প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধের ক্ষতি
২০২৩ নভেম্বর ১৫ ১৯:০৩:৩৮প্রফেসর ড. মো. সেকেন্দার আলী
গুজরাটি শব্দ ‘হর’ মানে সব জায়গায় আর ‘তাল’ মানে তালা। অর্থাৎ হরতাল মানে সব জায়গায় তালা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকবৃন্দের মতে হরতাল হচ্ছে -গাড়ির চাকা ঘুরবে না এবং অফিস-আদালতসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এক কথায় সব কিছু অচল করে দেয়ার কর্মসূচি হচ্ছে হরতাল।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী হরতালের প্রবর্তন করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ‘তমুদ্দিন মজলিস’ প্রথম হরতাল ডাকার পর থেকে এ দেশের রাজনীতিতে হরতাল কর্মসূচিটি প্রচলিত হয়।
অন্যদিকে অবরোধ কর্মসূচি হচ্ছে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সবকিছু খোলা রেখে যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। গ্রিক উপাখ্যানে ইলিয়াড ও ওডেসিতে ট্রয় নগরী অবরোধের কথা আছে। ১১৮৭ সালে সালাউদ্দিন আইয়ুবি জেরুজালেম অবরোধ করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিএনপি-জামাতসহ কয়েকটি বিরোধী দল হরতাল-অবরোধকে একই ধরণের কর্মসূচী বিবেচনা করে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড যুক্ত করে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে। তারা হরতাল ও অবরোধে অগ্নিসংযোগ করে জালাও-পোড়াও করছে এবং সব ধরনের সরবরাহ চেইন বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত করে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হরতাল ও অবরোধে ক্ষতির বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো।
কৃষি উৎপাদন ব্যাহত: সরবরাহ চেইন বিচ্ছিন্ন হওয়ায় কৃষি উপকরণ যেমন সার, বালাইনাশক, বীজ, গ্রোথ রেগুলেটর, সেচ কাজের জন্য ডিজেল ইত্যাদি স্থানীয় বাজারে পৌছাতে পারছে না, ফলে কৃষক এগুলো সংগ্রহ করতে পারছে না। আবার কম সরবরাহের কারণে এগুলোর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য শহরের বাজারে পাঠাতে পারছে না। সার্বিকভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি: অবরোধের কারণে সব ধরনের সরবরাহ চেইন বিচ্ছিন্ন হওয়ায় গত কয়েকদিনে কৃষি পণ্য বাজারে আসতে পারছে না। ফলে কৃষি পণ্যসহ অন্যান্য যাবতীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। হরতাল-অবরোধের ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
দেশে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে আলু, পেঁয়াজ, চিনি, সয়াবিন তেল ও ডিমের দাম বেঁধে দেয়্। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম বাজারে কার্যকর না হওয়ার পেছনে সরবরাহ ঘাটতিই দায়ী। সরবরাহ যদি ঠিক থাকত, তা হলে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমে যেত। সরবরাহ সন্তোষজনক না হওয়ায় সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করা যাচ্ছে না।
শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত: হরতাল-অবরোধের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। নভেম্বর মাসে বিদ্যালয়সমূহে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বার্ষিক পরীক্ষা আয়োজন করতে হিমসিম খাচ্ছে। অবরোধের সংগে জালাও-পোড়াও ও অগ্নি সংযোগের অপরাজনীতি যুক্ত হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্র, অভিবাবক সকলেই উদ্বিগ্ন। ঝুকি নিয়ে যাতায়াত করলেও তাদের যাতায়াত খরচ বহুগুনে বাড়ছে।
স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা ব্যাহত: হরতাল-অবরোধে রিকসা-ভ্যান ও অটোরিকসা চালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুরগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অটোরিকসা চালককে মালিকের দৈনিক ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে, কিন্তু তারা পাচ্ছে না যাত্রী। শ্রমিকরা পাচ্ছে না কাজ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারছে না। সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওযায় তাদের ত্রাহিত্রাহি অবস্থা।
ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত: জনগণ ও অর্থনীতিকে জিম্মি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার লক্ষ্যে সরকার-বিরোধী দলসমূহের ডাকা অবরোধের সংগে অগ্নি-সন্ত্রাসের ভয়ে ব্যবসায়ীগণ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো চালাতে পারছে না। এভাবে চললে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতে পারবে না। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হবে। বেকারত্ব বাড়বে।
আমদানী-রপ্তানী হ্রাস: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় এমনিতেই বিদেশী ক্রেতারা তাদের ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছে। হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে সময়মতো পণ্য বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন বাধা সৃষ্টি হবে, পাশাপাশি পণ্যের জাহাজীকরণও হবে বাধাগ্রস্ত। এ সুযোগে ক্রেতারা তাদের ক্রয়াদেশ আরও কমিয়ে দেবে। আগের দেওয়া ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে দেরি করবে। রাজনৈতিক এসব কর্মসূচি কারও উপকার বয়ে আনে না।
কর্মসংস্থান হ্রাস: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিনিয়োগের টাকা ফেরত আসা, পণ্যের বাজারজাতকরণ, শিল্প-বাণিজ্য পরিচালনা, বিনিয়োগ ঝুকি, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা ভাবতে শুরু করছেন।
এমতাবস্থায় ব্যবসায়ীগণ নতুন কর্মী নিয়োগের পরিবর্তে কর্মী ছাটাই করার কথা ভাবছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান হবে না, বরং কর্মসংস্থান আরও কমবে। যার প্রভাবে বেড়ে যেতে পারে বেকারের সংখ্যা।
বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস: বিদেশীরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ দেখলে বিনিয়োগ করে না। হরতাল অবরোধ থাকলে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিদেশী বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ফলে, এখন দেশের অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে।
অর্থনীতিতে সংকট: হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়ায়ের কারণে দেশে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষক, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দুই বছরের করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটতে না কাটতেই পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই সংকটে আছে দেশের অর্থনীতি। ফের রাজনীতির মাঠ সহিংস হয়ে উঠলে দেশে অর্থনীতিতে সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে।
বস্ত্র শিল্পের সংকট: দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, ইত্যাদি বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বস্ত্র ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা কমছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির সাথে দেশের ভেতরে অবরোধের অস্থিরতা সৃষ্টি হলে রপ্তানিমুখী শিল্প খুবই সংকটে পড়বে। অস্থিরতার কারণে ক্রেতারা বিকল্প খুঁজবেন। এ ধরণের অচলাবস্থায় বস্ত্র শিল্প সংকটে পড়বে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছেন ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগীদের ৬ দিনের অবরোধ-হরতালে অর্থনীতির আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়নের ডলারের বেশি।
বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৫০ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। সে হিসেবে এক দিনের হরতাল বা অবরোধে দেশের ক্ষতি হয় প্রায় ১৪ হাজার কোটি ডলার। দেশের অর্থণীতি সচল রাখতে হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচী পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
লেখক: অধ্যাপক, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।