ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

ডেঙ্গু রূপ নিচ্ছে মহামারির: আতঙ্ক নয় চাই জনসচেতনতা 

২০২৩ সেপ্টেম্বর ১৯ ১৫:৫৮:২১
ডেঙ্গু রূপ নিচ্ছে মহামারির: আতঙ্ক নয় চাই জনসচেতনতা 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


মহামারি মতো আকার ধারণ করতে চলেছে ডেঙ্গু। এডিস মশাবাহিত এ রোগটি প্রতিদিন কাড়ছে প্রাণ।ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩। ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮২২ জনে। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিন হাজার ১২২ জন।চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ৬৭ হাজার ৬৮৪ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৩ হাজার ২৩৩ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৯৪ হাজার ৪৫১ জন ভর্তি হয়েছেন।এ বছর এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮২২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৬৪ জন এবং ঢাকার বাইরের ২৫৮ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১০ হাজার ৪৩৭ জন ডেঙ্গুরোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৪ হাজার ৬৬ জন এবং ঢাকার বাইরে রয়েছেন ৬ হাজার ৩৭১ জন।

বছরের একই সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন এক লাখ ৫৬ হাজার ৪২৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬৮ হাজার ৬০৩ জন এবং ঢাকার বাইরের ৮৭ হাজার ৮২২ জন।

২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন।

২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি পুনরাবির্ভূত রোগ হিসেবে গণ্য। সাম্প্রতিক (২০০০) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক এদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বিস্ফোরক পর্যায়ে আছে। বিশ্বজুড়েই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ আর চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছাতে পারে রেকর্ড সর্বোচ্চ। এর অন্যতম কারণ হতে পারে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তন।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। মূলত বিশ্বজুড়েই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ২০০০ সালের পর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে ২০২২ সালে দাঁড়ায় ৪২ লাখে।ইউরোপে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। পেরুর অধিকাংশ অঞ্চলে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা।এদিকে বেশ কিছু অঞ্চল ও দেশে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড।যুক্তরাষ্ট্রে এফডিএ মাত্র একটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। তবে তা সব বয়সীদের জন্য নয়।

২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরকে দশম স্বাস্থ্য ঝুঁকির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ডেঙ্গুর ঝুঁকি যে অঞ্চলে বেশি সেখানে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষের বসবাস। প্রতি বছর বিশ্বের ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এই মুহূর্তে ডেঙ্গু মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে পেরু। এর আগে দেশটি কখনো এত ডেঙ্গু রোগীর সম্মুখীন হয়নি।

পেরুর কায়েটানো হেরেডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক ড. কোরালিথ গার্সিয়া বলেন, ডেঙ্গু রোগী এখন শহর এলাকায় বেশি দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। বিশেষজ্ঞরা উষ্ণ তাপমাত্রা ও ভারী বৃষ্টিপাতকে দায়ী করেছেন। কিন্তু লিমা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মরুভূমি শহর হওয়ার পরেও ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে বিস্তার হচ্ছে। কারণ শহরটির জনসংখ্যা এত বেশি যে, এখানে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।

ডেঙ্গুর মূলত তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপ বা ‘ফেব্রাইল ফেজ’। দ্বিতীয় ধাপে ‘ক্রিটিক্যাল ফেজ’ এবং তৃতীয় ধাপে রিকভারি বা ক্রমশ সুস্থ হওয়ার সময়। এই তিনটি ধাপের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপ সবচেয়ে কঠিন।

১৯৮২-৮৩ সালের মধ্যে পরিচালিত ঢাকা মহানগরের স্কুলের শিশুদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে সর্বমোট ২,৪৫৬ রক্তের নমুনার মধ্যে ২৭৮টিতে ডেঙ্গুর লক্ষণ ধরা পড়ে। ১৯৮৪-৮৬ সালে ঢাকা শহরের হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত রক্তের ২১টি নমুনার সবগুলিতেই সংক্রমণের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল।১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসা প্রায় ১১% রোগীর (২৫০ জনের মধ্যে ২৭ জন) মধ্যে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেনের পজিটিভ অ্যান্টিবডি টাইটার ধরা পড়েছিল। ১৯৯৯ সালে ঢাকার মহাখালির স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে, বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো সন্দেহজনক রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ২৪১টির মধ্যে ৯৮টিতে ডেঙ্গুর অস্তিত্ব পেয়েছিল। উক্ত ইনস্টিটিউট প্রদত্ত বিস্তারিত তথ্যে এগুলির মধ্যে কয়েকটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরও তথ্য ছিল।

ঢাকা শহরের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর অস্তিত্বের কথা জানা গেছে ২০১৯ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত রোগী কখনই হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। এমনকি এই সংখ্যা গত ১৯ বছরে দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ৫০ হাজার ১৭৬ জন।২০০২ সালে দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়। সে সময় ৫ হাজার ৫১১ রোগী ভর্তি হয়েছিল।

২০০১ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমলেও ২০০২ সালে রোগীর সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।প্রধানত এশিয়ার গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকার একটি ভাইরাসঘটিত সংক্রামক ব্যাধি। ডেঙ্গু ভাইরাস গোত্রভুক্ত, যার প্রায় ৭০ ধরনের ভাইরাসের মধ্যে আছে ইয়োলো ফিভার ও কয়েক প্রকার এনসেফালাইটিসের ভাইরাস। ডেঙ্গুজ্বরের অনুরূপ একটি রোগের মহামারীর প্রথম তথ্য পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০ সালে চিকিৎসা সংক্রান্ত বইপুস্তকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতায় প্রথম ডেঙ্গুজ্বর শনাক্ত হয়। ১৮৭১-৭২ সালে এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। ওই সময় থেকে এ রোগের প্রকোপ এ উপমহাদেশে প্রায়শই ঘটে। ১৯৩৯-৪৫ সাল থেকে গোটা মহাদেশে ১০ থেকে ৩০ বছর পর পর ডেঙ্গুজ্বর দেখা দিতে থাকে। কোনো একটি বিশেষ স্থানে বারবার ডেঙ্গুর মহামারী দেখা দিত না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু ডেঙ্গু ভাইরাস সেরোটাইপের সহসঞ্চালন দেখা দেয় এবং মহামারীর ঘটনা বৃদ্ধি পায়।

ক্যারিবীয় অঞ্চল (১৯৭৭-১৯৮১), দক্ষিণ আমেরিকা (১৯৮০ সালের শুরুতে), প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (১৯৭৯) এবং আফ্রিকায় ব্যাপক আকারে ডেঙ্গু মহামারী দেখা দেয় যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রমের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৯৫৩-৫৪ সালে ম্যানিলায় এবং ১৯৭৫ সালের মধ্যে নিয়মিত বিরতিসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে। ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালে মহামারী আকারে রক্তক্ষরা ডেঙ্গু ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পূর্বদিকে চীনে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর ও শক-সিনড্রম ডেঙ্গু এখন এশিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি ও শিশুমৃত্যুর একটি প্রধান কারণ।ডেঙ্গুজ্বরের বাহক মশা

চার প্রকারের ডেঙ্গু ভাইরাস ১.২.৩.৪ হলো ডেঙ্গু ও রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর কারণ এবং এগুলি প্রতিজনীভাবেও ঘনিষ্ঠ। যে কোনো একটি সেরোটাইপ বিশেষ কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়, কিন্তু অন্য ভাইরাসগুলির বিরুদ্ধে নয়। উষ্ণমন্ডলীয় ওউপ-উষ্ণমন্ডলীয় শহরাঞ্চলীয় চক্রেই ডেঙ্গু ভাইরাস স্থিতি লাভ করে। এজন্যই শহুরে লোকদের মধ্যেই রোগটি বেশি। মানুষের আবাসস্থলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দিনের বেলায় দংশনকারী মশা এসব ভাইরাসের বাহক। কোনো কোনো অঞ্চলে অন্যান্য প্রজাতি মশাও সংক্রমণ ঘটায়। রোগীকে দংশনের দুই সপ্তাহ পর মশা সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠে এবং গোটা জীবনই সংক্রমণশীল থাকে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ সমূহ

ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো জ্বর। অনেকেই ভাইরাল জ্বর বলে এটি অবহেলা করেন। ডেঙ্গু জ্বর আর ভাইরাল জ্বর একে অপরের থেকে আলাদা হলেও ডেঙ্গু তুলনামূলকভাবে ভয়ংকর। প্রাথমিক লক্ষণগুলো একই হওয়ার কারণে আপনি ঠিক কী রোগে ভুগছেন, তা প্রথম অবস্থায় বোঝা কঠিন হতে পারে।

সঠিক চিকিৎসায় বাড়িতে থেকেই এই রোগের নিরাময় করা সম্ভব। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু ক্ষেত্রেই রোগীকে হসপিটালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। সেই ক্ষেত্রেও এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগী ভাল হয়ে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা থাকে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর বিশেষ কোন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায় না। এটিকে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুই হিসাবে বলা হয়ে থাকে। শুধু অল্প কিছু ক্ষেত্রেই রোগের প্রভাব গভীর হয়।

ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ গুলো হলো

উচ্চ জ্বর (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), তীব্র মাথার যন্ত্রণা, চোখের পেছনে ব্যথার অনুভূতি, মাংসপেশি এবং অস্থি সন্ধিতে যন্ত্রণা, বমিভাব, মাথাঘোরা, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ত্বকে বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি দেখা দেয়া।

এই উপসর্গ গুলি রোগ সংক্রমণের চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। সাধারণত দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত উপসর্গ স্থায়ী হতে পারে। দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগের ভয়াভয়তা বৃদ্ধি পায়। সে কারনে পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অতিরিক্ত সতর্কতা মেনে চলতে বলা হয়। এই ধরনের ডেঙ্গুকে হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর বলা হয়ে থাকে।

ডেঙ্গুর গুরুতর উপসর্গগুলো হলো: প্রচণ্ড পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি হওয়া, মারি বা নাক থেকে রক্তপাত, প্রস্রাবে এবং মলের সাথে রক্তপাত, অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ (যা ক্ষতের মতো দেখাতে পারে), দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, ক্লান্তি, বিরক্তি এবং অস্থিরতা।আর ডেঙ্গু জীবাণু মানুষের শরীরের রক্তনালীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রক্তনালীতে ছিদ্র তৈরি হয়। রক্ত প্রবাহে ক্লট-তৈরির কোষগুলোর (প্ল্যাটলেট) সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এর জন্য মানুষের শরীরে শক লাগা, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত, যে কোন অঙ্গের ক্ষতি এবং শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু হতে পারে।

রোগীর শরীরে গুরুতর উপসর্গগুলো কোন একটি দেখা দিলে অতি অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত বা রোগীকে নিকটবর্তী হসপাতালে ভর্তি করানো দরকার। অন্যথায় রোগীর প্রাণ সংকট হতে পারে। সবচেয়ে ভালো গুরুতর লক্ষণের শুরুতে সতর্ক হওয়া।

এডিস মশা কামড় দিলেই কি ডেঙ্গু হয়?

এমন প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, এডিস মশা কামড় দিলেই ডেঙ্গু হবে না। চিকিৎসকরা বলছেন, পরিবেশে উপস্থিত কোনো ভাইরাস যদি কোনো এডিস মশার মধ্যে সংক্রমিত হয়, শুধুমাত্র তখনই ওই মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্ত্রী এডিস ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তিতে এরা ভাইরাস ছড়াতে থাকে।

ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্য জনে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে।

ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে উঠে। তবে অন্ধকারাছন্ন পরিবেশে দিনের যে কোন সময় কামড়াতে পারে। এডিস মশা অপেক্ষাকৃত আকারে বড়, লম্বা পায়ে ডোরা কাটা থাকে।

এডিস মশা কীভাবে চিনবেন?

একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই যে কেউ ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশাকে খালি চোখেই চিনতে পারবেন। মাঝারি আকারের সাদা-কালো ডোরাকাটা এই মশার শুঁড় থাকে লোমযুক্ত। এদের মাথার পেছনের উপরের দিকেও একটি সাদা দাগ থাকে, তাই সাধারণ মশা থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়।

কাল-থেকে সন্ধ্যা, সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত সময়ে এডিস মশার কামড় দেয়। সাধারণত সকালের প্রথম দিকে এবং সন্ধ্যার ঠিক কিছুটা আগে এডিস মশা তৎপর থাকে। অনেকেই আবার ভাবেন, এডিস মশা বোধহয় শুধু পায়েই কামড়ায়। এটাও এক ধরনের ভুল ধারণা। পায়ের অংশ শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় উন্মুক্ত থাকে বলে, ওই জায়গাকেই এরা কামড়ানোর জন্য বেছে নেয়।

ডেঙ্গুতে প্লেটলেটের সংখ্যা সাধারণত কত হয়?

স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান একজন প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের প্লেটলেট সংখ্যা হয় দেড় থেকে সাড়ে চার লাখ প্লেটলেট প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে। উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীদের এই সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে চলে যেতে পারে। এই সময় রক্তপাতের ঝুঁকি সর্বোচ্চ হয়। মাঝারি ঝুঁকি পূর্ণ রোগীদের প্লেটলেট সংখ্যা ২১ থেকে ৪০ হাজার থাকে।

অবশ্য ডেঙ্গু সংক্রমণে অনেক ক্ষেত্রেই প্লেটলেট সংখ্যার দ্রুত পরিবর্তন হয়। প্লেটলেট কাউন্ট কম এবং রক্তক্ষরণের লক্ষণ প্রকাশ পেলে তবেই প্লেটলেট প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। সংক্রমণ কমার সাথে সাথে আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে প্লেটলেট কাউন্ট বৃদ্ধি পায়।

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কি?

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। শুধু উত্তম বললেও কম বলা হয়। এটাই বাঁচার ভাল উপায়। করোনার এই নাকাল অবস্থায় কারো ডেঙ্গু হলে অবস্থাটা কি হতে পারে এটা যার হবে সেই বুঝতে পারবে। তবে যার হয়নি সেও চিন্তা করলে মাথা ঠিক থাকার কথা না। তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার প্রজনন বন্ধ করা আর মশা নির্মুলের কোন বিকল্প নাই। পানি জমতে পারে এমন কোন অবস্থাই যেন না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সকল প্রকারের ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, ভাঙ্গা বোতল, পরিত্যক্ত ফুলের টব ইত্যাদি ইত্যাদি সবই সরিয়ে ফেলতে হবে নিজ উদ্যোগেই। সরকারের একার পক্ষে ১৭ কোটি মানুষের ভাঙ্গা বোতল, গ্লাস, ডাবের খোসা, বালতি, টায়ার খুঁজে বের করা বা সরিয়ে ফেলা সম্ভব না। বাঁচতে হলে যার যার নিজ উদ্যোগেও এগুলোতে অংশগ্রহন করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার বাড়ির পাশের মশা আপনাকেই আক্রমণ করবে।

ডেঙ্গু রোগীর খাদ্য

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি এইসময়ে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া জরুরি। কারণ ডেঙ্গুতে শরীরের প্লাটিলেট কমে যেত শুরু করে। এ ছাড়াও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা বাড়তে পারে।

তাই ডেঙ্গু জ্বর হলে পুষ্টিকর খাবারের মাধ্যমে শরীরে পুষ্টি গ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। পুষ্টিবিদদের মতে, ডেঙ্গু হলে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। জ্বর হলে অনেকেই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেন।

এর থেকে হতে পারে পানিশূন্যতা। পাশাপাশি কমে যেতে পারে প্লাটিলেট সংখ্যা। তাই বাড়িতে কারও ডেঙ্গু জ্বর অবশ্যই কয়েকটি খাবার খাওয়ানো জরুরি। জেনে নিন কোন খাবারগুলো খাওয়াবেন ডেঙ্গু রোগীকে-

* ডালিমে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল। এ সময় ডালিম খেলে বাড়বে প্লেটলেটের সংখ্যা। এই উপকারী ফলটি খেলে ক্লান্তি ও অবসাদ অনুভূতিও দূর হবে।

* শারীরিক সুস্থতায় ডাবের পানি অনেক উপকারী। ডেঙ্গু জ্বর হলে শরীরে তরল পদার্থের শূন্যতা থেকে সৃষ্টি হয় ডিহাইড্রেশন। তাই এ সময় বেশি করে ডাবের পানি পান করুন। এতে থাকে ইলেক্ট্রোলাইটসের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি।

* কমলা বা মালটার রসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এ দুটি উপাদান ডেঙ্গু জ্বর নিয়ন্ত্রণে উপকার করে। * কিউই ফলেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে এতে থাকে পটাশিয়াম। এ ফল খেলে ইলেক্ট্রোলাইট স্তর এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেইসঙ্গে কিউই খেলে শরীরে লোহিত রক্ত কণিকার মাত্রাও বৃদ্ধি পায়।* রান্নাঘরের একটি উপাদান হলো হলুদ। যা চিকিৎসায় যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ডেঙ্গু জ্বর হলে এক গ্লাস দুধের সঙ্গে এক চিমটি হলুদ মিশিয়ে পান করুন। হলুদ দুধ খাওয়ার একাধিক স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে।

* মেথি সবার ঘরেই নিশ্চয়ই আছে! ডেঙ্গু হলে অতিরিক্ত মাত্রার জ্বর কমাতে সাহায্য করে এই উপাদানটি। তবে মেথি গ্রহণ করার পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরমার্শ করে নিতে হবে।

* ব্রোকোলি হলো ভিটামিন কে’র একটি ভালো উৎস । অন্যদিকে ভিটামিন কে রক্তের প্লেটলেট বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। যদি কোনো ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন; তাহলে অবশ্যই তাকে ব্রোকোলি খাওয়াতে হবে।

* পালং শাকে থাকে প্রচুর পরিমাণে আইরন এবং ওমেগো-থ্রি ফ্যাটি এসিড। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করেতে সহায়তা করে এই শাক। পালং শাক গ্রহণে ডেঙ্গু রোগীর প্লেটলেট দ্রুত বাড়বে।

* ডেঙ্গু হলে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পাশাপাশি তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার পরিহার করুন। সেইসঙ্গে মসলাযুক্ত খাবারও এড়িয়ে চলতে হবে। এ ছাড়াও ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় খাবেন না। এসব খাবার শরীরের কোনো উপকারেই আসে না বরং ক্লান্তি ও অসুস্থতা বাড়িয়ে দেয়।

হোমিও প্রতিবিধান

রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা.হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে ডেঙ্গুরোগ সহ যে কোন জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডেঙ্গু
রোগীর চিকিৎসা সম্ভব।

হোমিও চিকিৎসা

অভিজ্ঞ চিকিৎসক গন প্রাথমিক ভাবে যেই সব মেডিসিন ব্যবহার করে থাকেন, একোনাইট, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া, রাসটক্স, ইউপেটেরিয়াম পার্ফ, আর্সেনিক এলবাম, কার্বোভেজ, জেলসিয়াম, নাক্স ভূমিকা, ইপিকাক, সালফার সহ আরো অনেক ঔষুধ লক্ষণের উপর আসতে পারে, তাই মনে রাখবেন হোমিওপ্যাথি একটি লক্ষণ নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে মানুষভেদে ওষুধ বদলে যায়। তাই রোগের তীব্রতা খুব বেশি থাকলে নিজে থেকে ওষুধ না খেয়ে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পরিশেষে বলতে চাই, ডেঙ্গু জ্বর একটি সাধারণ রোগ। কিন্তু অবহেলা করলে এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। শহরাঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি। তাই নগরবাসীকে আরেকটু সজাগ ও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে যাদের ডেঙ্গু হয়েছে তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। দ্বিতীয় ডেঙ্গু সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং ভালো থাকুন।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।