ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

ভারত-অষ্ট্রেলিয়া খেলা নিয়ে বিতন্ডা এবার থামুক 

২০২৩ ডিসেম্বর ০১ ১৭:৩৯:০৯
ভারত-অষ্ট্রেলিয়া খেলা নিয়ে বিতন্ডা এবার থামুক 

শিতাংশু গুহ


ভারত-অষ্ট্রেলিয়া ফাইনালে ভারতের পরাজয়ের পর বাংলাদেশী ফ্যানদের উল্লাস, টিএসসি চত্বরে উন্মাদনা বা সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষ এবং এর পাল্টা হিসাবে বিশেষত: পশ্চিমবঙ্গের কতিপয় মানুষের উষ্মা ও অনভিপ্রেত বক্তব্য এখনো থামেনি। থামা উচিত, অনেক হয়েছে। ছোট্ট একটি ভিডিও দেখলাম, কম বয়সী ছেলেটি সম্ভবত: কলকাতার। ছেলেটি বাংলাদেশীদের গালিগালাজ করে বললো, ‘ভারত হারলে তোমাদের ঈদের আনন্দ হয়, ভারতের বিরুদ্ধে কলাগাছ জিতলেও তোমরা খুশি? দেখ, এবার তোদের মেডিকেল ভিসা বন্ধ করে দিয়েছি। সামনে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ-ডিম্ দেয়া বন্ধ করবো। দার্জিলিং-এ হোটেলে তোমাদের ভাড়া দেয়া বন্ধ করেছে, সামনে কলকাতা আসা বন্ধ করবো’।

বাংলাদেশিদের বেশ ক’টি ভিডিও, সামাজিক মাধ্যমে বক্তব্য দেখলাম। ভারত বিদ্বেষ, হিন্দু বিদ্বেষ তো আছেই, অনেকে ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের বিমাতাসুলভ আচরণের কথা বললেন। একজন একটি ‘টক-শো’-তে বললেন, ভারত গত দশ বছর একটি দলকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে। একটি মেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ভারত তার নিজের প্রয়োজনে পারমাণবিক পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দিয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক দেশ ছিলোনা। কেউ কেউ বললেন, ভারত বাংলাদেশ থেকে সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে। এমত অসংখ্য অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধে! তাদের মতে অষ্ট্রেলিয়া জেতায় ভারতের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটেছে।

উভয় পক্ষের বক্তব্যে হয়তো যুক্তি আছে, কিছুটা সত্যতাও রয়েছে, কিন্তু গালাগালি বা বিদ্বেষ কেন? ভারত মেডিক্যাল ভিসা বন্ধ করেছে, এমন খবর দেখিনি। সমস্যাটি আসলে বাংলাদেশ-ভারতের নয়, দুই দেশের সরকারে এনিয়ে মাথাব্যথা নেই। সমস্যাটি দুই বাংলার, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের। বাঙ্গালীর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তাই খৈ ভাঁজছে! ভারতের পরাজয়ে বাংলাদেশে তরুণ সমাজের উন্মাদনা দৃষ্টিকটু, এবং পশ্চাদপর, কিছুটা বিজাতীয়। বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী ভারত বিদ্বেষী, এবং কারো কারো মতে হিন্দু-বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করেন। এটিও সত্য যে, বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ভারতকে পছন্দ করেন, এবং তাঁরা আছেন বলেই হিন্দুরা এখনো সেখানে টিকে আছে। এটিও সত্য যে, এদের সংখ্যা প্রতিদিন কমছে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গ একদা পূর্ব-পাকিস্তান, পূর্ববাংলা বা আজকের বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে ছিলো, হয়তো এখনো আছে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ অনেক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ একটি দেশ, পশ্চিমবঙ্গ একটি রাজ্য। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে। সোহরাওয়ার্দী সৃষ্ট ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পর পশ্চিমবঙ্গে কখনো দাঙ্গা হয়নি। পূর্ববঙ্গে বারবার দাঙ্গা হয়েছে। ভারত ভাগের পর পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব-পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এবং সরকার মিলে হিন্দুদের ওপর ক্রমাগত নির্যাতন করেছে, আজো তা অব্যাহত। পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র ও বাম-শাসন এবং সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ কখনোই মুসলমানের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেনি। পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুর দেশত্যাগ এবং পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান থেকে যাওয়ার এটি একটি অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি মারলেও গণতন্ত্র কখনোই বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। এরফলে মানুষ মুক্তচিন্তা করতে ভুলে গেছে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বা সমাজ মানুষকে ক্রমাগত পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি বা সমাজের ওপর রাষ্ট্রের প্রভাব পরে বটে। এর মানে কি বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা হয়না? হয়, সীমিত এবং রাষ্ট্রযন্ত্র সেটি পছন্দ করেনা। এজন্যে বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার মানুষগুলো পালিয়ে বেড়ায়, দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়? একটি ভিডিওতে বাংলাদেশের একটি মেয়ে বললেন, সেভেন-সিষ্টার বাঁচাতে ভারত একটি তল্পিবাহক সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এও বললেন, ভারত নাকি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের মদত দিচ্ছে। ফেইসবুকে আমার এক সুন্দরী বন্ধু, যিনি সর্বদা রূপচর্চায় ব্যস্ত ছিলেন, তিনিও দেখলাম ভারতের পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন।

বাংলাদেশের অনেকেরই ভারতের সেভেন সিষ্টার নিয়ে ঘুম হয়না। আশির দশকে ভারতীয় দূতাবাসে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিক হিসাবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে খাওয়া-দাওয়ার এক পর্যায়ে এক বাংলাদেশী বন্ধু রাষ্ট্রদূতকে তাগাদা দিলেন যে, ‘দাদা, বৌদি খাবেনা’? রাষ্ট্রদূত চুপ ছিলেন। ভদ্রলোক পুনরায় একই কথা বললে, রাষ্ট্রদূত হেঁসে বললেন, ‘আপনার বৌদি নিজেকে টেক-কেয়ার’ করতে জানে’। এ ঘটনা মনে পড়লে আজো আমার হাঁসি পায়! বাংলাদেশী যাদের সেভেন সিষ্টার নিয়ে ঘুম আসেনা, তাদের বলা যায়, ‘ভারত জানে কিভাবে সেভেন সিষ্টার রক্ষা করতে হবে’। বলছি না যে ভারতের সমালোচনা করা যাবেনা। ভারত বৃহত্তম গণতন্ত্র, দেশের ভেতরেই ওঁরা যথেষ্ট সমালোচনামুখর। বাংলাদেশের মানুষের সমালোচনাটা ‘সাম্প্রদায়িক’।

আমি বহু হিন্দু দেখেছি যাঁরা অষ্ট্রেলিয়ার পক্ষে। আবার বহু মুসলমান যাঁরা ভারত হেরে যাওয়ায় দু:খ পেয়েছেন। তাইতো হওয়া উচিত, তাইনা? ভারতের যাঁরা ভিসা বন্ধের হুমকি দিচ্ছেন, তারাও কাজটা ভাল করছেন না? বলছিলাম যে, ভারত-অষ্ট্রেলিয়া খেলা নিয়ে বাংলাদেশিরা যেটা করেছে সেটা যেমন সঠিক নয়, পশ্চিমবঙ্গের যাঁরা হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন, তারাও কাজটা ঠিক করছেন না। অনেক হয়েছে, এবার থামুন।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।