাসখ্যাত ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আজ আর সেই ভূমিকা নেই। এটিই হলো বেদনাদায়ক সত্য। আরও মারাত্মক সত্য হলো- এই সংগঠন বিগত কয়েকটি বছর যাবত সারা দেশের শিক্ষাঙ্গন কে যে ভাবে পেশিশক্তির মাধ্যমে দখল করে রেখে সুস্থধারার ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষার আধুনিকীকরণ আন্দোলন, দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের ও প্রগতির ধারায় ফিরিয়ে আনার আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে- তার পরিণতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে শুভ হবে না- দেশের জন্য তো নয়ই। দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃত্ব ও ছাত্র লীগের বর্তমান সন্ত্রাসী এবং দখলদারিত্বের ভূমিকাকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্মথন দিয়ে চলেছে তারা সম্ভবতঃ ভাবছেন, তাঁদের মদদে ছাত্রলীগের চলমান ভূমিকা শিক্ষাঙ্গনসহ দেশের সকল ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিরোধী শক্তিগুলিকে দূর্বল করে দেবে এবং তার ফলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পথ সুগম হবে। এখন আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিদ্যমান সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু পেছন ফিরে দেখা যাক- সম্প্রতি হঠাৎ করেই ছাত্রলীগ- এমন সন্ত্রাসী ভূমিকায় লিপ্ত হলো হলো কেন?

এ সম্পর্কে কম বেশী আমাদের গণমাধ্যমসমূহ বিগত কয়েকদিন যাবতই উল্লেখ করে চলেছে যে, সদ্য সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা দলটির জাতীয় সম্মেলন ত্বরাশ্চিত এবং সফল করাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার আগেই আওয়ামী লীগের তাবৎ অঙ্গ ও সহযোগি সঙগঠনগুলিকে তাদের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। পদ হারানোর ভয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে কোনো কৌশলে তাদের জাতীয় সম্মেলন পিছিয়ে দেওয়ার বা স্থগিত ঘোষণার পরিস্থিতি কৃত্রিমভাবে তৈরী করতেই এমন সন্ত্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে। পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত এমন খবরের কোনো প্রতিবাদ জানায় নি ছাত্রলীগ নেতারা- তাই ওই খবর সত্য বলেই প্রতীয়মান হয়।

ছাত্রলীগ আরও একটি সুযোগ পেয়ে যায় বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি উক্তিকে বি এন পি নেতৃত্ব “সত্যস্ত অবমাননাকর” বলে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রীকে ওই উক্তি প্রত্যাহার করার দাবীতে আন্দোলন এবং একই সাথে নির্বাচনের আগে এই সরকারের পদত্যাগের দাবীতে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঢাকাসহ নানা স্থানে যে সভা-সমাবেশ ঘোষণা করেছে- তার সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ওই দুটি দাবীতে আন্দোলনের ও সমাবেশের আয়োজন করায় ছাত্রলীগ নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সুনজরে আসার লক্ষ্যে ছাত্রলীগের মিছিল- সমাবেশের উপর হামলা চালায়। ছাত্রদল ও সুযোগ পেয়ে তাদের শক্তি এবং কোমরের জোর প্রদর্শনের জন্য ছাত্রলীগের মিছিলের উপর পাল্টা আঘাত ক্যাম্পাস পরিস্থিতি ভয়াবহভাবে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ছাত্রদলের এই ভূমিকাকে নানা উক্তির মাধ্যমে বি এন পির মূল নেতারা আরও বেশী উসকে দিতে এ কথা পর্যন্ত বলেছেন যে, বেশী দিন লাগবে না- ছাত্রদলই এই সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হবে।

আওয়ামী লীগ ও বি এন পি উভয়েই বড় দল বলে পরিচিত। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী ঐতিহ্য বহুদিনের। মওলানা ভাষানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, শহিদ তাজউদ্দিন আহমেদ এর মত অসংখ্য দিকপাল তো দীর্ঘকাল দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন, জনগণের স্বার্থে-অসংখ্য আন্দোলন পরিচালনা করেছেন,মুসলিম লীগ ও সামরিক শাসকদের বিস্তর অত্যাচার- নির্যাতন ও কারাজীবন হাসিমুখে দেশের স্বার্থে ভোগ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ঐ সকল আন্দোলনের ছিল প্রাণশক্তি। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কখনও মিলিত ভাবে-কখনও পৃথকভাবে ছাত্র ও জনতার স্বার্থে দেশে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারই ফসল হলো, আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ । সেদিনকার সেই আন্দোলনগুলিতে ছাত্রবস্থায় তো আমি নিজে ও আরও অনেকের সাথে অংশগ্রহণ করেছি সেই আন্দোলন সংগ্রামই দেশকে বহু জননেতা উপহার দিয়েছে- যাঁরা দেশ পরিচালনা করেছেন অসীম যোগ্যতার সাথে।

তার যবনিকাপাত ঘটলো ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত করার পর থেকে যে প্রগতিমুখীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ, সেই দেশটি কি পিছনে হাঁটতে, পাকিস্তান অভিমুখী করে তুলতে, প্রগতির সকল ধারা অবলীলত্রাসে মুছে ফেলার সকল প্রস্তুতি তারা আগে থেকেই নিয়েছিল। সে ধারার আজও অবসান ঘটে নি বরং প্রতিক্রিয়ার সেই ধারা- জিয়া এরশাদ প্রবর্তিত অন্ধ কারের ধারা দিনে দিনে ফুলে ফলে বিকশিত হচ্ছে আজও।

ছাত্র আন্দোলন সেদিন সন্ত্রাস বিরোধী ভূমিকায় ছিল। ষাটের দশকে সামরিক সরকার এন. এস. এফ নামে যে সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠনের জন্ম দিয়েছিল ছাত্র নেতাদেরকে সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত করে ছাত্র আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে, সেই সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাদেরকে ছাত্রলীগ- ছাত্র ইউনিয়ন এবং শিক্ষকবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার হলগুলি থেকে তাড়িয়ে শিক্ষাঙ্গণ কে সন্ত্রাসমুক্ত করেছিল। সে ইতিহাস গৌরবের এবং গর্বের।

সেদিনকার ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ ও এককভাবে আন্দোরন করেছে সকল স্তরের শিক্ষাদান বাংলাভাষায় করার জন্যে, জাতীয় জীবনের সকল স্তরে বাঙলার প্রচলনের জন্যে, একমুকী ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলনের জন্যে। কিন্তু আজ দেখা যায় ভাষা আন্দোলন তো বহুদিন আগের কথা, মুক্তিযুদ্ধের পরেও দীর্ঘ ৫০ বছর অতিক্রান্ত হলেও শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা ফেরানো হয়েছে, পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল প্রমুখ অসাম্প্রদায়িক ও খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিকদের লেখা কবিতা,গল্প প্রবন্ধ বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখকদের রচনা সম্বলিত পাঠ্যপুস্তকের প্রচলন করতে, এককেন্দ্রিকের পরিবর্তে ত্রি-কেন্দ্রীক শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ বাংলা মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমে কিন্ডারগার্টেন এবং আরবী মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ঘটিয়ে সেদিনকার দাবীকে ভূলুণ্ঠিত করে প্রতিক্রিয়ার শক্তিবৃদ্ধি করতে।

ধনীর ছেলেমেয়েরা ইংরেজী মাধ্যমে মধ্য ও নিম্নবিত্তরা বাংলা মাধ্যমের মূলধারার স্কুল কলেজে এবং দরিদ্র ঘরের সন্তানেরা আরবীর মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণের প্রতিক্রিয়ামরি ব্যবহার প্রচলন করতে- শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যপক বৈষম্যের সৃষ্টি করতে যার পরিমাণে ধনীর সন্তানেরা দামী দামী চাকুরী ও বিদেশে নানা ক্ষেত্রে স্থান পাচ্ছে, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাশেষে একটি চাকুর ও জন্যে হন্যে হযে ঘুরে বেড়াচ্ছে- মাদ্রাসায় আরবীর মাধ্যমে শিক্ষা নিয়ে সেই শিক্ষার্থীরা বেকারত্বে ভুগছে- বড় জোর মাদ্রাসা-মক্তব- মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, মসজিদের ইমাম প্রভৃতি নিম্ন বেতনের কাজে নিযুক্ত হয়ে কষ্টের জীবন অতিবাহিত করছে। কিন্তু এই বৈষ্যম্য দূর হতে পারে একমাত্র এক- কেন্দ্রিক শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে। অথচ তা আজ পরিত্যক্ত।

এত লাভবান হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলি। জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, প্রমুখ দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে শুধু তাই নয়- তারা দুটি বড় দলে অনুপ্রবেশ করে সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। এতে রাজনৈতিক শক্তি সমূহের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে।

একদিকে দুটি বড় দলে ভয়াবহ কোন্দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের মারাত্মক সন্ত্রাস- অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বি ঊর্ধগতি দেশকে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এখন তো ছাত্র সংগঠনগুলির সামনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের ইস্যু হলো দ্রব্যমূল্য কমানোর- তার ঊর্ধগতি প্রতিরোধের দাবীতে আন্দোলন । কিন্তু ছাত্র সংগঠন দুটি তো সে অবস্থান নিয়ে আত্মকলহে ভয়াবহভাবে নিমগ্ন।

সাধারন ছাত্র সমাজ এই পরিস্থিতি কখনোই কামনা করে না। তারা চায় ক্যাম্পাসে শান্তি বিরাজ করুক- সন্ত্রাস বন্ধ হোক- শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসুক। তারা তেমন শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি তো দেখছেই না- উল্টো দেখছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্র দলের সন্ত্রাসীরা সুপ্রিম কোর্ট - প্রাঙ্গন পর্যন্ত বিস্তার ক্ষতি করেছে। আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, বিচারপতিদের নিরাপত্তা পর্যন্ত বিঘ্নিত হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল দুটি এই পরিস্থিতি থামানোর উদ্যোগ না নিয়ে পরস্পর দোষারোপের চিরন্তন পথে বাজার গরম করে চলেছে- রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত ও কলুষিত হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবেই ক্ষতি হচ্ছে দেশের, জনগণের, রাজনীতির এবং গণতন্ত্রেরও।

কারণ এহেন পরিস্থিতিতে জনগণ হয়ে পড়েন দল-বিমুখ এবং সামগ্রিকভাবেই রাজনীতি বিমুখ। তা হয়ে পড়ছেন ও। আর এই পরিস্থিতিত্ব সুযোগ নিতে পারে অরাজনৈতিক অন্ধকারের শক্তিগুলি।

আমাদের ছাত্র- সমাজকেও ভাবতে বলি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক প্রতিরোধ গড়ে তুলে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে- মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কে চিরঞ্জীব করে রাখতে ।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।