ঢাকা, বুধবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ভৌতিক রাজনীতি আবির্ভাব করা হচ্ছে?

২০২৪ আগস্ট ৩০ ১৭:২৩:০২
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ভৌতিক রাজনীতি আবির্ভাব করা হচ্ছে?

মারুফ হাসান ভূঞা


শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি মুক্ত, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ এই শব্দগুলোর ব্যবহার স্বৈরাচারী মননের প্রকাশ। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো রাজনীতিকে একভাবে বা একপাক্ষিক ভাবে বিচারের কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করা। এই পরিবেশ তৈরির প্রক্রিয়া হচ্ছে ভৌতিক অপরাজনৈতিক প্রক্রিয়া।

ভৌতিক এই অপরাজনীতির চর্চা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ সময় দরে দৃশ্যমান হতে দেখা গেছে। এই রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্ধতার বেড়াজালে অরাজকতা, অপরাজনীতি ও সন্ত্রাসের চর্চা। যা আমরা অতীত দিনে দেখেছি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জবরদস্তি কিংবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে অন্ধতার দিকে প্রভাবিত করে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। মূল্যবোধের চর্চা, বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা মানুষকে মানবিক ও গণতান্ত্রিক চিন্তায় প্রসারিত করে। কিন্তু ভৌতিক রাজনীতির চর্চা সেসবে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এরা উৎপাদন করে সন্ত্রাসবাদ ও অন্ধত্বের ভাবনা। যে ভাবনা মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষকে আগ্রাসী ও ফ্যাসিস্ট মনন তৈরির দিকে অগ্রগামী করে তোলে। যার ফলে ভিন্নমত কিংবা মত প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে আগ্রাসী মনন সংঘাতে যুক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হলে সন্ত্রাসের বিকাশ ঘটে।

এই ভৌতিক রাজনীতির চর্চা সবচেয়ে বেশি হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। যার ফলে ভৌতিক কিংবা গুপ্ত রাজনীতির চর্চা খুবই সহজতর। অতীত দিনে আমাদের দেশে সংগঠিত হওয়া সমস্ত জঙ্গি হামলা, হোলি আর্টিজান, উদীচীর সমাবেশে হামলা, ব্লগার হত্যা, ও বাংলা বর্ষবরণ হামলাসহ আরো বেশ কিছু হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদের একটি অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সুতরাং এই বিষয়টি পরিষ্কার ভাবে স্পষ্ট একদিকে দখলদারিত্বের ছাত্র রাজনীতি অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে সন্ত্রাসবাদের ছাত্র রাজনীতি শিক্ষালয়ে বিরাজ করে। রাষ্ট্র এইসব অপরাজনীতি ও ভৌতিক রাজনীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়, মূলধারার ছাত্র রাজনীতি যে ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের অধিকারের কথা বলে, শিক্ষার দুর্বলতা, রাষ্ট্রের দুর্বলতা, সন্ত্রাস ও দখলদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। দুর্নীতি, লুটপাট ও ঘোষের বিরুদ্ধে আওয়াজ প্রতিবাদ করে। গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞান ভিত্তিক চর্চায় যুক্ত সে সব ছাত্র রাজনীতিকে বন্ধ করার অপচেষ্টা করে।

আমরা দেখেছি বিগত দিনে ছাত্র-জনতার যে গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে হয়েছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সে আন্দোলনের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ শব্দের জোরালো ব্যবহার হয়। যা আমরা নিকট অতীতে বুয়েটের ঘটনাতেও সেটি দেখেছি। তখন সেটি যৌক্তিক ছিল। কারণ তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবৈধ শাসন পরিচালনা করছিল। যার ফলে অন্যায়ভাবে প্রশাসন, সন্ত্রাসী দ্বারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন করেছে। ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ শব্দের ব্যবহার যেমন কিছুটা পরিমাণে যৌক্তিক ছিল। ঠিক তেমনি অন্যান্য ক্রিয়াশীল সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক লড়াই, সংগ্রাম ওই মুহূর্তে বিশেষভাবে প্রশংসনীয় ও শ্রেষ্ঠ লড়াই ছিল। তাদের সে লড়াই থাকার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, আন্দোলন হিসেবে আবির্ভাব করতে সক্ষম হয়েছিল। পাশাপাশি এই আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে প্রবেশ করানোর যে প্রক্রিয়া সেটির পেছনেও ছাত্র রাজনীতি ও ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর অবদান অবিস্মরণীয়। সেটি হোক ভাষা দিয়ে, সরাসরি অংশগ্রহণ কিংবা বিভিন্ন রকম উপাদান দিয়ে আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে উপস্থাপন করা।

কিন্তু এই সময়ে ভৌতিক ও অপরাজনীতি নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে শিক্ষার্থীদের মাঝে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ। এর মধ্যেই আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশের নানা স্থানে দৃশ্যমান হতে দেখেছি নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠন সমূহের অবাধ প্রচার প্রচারণা এবং অবস্থান। পাশাপাশি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী জঙ্গি তৎপরতার সাথে জড়িত আটক সন্ত্রাসীদের অবাধে মুক্তি দেওয়ার দৃশ্য। যা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশে উৎসাহিত করছে। এটি কোনো প্রকার সম্ভাবনার সন্দেহ নয়, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রাথমিক তৎপরতার দৃশ্য।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চাই, শব্দটির উচ্চারণ বিশেষ ভাবে রমরমা করে উঠেছে, সে শব্দটি ব্যবহারের পেছনে মদদদাতা হচ্ছে ভৌতিক ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি ছায়া। বাংলাদেশ নামের সাথে ছাত্র রাজনীতি প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানসহ ২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামের সাথে ছাত্র রাজনীতি যুক্ত। এই দেশে দেশ হিসেবে রচিত হয়েছে ছাত্র রাজনীতির আবিষ্কারের ফলে। দেশের সমস্ত ভৌতিক ও সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি পাশাপাশি অপরাজনীতি, স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্টদের উৎপাত যতবারই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এই বাংলায়। ঠিক ততবার ছাত্ররাজনীতির ক্রিয়াশীল চর্চার প্রভাবে বিতাড়িত হতে বাধ্য হয়েছে।

পৃথিবীর সমস্ত কিছু রাজনীতির অংশ রাজনীতি বিহীন পৃথিবী অতিক্রম করা কখনো সম্ভব নয়। অরাজনৈতিক শব্দটাই রাজনৈতিক। অর্থাৎ রাজনীতি দৈনন্দিন জীবনের চালিকা শক্তি, আমাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালিত হয় রাজনৈতিক ভাবে। সেটি অনুধাবন না করতে পারা স্বাভাবিক। কিন্তু সে স্বাভাবিকতা অপরাজনীতির পরিকল্পিত ব্যবস্থা। রাজনীতি বুঝতে না দেওয়াটাও রাজনীতির অংশ। সুতরাং অনুধাবন করুন, ভাবুন! ভাবুন! এবং প্রশ্ন করুন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।