ঢাকা, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

প্লাস্টিক ব্যাগ আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি 

২০২৪ জুলাই ০২ ১৭:৩৩:২৮
প্লাস্টিক ব্যাগ আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


মানুষ আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং সার্বিকভাবে ভালো থাকতে কি না করছি আমরা। কিন্তু অনেক কিছু পেরে উঠলেও কোনোভাবেই যেন প্লাস্টিককে দূরে রাখতে পারছি না। প্লাস্টিকের ব্যাগ হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের সঙ্গী। বাজার করা, ময়লা ফেলা, শুকনো খাবার সংরক্ষণসহ নানান কাজে এসব প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে রোজ প্রতিটি বাড়িতে। কিন্তু ব্যবহারের পর যখন এসব ব্যাগ এখানে-সেখানে ফেলা হয় বা শহরের বাইরে উন্মুক্ত জায়গায় অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে এসব ব্যাগের স্তূপ জমা হয় বিপত্তিটা তখনই ঘটে।

প্লাস্টিকের ব্যাগ এককথায় পচনশীল নয়। পচে গেলেও সময় লাগে কয়েক শ বছর। ফলে এতে যেমন পরিবেশ দূষণ হয়, পাশাপাশি বাস্তুতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই পরিবেশবাদীদের দাবি, দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হওয়ার আগে যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হয়ে ওঠে।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, প্লাস্টিকের ব্যাগের বিকল্প এমন কী আছে, যা সহজলভ্য ও প্রতিদিন ব্যবহারের উপযোগী? সে ক্ষেত্রে চোখ রাখতে হবে টেকসই উপকরণের দিকে। কাপড়, কাগজ ও পাট দিয়ে তৈরি ব্যাগ বরাবরই পরিবেশবান্ধব। কাগজের ব্যাগ পচনশীল। এগুলো মাটিতে মিশে যায়। অন্যদিকে কাপড় ও পাট দিয়ে তৈরি ব্যাগ টেকসই; নিয়মিত পরিষ্কার করে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা সম্ভব।আর প্লাস্টিক কৃত্রিমভাবে তৈরি একটি পলিমার। এটি জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে রাসায়নিক উপায়ে তৈরি করা হয়। নমনীয় ক্ষয়রোধী, দীর্ঘস্থায়ী ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে সাগরের তলদেশ থেকে মাউন্ট এভারেস্ট পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বত্র, এমনকি মেরু অঞ্চলেও প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই পৃথিবীর মাটি, পানি, বায়ুমণ্ডল, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও মানব স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্লাস্টিক দূষণ।

বর্তমান পৃথিবীর মানুষের দৈনন্দিন জীবন প্লাস্টিক ছাড়া কল্পনাতীত। প্রায় সকল ধরনের মোড়ক ও বোতল প্লাস্টিকের তৈরি। ব্যবহৃত প্লাস্টিকের কিছু অংশ রিসাইকেল করা হলেও বেশিরভাগই বর্জ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৪৫ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ৪০০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে বিরাজ করে জীব ও প্রকৃতির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। উন্নত দেশে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক পরিবেশে কম ছড়িয়ে পড়ে। তবে চীনসহ এশিয়ার দেশগুলো বিশ্বের ৫১ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণকারী। প্লাস্টিক দূষণকারী শীর্ষ দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য (বিসফেনল-এ, ফথেলেটস, বিসফেনোন, অর্গানোটিনস, পার ও পলি ফ্লোরোঅ্যালকাইল এবং ব্রোমিনেটেড ফেইম রিটারডেন্টস ইত্যাদি) মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে নিঃসরণ করে।

ন্যানো ও মাইক্রো কণা হিসেবে এসব ক্ষতিকর পদার্থ খাদ্যচক্র ও পানির মাধ্যমে প্রাণী দেহে প্রবেশ করছে। মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিক কণায় থাকা এসব পদার্থ যেকোনো জীবের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার বিরূপ পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

প্লাস্টিক বর্জ্য মাইক্রো ও ন্যানো কণার ক্ষতিকর পদার্থ মানবদেহে থাকা হরমোনজনিত পরিবেশ পরিবর্তন করে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরি ব্যাহত করতে পারে। স্নায়ুকোষ ক্ষতিগ্রস্ত করে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের নানা রোগের কারণ হতে পারে। কোষের জীনগত পরিবর্তন করে ক্যানসারসহ আরও নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া, প্লাস্টিক পণ্যের সরাসরি সংস্পর্শে ত্বকের রোগ হতে পারে।

প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য ছাড়া আধুনিক জীবন অচল। এ জন্য প্লাস্টিক পণ্য নিষিদ্ধ করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ যৌক্তিক নয়। বহুল ব্যবহৃত প্লাস্টিকে তৈরি পলিথিন ব্যাগ দূষণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। পলিথিনের পরিবর্তে কাগজ, পাট বা প্রাকৃতিক তন্তুর তৈরি ব্যাগ ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে, প্রয়োজনে পলিথিনের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যেতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে কাপড়ের ব্যাগ, পাটের ব্যাগের ব্যবহারে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যেসব মালিকদের পলিথিন উৎপাদনের কারখানা রয়েছে তাদেরকে পাটের ব্যাগ তৈরির মেশিন ক্রয়ে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে তারা আগ্রহী হবেন। উৎপাদনের সাথে জড়িত শ্রমিকদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাটের ব্যাগ তৈরির জন্য প্রস্তুত করা না হলে তারা জীবিকার তাগিদে যেকোনো মূল্যে পলিথিন উৎপাদন করবেন। এ জন্য যত বিকল্প পথ আছে তারা সেটা করবে। কিন্তু কারখানা বন্ধ করতে হবে। নতুন করে কোন পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদনের জন্য অনুমতি দেয়া চলবে না।

দেশের সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পলিথিন আসতে না পারে সেটিও নজরদারিতে রাখতে হবে। কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙ্গা সহজলভ্য করার জন্য উদ্যোগ নেয়াসহ মনিটরিং টিম বাড়াতে হবে এবং অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। পলিথিন যেভাবে ভিন্ন ভিন সাইজ ও ডিজাইনের হয়ে থাকে তেমনি পাট ও কাগজের দ্বারা ছোট, মাঝারি, বড় সব রকমের ব্যাগ তৈরি করতে হবে। কাগজ ও পাটের ব্যাগের দাম সাধারণত পলিথিনের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। তাই প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও মানসম্মত ব্যাগ তৈরি করতে হবে। ফলে সাধারণ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে নিরুৎসাহী হবে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সারাদেশে ক্যাম্পেইন, মাইকিং, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করতে হবে। প্রতিটি মহল্লায় ছোট-বড় সব ধরনের দোকানে অভিযান পরিচালনাসহ শপিংমল থেকে ফুটপাথের অস্থায়ী দোকানসহ সর্বত্র যাদের কাছেই পলিথিন পাওয়া যাবে সকলকে জরিমানার আওতায় নিয়ে এলে হয়তো এর ব্যবহার কমবে।

সর্বোপরি, আমরা মনে করি আইন করা যথেষ্ট নয়, বাস্তবায়ন করাটাই হলো সফলতা।তাই এ মুহূর্তে পলিব্যাগ ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক তৈরির কারখানা বন্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা উৎপাদন বন্ধ না করে শুধু পলিব্যাগ জব্দ করে এর ব্যবহার কখনোই বন্ধ করা যাবে না। বর্তমান আইন সংশোধনের মাধ্যমে প্লাস্টিকজাত প্লেট, গ্লাস, কাপ, চামচ, স্ট্র ইত্যাদিও উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ সংযুক্ত করা এবং যে বাজারে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ও পলিথিন ব্যাগ পাওয়া যায় প্রয়োজনে সেই বাজার কমিটিকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক ও পলিথিনের নেতিবাচক প্রভাব সম্বন্ধে দেশের জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, চটের ব্যাগ এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য সরবরাহের নিশ্চিত করাও জরুরি। আর পরিবেশকে আমরা যতখানি দেব পরিবেশ ঠিক আমাদের ততখানিই ফেরত দেবে৷ তাই পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে সবাইকে তৎপর হতে হবে এবং ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য যত্রতত্র না ফেলে এগুলো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। আমাদের সবার এ বিষয়ে সচেতন হওয়া যে, আমরা যত দ্রুত প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার থেকে নিজেদের বিরত রাখব, তত দ্রুত প্লাস্টিক-দূষিত পরিবেশ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারব।তাই পরিবেশের ভালোর জন্য, পৃথিবীর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি ব্যাগ ব্যবহার কেন নয়! এই বার্তাই ঘটা করে জানানোর জন্য ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর ৩ জুলাই আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক ব্যাগ মুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে পুরো বিশ্বে।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।