প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত
ভারতের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান জরুরি
২০২৪ অক্টোবর ০৩ ১৭:২৯:২৭চৌধুরী আবদুল হান্নান
ভারতের সাথে আমাদের পুরাতন বন্ধুত্বের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কিন্ত গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর চলমান পারস্পরিক সুসম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হয়েছে। উভয় দেশের উৎসাহী নাগরিকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তিক্ত কথাবার্তা দুই দেশের সম্পর্ক আরও বিষিয়ে তুলছে। এক সময় ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে ভারত- বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কোনো কোনো দল রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ারও চেষ্টা করেছে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বলেন- “তাদের বোঝা উচিত, আমাদের সেনাবাহিনী যে ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের জনগণ যে সহায়তা দিয়েছে তা ভুলে যাওয়া উচিত না।” (সমকাল ২৯/০৯/২৪) অবশ্য দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হলে এমন মন্তব্য মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক রেখে কেউ লাভবান হবে না এবং বাংলাদেশ-ভারতের ভালো সম্পর্ক ছাড়া গত্যন্তর নেই। জার্মানির একটি সংবাদ মাধ্যমকে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বন্ধুত্ব হয়, লাভ ক্ষতি হিসাব করেই, এক তরফা সম্পর্ক হয় না। কোনো দেশই নিজ দেশের সুবিধা খর্ব করে অন্য দেশকে কোনো সুবিধা দেয় না। দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে হয়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের কোলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু আমাদের দেশের রোগীদের প্রথম পছন্দ, হৃদরোগে আক্রান্ত মরণপথ যাত্রী রোগীর শেষ ভরসা ভারতীয় কার্ডিয়াক সার্জন দেবী শেঠি, যার কথাতেই রোগী তাৎক্ষণিক অনেকটাই সুস্থ হয়ে যায়।
একজন আক্ষেপ করে বলছিলেন, দার্জিলিং শহরে গিয়ে প্রথম সূর্যোদয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় আর দেখা আর হলো না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলাও দেখা হবে না।
অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে ছোট দেশ বাংলাদেশের কাছেও ভারতের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। তাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পর্যটন খাতে বাংলাদেশের অবদান কম নয়। ভারতের বিভিন্ন শহরে কেনাকাটার জন্য এ দেশের মানুষের বড় আকর্ষণ।
উভয় দেশের প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ-ভারতের ভালো সম্পর্ক ছাড়া গত্যন্তর নেই, এমনটিই বলেছেন প্রধান উপদেষেটা।
ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জন্মকালীন বন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অবদান শ্রদ্ধার সাথে চিরকাল স্মরণে রাখবে বাঙালি জাতি।
বাকস্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে অনেক অনভিজ্ঞ ব্যাক্তিদের দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে নানা অযাচিত কথাবার্তা বলতে দেখা যায়।রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে গেলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে, পানি সমস্যা নিয়ে মতামত দিতে পারেন কেবল নদী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতের মতো লোকেরাই।
দুই দেশের পানি সমস্যা নিয়ে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথা বলেন অনেকে, কথাটা বলা সহজ কিন্ত এভাবে সমাধান মোটেই সহজ নয়।
প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রেখা দিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার দেশ ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ, সবদিক থেকেই দেশটি অধিকতর শক্তিশালী। উভয় দেশের চোরাকারবারী, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সার্বক্ষণিক অপতৎপরতা লেগেই থাকে। দুইটি বৈরী দেশের ক্ষেত্রে সীমান্ত পাহারার কাজটি অনেক কঠিন এবং ব্যয়বহুল। সেক্ষেত্রে উভয় দেশের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয়।
পরস্পর সুসম্পর্কই দিতে পারে উভয় দেশের ন্যায্য প্রাপ্তির অঙ্গীকার। বিগত সরকারের নতশির পররাষ্ট্রনীতির কারণে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, অনেক মন্ত্রীর ভারত-তোষণ এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে, সেটা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য মর্যাদাহানীকর।
পৃথিবীতে কোনো দেশ একা চলতে পারে না, দ্বি-পাক্ষিক বা বহু-পাক্ষিক সম্পর্ক রক্ষা করার দরকার হয়; দেশের সম্মান ও স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজন বিচক্ষণ কূটনৈতিক তৎপরতা।
দুইটি দেশের মধ্যে পানি সমস্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যতটা না বাস্তবভিত্তিক, তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক। বড় বড় বন্যার সাথে বাংলাদেশের মানুষ পরিচিত, বন্যায় কৃষকের ফসল পানিতে ডুবে গেলে উজানের দেশ ভারতকে দায়ী করে বলা হয়, ওরা ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়েছে। খরায় ফসল নষ্ট হলে আবার সেই একই রাজনীতি এবং এর ফলে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে স্থায়ী ভারত-বিদ্বেষ জন্ম নেয়।
বাংলাদেশে বন্যা সমস্যা কতটা প্রাকৃতিক আর কতটা মানবসৃষ্ট বা রাজনৈতিক তা বুঝে কথা বলতে হবে।
বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারকারী ভারতের সাথে আমাদের বহুমাত্রিক গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান, অর্থনীতির সর্বত্র এর ব্যাপ্তি।মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, জীবনের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে দুই দেশের সম্পর্কের ছোঁয়া পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন, সহজে আমদানি করা যায় এবং পরিবহন ব্যয় কম হয় বলেই দূরবর্তী দেশের পরিবর্তে নিকটতম দেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বড় বড় চ্যালেন্জ, সব কাঠামো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে যা সংস্কারের মাধ্যমে সচল করতে হবে। দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে উভয় দেশকেই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ইতিবাচক ভাবনা এবং কর্মকান্ড দুই দেশের মানুষকে এক সময় আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানির অনুমোদন এক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলতেই হবে। ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিষয়ে তীব্র বিরোধীতার মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের এটি একটি বড় সাহসিকতার পরিচয়। অনেকেই মনে করেন দুর্গাপূজায় ভারতে ইলিশ পাঠিয়ে বড় মনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
নানা বিপরীতমুখি চাপ, বহু বিতর্কের মধ্যেও যারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, তাদের জয় হয়।
দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক রেখে কেউ লাভবান হবে না, সকলের স্বার্থে বন্ধুত্বের শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের এক সাথে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যেতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।