ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

ভারত বিদ্বেষ উসকে দেওয়া শুভ লক্ষণ নয়

২০২৪ এপ্রিল ০৬ ১৮:১০:৪৫
ভারত বিদ্বেষ উসকে দেওয়া শুভ লক্ষণ নয়

চৌধুরী আবদুল হান্নান


বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার দেশ ভারত আমাদের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ, বাংলাদেশের জন্মকালীন বন্ধু রাষ্ট্র। ঘোর বিপদে যে পাশে এসে দাঁড়ায়, সেই তো প্রকৃত বন্ধু।

‘৭১ এ পাকিস্তানি জল্লাদের কবল থেকে বাঙালি যখন জীবন বাঁচাতে দিশেহারা, আশ্রয়হীন ভারত তখন আমাদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করেছে।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিয়ে যুদ্ধ জয় ত্বরান্বিত করেছিলেন। বিশ্বের কথিত অন্যতম সেরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে স্বল্প সময়ে পরাজিত করে বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ায় ইন্দিরা গান্ধীর অবদান শ্রদ্ধার সাথে চিরকাল স্মরণে রাখবে বাঙালি জাতি। কৃতজ্ঞতাবোধ না থাকলে জাতি হিসেবে আমরা ছোট হয়ে যাবো।

তবে অনেকেরই প্রশ্ন, ভারত কি আমাদের স্বার্থহীন সহযোগিতা করেছে ? ভারতের স্বার্থ তো ছিলই, অনেক বড় স্বার্থ। ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দ্বিখন্ডিত করার একটা মোক্ষম সুযোগ তারা কাজে লাগিয়েছে। শত্রুকে ধরাশায়ী করার এমন সুযোগ কেউ কখনও হাতছাড়া করে না।

বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই নিজ দেশের স্বার্থের বাইরে কাজ করে না। মহাদুর্যোগে ভারত আমাদের পাশে ছিল, সেটা না দেখে যারা পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াটা আগে দেখে তারা চেনা লোক, ১৯৭১ এ তারা চিহ্নিত। যে পরিবার পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার প্রত্যক্ষ শিকার হয়েছে, তারা কখনও ভুলতে পারবে না সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি। অন্যের ঘরবাড়ি শত্রুর দেওয়া আগুনে পুড়েছে কিন্ত আমাদের কিছু হয়নি, আমরা তো ভালো আছি — এমন ভাবনা যাদের, তাদের মানুষ বলা যায় না।

বহু ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দেশটির ৫৩ বছরে এসেও যারা মনে প্রাণে পাকিস্তান-প্রীতি লালন করেন তারা জাতির মিত্র হতে পারে না।

তবে নানা কারণে বা ভারতের বিভিন্ন নেতিবাচক দিকগুলোকে ব্যাপক প্রচারের ফলে জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব লক্ষণীয়। দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থ সংস্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা থেকে বন্চিত করা, মাঝে মাঝে সীমান্ত হত্যার ঘটনা ক্ষোভের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

ভারতের সাথে আমাদের চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রেখা রয়েছে, যেখানে উভয় দেশের চোরাকারবারী, মানব পাচারকারী, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সার্বক্ষণিক অপতৎপরতা লেগেই থাকে। এতো বড় সীমান্ত পাহারা দেওয়ার কাজটা মোটেই সহজ নয়। তবে বিনা বিচারে হত্যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়; এমন ঘটনাই ভারতবিরোধী ক্ষোভের একটি বড় কারণ।

বর্তমান বাস্তবতায় পৃথিবীতে কোনো দেশ একা চলতে পারে না, দ্বি-পাক্ষিক বা বহু-পাক্ষিক সম্পর্ক রক্ষা করার দরকার হয়; নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজন বিচক্ষণ কূটনৈতিক তৎপরতা। এক্ষেত্রে নতজানু নীতির পরিবর্তে নিজ দেশের সম্মান ও স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের মেধা, ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা ও যোগ্যতার বিকল্প নেই।

“কারও সাথে বৈরিতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব”— এমন নীতি সকল দেশের জন্য শুভবার্তা দেবে।

বিশ্বব্যাপী ভারতের একটি শক্তিশালী প্রভাব বলয় রয়েছে, বন্ধুত্ব ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এখান থেকে সর্বোচ্চ সুবিধাটা নেওয়ার চেষ্টা করবে। আমাদের পক্ষে ভারতের শক্ত অবস্থানের কারণে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে বৃহৎ শক্তির হাতের পুতুল হতে হয়নি। আমাদের বিশ্বাস কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী কাজে তৎপর হলে ভারত বসে থাকবে না।

বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন সময় তাঁর নিরাপত্তা বিষয়ে ভারত সতর্ক করেছিল, আগাম তথ্যও দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭ দশক পরও জাপান, ইতালিসহ অনেক দেশে আমেরিকান সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি কিন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

সদ্য স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এমন বিরল সম্মান প্রদর্শন ছিল ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা।

ভারতের সাথে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান। দুদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং শক্তিশালী, অর্থনীতির সর্বত্র এর ব্যাপ্তি; বানিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ — সব ক্ষেত্রেই। মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, জীবনের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে দু-দেশের সম্পর্কের ছোঁয়া পাওয়া যাবে না। ২০২২ সালে ভারত সফরকালে শেখ হাসিনা ঘোষিত “বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বৃত্তি” ‘৭১ এ যুদ্ধে আত্মদানকারী ভারতীয় বীর সেনা সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এক অনন্য স্মারক হয়ে আছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবনদানকারী এবং পঙ্গুত্ব বরণকারী ভারতীয় সেনা সদস্যদের উত্তসূরীদের মধ্যে বৃত্তি প্রদানের এ ঘোষণা দু’দেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করবে।

বর্তমানে ভারতের পণ্য বর্জনের বিএনপির আন্দোলন, একটি ক্লান্ত দিকভ্রান্ত রাজনৈতিক দলের অযৌক্তিক কর্মসূচী বলা যায়। রাজনীতির মাঠে সব কিছু হারিয়ে দলটি অবশেষে মানুষের ভারত বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে যদি কিছু একটা করা যায়। যেমন একটা কিছু করতে সক্ষম হয়েছে ভারত মহাসগরের একটি দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মইজ্জু; ভারত বিরোধী প্রচার ছিল তার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পুঁজি। তবে বিএনপি যদি এমন স্বপ্ন দেখতে থাকে তা দিবা স্বপ্নে পরিণত হবে কিনা তা এখনই বলা যায় না।

মাত্র সাড়ে ৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরীয় অন্চলে মূলত একক প্রভাব বিস্তারকারী একটি বৃহৎ দেশ ভারতের সাথে বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে কীভাবে পরিচালিত হবে, তা একটি বড় প্রশ্ন।

স্মরণযোগ্য যে, ১৯৮৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নির্দেশে ভারতের বিমান বাহিনী তাৎক্ষণিক এবং ঝটিকা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মালদ্বীপে সরকার উৎখাতের একটি চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়, রক্ষা পায় দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাউয়ুম। দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে উভয়ই লাভবান হয় বন্ধুত্ব অটুট থাকলে, বৈরিতায় নয়।

ইন্ডিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ সম্প্রতি বলেন — যারা বয়কটের ডাক দিয়েছেন, তারা দেশের ব্যবসার স্বার্থের বিরুদ্ধে এ উদ্যোগ নিয়েছেন।

সহজে আমদানি করা যায় এবং পরিবহন ব্যয় কম হয় বলেই দূরবর্তী দেশের পরিবর্তে নিকটতম দেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানি করা হয়।

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন — “ভারত থেকে আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি তার সিংহভাগই শিল্পের কাঁচামাল। আমরা আমাদের স্বার্থেই আমদানি করি, ভারতের স্বার্থে নয়।”

বিএনপি এবং তাদের সমমনা দল ভারত বিরোধী ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে, পণ্য বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হবে, তা বলার সময় এখনও আসেনি, তবে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কোনো কর্মসূচী সফল হয় না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।