প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
ব্যাংক বাঁচাতে অবশেষে ব্যাংক কমিশন
২০২৪ আগস্ট ৩০ ১৭:০১:১৭চৌধুরী আবদুল হান্নান
দেশের অর্থনীতি এবং ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে যারা ভাবেন, তাদের অনেকেরই জরুরি দাবি ছিল ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাংক কমিশন গঠন করা। যে কাজটি বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারতো, সে কাজটি এখন করবে আলাদা একটি সংস্থা।
ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি নিজেই দুর্দশাগ্রস্ত, স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতাই কেবল হারায়নি, ঋণ জালিয়াতি আর অর্থ পাচারকারীদের সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে।
তবে আশার কথা যে, নতুন গভর্নর অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রীয় কোষাগার বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সংস্কার শুরু হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা দীর্ঘদিনের জন্জাল, আবর্জনা দূর করে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ব্যাংককে সক্ষম করে তুলবেন আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞ বর্তমান গভর্নর।
ব্যাংক কমিশন নিয়ে নানান প্রশ্ন সামনে আসবে, কীভাবে গঠিত হবে, কারা সদস্য হবেন, কার কাছে জবাবদিহি করবে ইত্যাদি। আমাদের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ কর্ম অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁর দিক নির্দেশনায় যা হবে তা ভালোই হবে।
ব্যংক ও আর্থিক খাতের সংস্কারের কাজ যারাই করুক, বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংক কমিশন, আমার একটি পরামর্শ আছে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে আমার এ পরামর্শ এবং তা হলো সৎ ও সাহসী কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে।
সৎ ও সাহসী লোক কোথায় পাওয়া যাবে?
অতীতে ঘটে যাওয়া সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কান্ড, বেসিক ব্যাংকের বাচ্চু কাহিনী, জনতা ও প্রাইম ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ লোপাটের মতো নানান বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারীর ঘটনা আমাদের মনে আছে।
বিধি-বহির্ভূত এবং অপরাধমূলক এসকল কর্মকান্ডে ব্যাংকের শাখা পর্যায়ে সকলেই জড়িত থাকেন না, অনেকেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন এবং তারা বড় কর্তার ক্ষোভের মুখে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
এভাবে যারা দায়িত্ব পালনকালে অনৈতিক কাজের সহযোগিতা না করে প্রতিবাদ করেছেন এবং বড় কর্তার বিরাগভাজন হয়ে দূর দূরান্তে বদলিসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের খুঁজে বের করে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সৎ ও মেধাবীরা নীরবে কাজ করেন, সুবিধা পাওয়ার জন্য কাউকে তোষামোদ করেন না। তাদের সুরক্ষা দিলে অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাংকের ভিতরেই একটি প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পাবে। রোগের ঔষধ তো কাছেই আছে, দূরে যাওয়ার দরকার কি?
ব্যাংক কমিশন গঠনের নীতিমালায় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ব্যাংক খাত যেন দ্বৈত শাসনের কবলে না পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি বলেছেন, ব্যাংকিং কমিশন গঠন করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সেখানে অন্তর্ভূক্ত থাকবে।
ব্যাংক কমিশন কী কাজ করবে?
তারা ব্যাংক ব্যবস্হার বর্তমান দুর্বলতা বা সমস্যা চিহ্নিত করবেন এবং সেগুলো দূর করার জন্য পরামর্শ দেবেন, ব্যাংকে গিয়ে হাতে কলমে কাজ করবেন না। তাদের পরামর্শ মতো সংস্কারের কাজগুলো শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরই করতে হবে। পৃথিবীতে পরামর্শ দেওয়ার মতো সহজ কাজ আর কিছু নেই, সকলেই পরামর্শ দেয়। কিন্ত পরামর্শ কার্যকর করা মোটেই সহজ কাজ নয়।
আর পরামর্শের জন্য তো দূরে যাওয়ার দরকার হয় না, প্রতিদিনের পত্রিকায় ব্যাংকিং নিয়ে নানা সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যাংক ব্যবস্হায় কী কী সংস্কার করতে হবে তা বহুল আলোচিত। কাজ করতে চাইলে ব্যাংকাররা সংস্কারের কাজ শুরু করতে পারেন। সময় ক্ষেপণ করার কারণ দেখি না।
“ট্রায়াল এ্যান্ড ইরোর” করে করে তো সময় কম অতিবাহিত হয়নি। আসলে আমরা কাজ করতে চাই না, কেবল সুবিধা আদায়ের পিছনে দৌঁড়াতে পছন্দ করি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এসে প্রথমেই সঠিক জায়গায় হাত দিয়েছেন, দ্রুততম সময়ে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছেন।
ওই সকল ব্যাংকের পরিচালকরা আইন-বিধির তোয়াক্কা না করে নিজ ব্যাংক থেকে বা যোগসাজসের মাধ্যমে অন্যের ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন এবং এর বড় অংশ বিদেশে পাচার করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
বিতর্কিত পরিচালকদের বাদ দিয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির পরিচালকদের দ্বারা নতুন পর্ষদ গঠন করা ব্যাংক খাতে একটি বড় সংস্কার হিসেবে মনে করা যায়।
ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনসহ এজাতীয় পদক্ষেপ চলমান থাকলে আতঙ্কগ্রস্ত আমানতকারীদের মনে ধীরে ধীরে আস্থা ফিরে আসবে।
দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় আর ব্যাংক পরিচালক নিয়োগ নয়, এক্ষেত্রে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকারদের অগ্রাধীকার দিতে হবে, কারণ ব্যাংকাররাই তো ব্যাংক ভালো বোঝেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংক কমিশন যৌথভাবে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনীতির হৃদপিন্ড ব্যাংক ও আর্থিক খাতের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম হবে, এ প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।