ঢাকা, শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

বিশ্ব কণ্ঠ দিবস 

কন্ঠস্বরকে সুস্থ রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা

২০২৪ এপ্রিল ১৫ ১৫:৫৭:৫৯
কন্ঠস্বরকে সুস্থ রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


মঙ্গলবার বিশ্ব কণ্ঠ দিবস ২০২৪। প্রতি বছর ১৬ এপ্রিল দিবসটি পালিত হয়। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলে প্রথম এবং ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় কণ্ঠ দিবস। কণ্ঠের ব্যবহার, যত্ন, রোগের চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোই দিবস পালনের উদ্দেশ্য।

কণ্ঠকে শুধু যোগাযোগের প্রধান উপায় ভাবলে ভুল হবে। বাক্যের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে কণ্ঠের ওঠানামা আমাদের ব্যবহার করা শব্দের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কথা কি প্রভাব সৃষ্টি করবে তার ৩৮ শতাংশ নির্ভর করে কণ্ঠের ওঠানামার অপর। আর তাই দৈনন্দিন সাংসারিক বা কর্মক্ষেত্রে কথাবার্তার জন্য ভালো কণ্ঠের গুরুত্ব অনেক বেশি। পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারী মানুষের জন্য কণ্ঠই সবকিছু। পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারী বলতে আমরা বুঝি যাদের পেশার জন্য কণ্ঠ প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। যেমন-গায়ক, অভিনেতা, শিক্ষক, উকিল, ধারাভাষ্যকার, সেলসম্যান, কলসেন্টারের কর্মী ইত্যাদি।

আমেরিকাতে ২৯% মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময় কণ্ঠের সমস্যায় ভুগে থাকেন এবং এতে যে কর্মক্ষমতা নষ্ট হয় তার অর্থ মূল্য প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি ২০০ কোটি টাকা,বছরে প্রতি ১৩ জনে একজন এই সমস্যায় পড়েন। বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে মহিলা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ছেলেরা এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়। আমেরিকাতে পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারীদের মাঝে এই বিষয়ে চালানো জরিপ অনুযায়ী শিক্ষকদের ১১% কণ্ঠের সমস্যায় ভুগছেন। শিক্ষক ছাড়া অন্য পেশার জন্য এই হার ৬.২%। কণ্ঠের সমস্যায় চাকরি হারিয়েছেন এমন সংখ্যা শিক্ষক ২০% এবং অন্য পেশাজীবী ৪%। অন্যান্য জরিপে দেখা যায় যে ৪৬.০৯% কণ্ঠশিল্পী, ৪৫% কলসেন্টারের কর্মী কণ্ঠের সমস্যার কারণে কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

কণ্ঠনালির প্রদাহ সমস্যার কারণ কী

এ প্রদাহ দু’ধরনের। যেমন-তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস। কণ্ঠনালির ভাইরাসজনিত, আবহাওয়া পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণেও কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে। যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে কণ্ঠনালিতে ইনফেকশন ও শ্বাসকষ্ট হয়, তখন চিকিৎসা দরকার। পাকস্থলীর অ্যাসিড রিফলাক্সের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে। ধূমপান, অতিরিক্ত চা বা পানীয় পান করলে, হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস হতে পারে।

কণ্ঠস্বরের অতিব্যবহার : অতিরিক্ত চিৎকারের কারণে যেমন স্বর ভেঙে যায়, তেমনি আবার মৌসুম বদলের সময়ও অনেককে এমন সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। তাপমাত্রার তারতম্যের সময় কণ্ঠনালি কিংবা টনসিলের প্রদাহের উপসর্গ হিসেবে স্বর ভেঙে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।

তবে কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে রোগী স্বর ভেঙে যাওয়ার সমস্যায় ভোগেন:

কণ্ঠস্বরের ওপর যাঁদের খুব বেশি চাপ পড়ে, (যেমন গায়ক, আবৃত্তিকার, শিশুদের শিক্ষক) তাঁদের স্বরতন্ত্রীতে (ভোকাল কর্ড) ছোট ছোট গোটা হতে পারে (নডিউল)। এ রকম হলে স্বর অস্বাভাবিক রয়ে যায় দীর্ঘদিন।

* থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি।

* ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসার।

* স্টেরয়েড ইনহেলার ব্যবহারে স্বর ভেঙে যেতে পারে।

আনুষঙ্গিক উপসর্গ

মৌসুমজনিত কারণ হলে গলাব্যথা, জ্বর, কাশি ও সর্দির মতো উপসর্গ থাকে।

থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতিতে ওজন বৃদ্ধি, ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা, দুর্বলতা, বিষণ্নতা, চিন্তায় ও কাজে অস্বাভাবিক ধীরতা, চুল পড়া প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়।

ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসারে ওজন হ্রাস, বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

কণ্ঠস্বর যত্নে কিছু কৌশল

১। সবার আগে দরকার সচেতনতা। অনেকেই জানে না যে, তাদের পেশার জন্য সুস্থ ও সুন্দর কণ্ঠ কতটা জরুরি।

২। নিজের কণ্ঠ নিজে শুনতে হবে, যেন কোনো সমস্যা তাড়াতাড়ি আন্দাজ করা যায়। সমস্যা তিন সপ্তাহের বেশি থাকলে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

৩। আর্দ্রতা কণ্ঠের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি, তাই প্রতিদিন অন্তত ২ লিটার পানি পান করতে হবে।

৪। কণ্ঠ ব্যবহারে সাবধানী হোন। অতিউচ্চ বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বলবেন না।

৫। ধূমপান, অ্যালকোহল, তামাক, গাঁজা ও অন্যান্য নেশা সম্পূর্ণ পরিহার করুন।

৬। ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে খাওয়া শেষ করুন এবং অল্প আহার করুন।

৭। অতিরিক্ত টেলিফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

৮। অপ্রয়োজনে বারবার গলা পরিষ্কার/কাশি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।

৯। শুষ্ক আবহাওয়া কণ্ঠের জন্য ক্ষতিকর। শীতাতপ যন্ত্রের বাতাস যাতে জলীয়বাষ্প কম, কণ্ঠের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। রাতে আর্দ্রতাকরণ যন্ত্র ব্যয়ভার করুন।

১০। গলা শুকনা থাকলে অথবা মিউকাস জমে থাকলে জোরে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি যা ক্ষতিকর। যা করবেন-বুক ভরে শ্বাস নিন, কিছুক্ষণ ধরে রাখুন, এবারে শ্বাস ছাড়ার সময় আস্তে শব্দ করুন ওয়ালার।

১১। যখন বেশি মিউকাস উৎপন্ন হয় তখন মিউকাস তরলকারী ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন।

১২। স্থানীয় চেতনানাশক যথেচ্ছ ব্যবহার করবেন না।

১৩। নিয়মিত ব্যায়াম অভ্যাস করবেন। ব্যায়াম কর্মশক্তি যেমন বৃদ্ধি করে, বাড়ায় মাংসপেশির দৃঢ়তা। ব্যায়াম জোগায় নিঃশ্বাসের প্রাচুর্য, যাতে করে শুদ্ধভাবে কথা বলা সম্ভব হয়।

১৪। বিশ্রাম নিতে হবে যথেষ্ট। শারীরিক ক্লান্তি কণ্ঠস্বরের ওপর মন্দ প্রভাব বিস্তার করে।

১৫। ঝাল খাবার বর্জন করতে হবে। ঝাল থেকে বেড়ে যায় পাকস্থলির এসিড। আর তা উঠে আসতে পারে খাদ্যনালী বেয়ে, যাকে বলা হয় রিফ্লাক্স।

১৬। নিজের হাত দুটো প্রায় প্রায় ধুয়ে নেওয়ার অভ্যাস করুন। এতে সর্দিজ্বর আর ইনফ্লুয়েঞ্জা কাবু করতে পারবে কম।

হোমিও সমাধান

কন্ঠস্বরের সংক্রমণ যেকোনো মানুষের হতে পারে। এতে আপনার গলা ফুলে যাবে, ব্যথা হবে এবং খাবার গিলতে কষ্ট হবে। মূলত ফ্লু এবং সাধারণ ঠান্ডা ফ্লু ভাইরাস এই সংক্রমণের কারণ, এছাড়াও অ্যালার্জি, ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, দূষিত বায়ু বা ধূমপানও এই সংক্রমণের কারণ।তাই-কন্ঠস্বরের সমস্যা সর্বাধিক কার্যকর চিকিৎসা নিশ্চিত করছে হোমিওপ্যাথি। পৃথিবীতে হোমিওপ্যাথি ছাড়া অন্য সকল চিকিৎসা শাস্ত্র উপরি উপরি চিন্তা করে চিকিৎসা কার্য্য সম্পাদন করে থাকে যার কারণে মূল থেকে রোগ নির্মূলে ব্যর্থ হয় তারা। তাছাড়া হোমিওপ্যাথি ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসা শাস্ত্রে বহু দুরারোগ্য বা ক্রনিক রোগের চিকিৎসাই নেই। একমাত্র হোমিওপ্যাথি রোগের বাস্তব কারণ অনুসন্ধান করে মূল থেকে যেকোন দুরারোগ্য রোগ নির্মূলের চিকিৎসা দিয়ে থাকে। আর এই কারণেই মারাত্মক রোগ ব্যাধির সবচেয়ে কার্যকর এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করছে হোমিওপ্যাথি। তবে এর জন্য অবশ্যই এক্সপার্ট কোন হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে চিকিৎসা নেয়া জরুরী।রোগীর লক্ষণের উপর নির্ভর করে কন্ঠস্বরের রোগ নিরাময় করতে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক প্রাথমিক ভাবে যেই সব মেডিসিন নির্বাচন করে থাকে বেলাডোনা, হেপার সালপিএইচ, ফসফরাস লাচেসিস, ইগ্নাশিয়া, ব্রায়োনিয়া, ড্রসেরা, মার্ক সোল, আর্সেনিকাম অ্যালবাম, অ্যাকোনাইট, কস্টি‌কাম, আর্জেন্টাম মেটালিকাম, চামোমিলা, ব্যারিটা কার্বোনিকা, থুজা, সালফার, কেলি ভাইক্রম, রাস্ট্রক্স সহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের উপর আসতে পারে। তবে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধই গ্রহণ করা উচিত নয়।

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করি প্রধানত কণ্ঠের মাধ্যমে। আমরা কণ্ঠ দিয়ে হাসি, কাঁদি, মন খুলে কথা বলি, রেগে গিয়ে বা বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে চিৎকার করি, সহজে মনের ভাব প্রকাশ করি।আর কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে আমাদের ভাবনা ও অনুভূতি অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা মানুষ হিসেবে আমাদের সবথেকে বড় প্রাপ্তি। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং খাওয়ার অভ্যেস কণ্ঠস্বরের নানা সমস্যার জন্ম দেয়। তাই সঠিক কণ্ঠস্বর বজায় রাখতে স্বাস্থ্যকর অভ্যেসক বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনটি উদযাপনের লক্ষ্যই হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কণ্ঠের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি ও সুস্থ কন্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।