ঢাকা, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

কোটা সংস্কার আন্দোলন, স্বঘোষিত রাজাকার এবং...

২০২৪ জুলাই ১৭ ১৯:৪৭:৩৫
কোটা সংস্কার আন্দোলন, স্বঘোষিত রাজাকার এবং...

রহিম আব্দুর রহিম


দেশে কোটা বিরোধী আন্দোলন ঘিরে দুটি বাক্যে দেশের তরতাজা ৭টি প্রাণ শেষ হয়েছে। ঐতিহাসিক এই বাক্য দুটির একটি 'মুক্তিযোদ্ধার নাতি পুতিরা পাবে নাতো, রাজাকারের নাতি পুতিরা পাবে?' অন্যটি 'আমি রাজাকার,' উচ্চারিত বাক্য দুটি ইতিহাসের অম্লান বাণী হিসেবে অথবা কলঙ্কের গালি হিসেবে স্বাধীন দেশে জনশ্রুতি হয়ে ভাসবে। বাক্য দু'টির প্রথমটি উচ্চারণ করেছেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সম্প্রতি গণভবনে চীন সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে করেছেন, ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, 'মেধা ও কোটার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কোটা থেকে যারা নিয়োগ পান, তাঁরাও মেধাবী, তাঁরাও প্রিলিমিনারি, লেখিত এবং ভাইবা পাস করে আসে। তারপর যখন সমান নম্বর প্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং একজন সাধারণ পক্ষার্থী থাকেন, এক্ষেত্রে...' এটা বলার সাথে সাথে তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধার নাতি পুতিরা চাকুরি পাবে না তো রাজাকারের নাতি পুতিরা চাকুরি পাবে?'

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এটাকে ধরে নিলেন তাদেরকে রাজাকার বলা হয়েছে। আবেগ, ক্ষোভ, দুঃখে তারা শ্লোগান দেওয়া শুরু করলেন 'আমি কে, তুমি কে, রাজাকার রাজাকার। ধরে নিলাম আন্দোলনকারীরা বুঝে কিংবা না বুঝে অথবা কোন দল গোষ্ঠীর উস্কানিমূলক ইন্দনে প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারিত এই বাক্যটির সাধারণ ব্যাখ্যাকে অসাধারণ করে, তাঁরা স্বঘোষিত রাজাকার হবার মত শব্দ উচ্চারণ করেছেন। তার অর্থ এই নয় যে, কেউ যদি ঘোষণা করেন 'আমি মুক্তিযোদ্ধা' তবে কি সে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাবেন? যদি তা সম্ভব না হয়, তবে 'আমি রাজাকার' বললেই তাকে রাজাকার তকমা দিয়ে কোন বুদ্ধিজীবির ঘৃণা বার্তাও এক প্রকার উস্কানীর শামিল বলে আমি মনে করি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সমালোচকদের ভালবাসতেন, পছন্দ করতেন, তাদের উৎসাহিত করতেন তাঁর যেনো সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন। তাঁর এই সরলতায় সমালোচনা এক পর্যায় অপপ্রচারে রূপ নেয়। আমি বুদ্ধিজীবি হলে, আমার কথা প্রধানমন্ত্রী কিংবা দেশ জাতির গুরুত্বপূর্ণ মহল গ্রহণ করলে আমি বলতাম'৷ রাজাকার হলো ব্যুৎউৎপত্তিগত একটি আরবী শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হলো সেচ্ছাসেবী। এটি উর্দু ভাষা থেকে ধার করা শব্দ, যা আরবী ভাষায় জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশে 'রাজাকার' একটি অপমানজনক শব্দ, যার অর্থ বিশ্বাসঘাতক বা প্রতারক।' রাজাকার শব্দটি স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি আমরা গালি হিসেবে ব্যবহার করি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসলে না বুঝে শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক না, ওরা ছাত্র মানুষ, ওরা যেমন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সারাংশ উদ্ধার করেনি, তেমনি আমাদের চিরায়ত গালিটির গভীরে তারা পৌঁছানি, অথবা আন্দোলন তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য শব্দটি ভেতর-বাইর খতিয়ে দেখার সময় পায়নি। এই নিয়ে ঠেলাঠেলি, ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি ঠিক না। কোটা বিষয়ক সমস্যা সমাধানে সরকার নিজেই আপিল করেছেন, তোমরা অপেক্ষা করো,যার যৌক্তিক সমাধান এই সরকারই করবেন। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করতাম, কোটা বিষয়ক সকল সমস্যা যতদ্রুত সমাধান করার ব্যবস্থা করুন। কিন্তু এই বুদ্ধিজীবিরা, অতি উৎসাহী ও দলকানাদের মাঝে ঘৃণাবার্তা, উস্কানি ছড়ালো।

অন্যদিকে সরকারি বিরোধী গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাধারণ ছাত্রদের বলির পাঠা বানালো। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমি শুনেছি, তিনি যা বলেছেন তা থেকে পৃথিবীর কোন ভাষা বিশ্লেষক বলতে পারবেন না, তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেছেন। বরং তিনি তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন, ‘কোটা বিষয়ক সমস্যাটি 'আদালতে বিচারাধীন, এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা ঠিক হবে না। আদালত থেকে রায় আসুক, তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সব মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অনগ্রসর জেলাসহ অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য সুযোগ করে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।' প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য কেনো দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরলেন না, তাদের বুঝাতে পারলেন না? আন্দোলনের প্রথমদিকে ছাত্রলীগের অবস্থান, বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য ছিল। তাঁরাও কেনো বিভিন্নভাবে আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বের করলেন না। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের যেদিন বললেন, 'ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রলীগ দেখবে।'

তার পরের দিনই শুরু হলো জয় পরাজয়ের সংগ্রাম। যারা মারা গেছেন তারা কোন দল বা গোষ্ঠীর এই হিসাব করা বিবেকবানদের নয়, তারা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব এটাই সত্য। আমরা আর কোন মায়ের বুক খালি হোক, এটা দেখতে চায় না। আমরা স্বাধীন দেশে শান্তিতে ঘুমাতে চাই, মরে যেনো শান্তি পাই। আমরা চাই কোটার যৌক্তিক সংস্কার, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও আন্দোলনে নিহতদের পরিবার পরিজনদের আমৃত্যু রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা।

লেখক: নাট্যকার ও কলামিস্ট।