ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

বাঙালির ফুটবল-সাফল্য এখন কেবলই স্মৃতি

২০১৫ নভেম্বর ১৭ ২১:৪৯:২০
বাঙালির ফুটবল-সাফল্য এখন কেবলই স্মৃতি

মাহবুব আরিফ

রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ফুটবলারদের যথাযোগ্য সন্মান দেবার প্রয়োজন আছে কি ? তাদের কাছ থেকে সরকারী (বা ফু ফে) যে ভাতাটুকুও ছিল তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে , খেলাধুলার ইতিহাসে কি এই সব মানুষদের কি কোনই অবদান নেই ? ক্রীড়া জগতে যাদের অবদান এ দেশের ইতিহাস হয়ে আছে, যাদের নাম কেউ কোনদিনই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারবে না, তাদেরই একজন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত জনাব ফজলুর রহমান আরজু |

ক্রীড়া জগতে ৫০ ও ৬০ এর দশকে যেসব রত্ন আমাদের উপমহাদেশে খেলাধুলায় তাদের নৈপুণ্যতায় কোটি কোটি মানুষকে আনন্দ দিয়েছিলো | বাংলাদেশ কি তাঁদের ভুলে গেছে ? তাদের খবর নিতে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কি কোনই দায়িত্ব ও ভূমিকা নাই ? যে সব সংগঠকদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর তাদের ঘামে আজকের ক্রীড়া জগত সমৃদ্ধ তারা কি একদিন পৃথিবীর এক কোনায় হুট করে মরে যাবে, কেউ কি তাদের খবর নেবে না ??

বন্ধুরা , আমি শুধু মাত্র একটি সত্যকে তোমাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, তোমাদের সবার প্রচেষ্টা থাকলে বাংলাদেশের এইসব অসামান্য প্রতিভাবান মানুষদের আমরা অবশ্হই সন্মান জানাতে পারবো, বা ফু ফে থেকে তাদের প্রাপ্য যে ভাতাটুকুও ছিল তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে, আমরা বাঙ্গালীরা কতটা অসহায় | আমার অন্তরের একটি আশা, মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর টেবিলে আমার এই লেখাটি পৌছে যাবে | পাকিস্তানি মাকরানি খেলোয়াড়দের দাপটে যে কজন বাঙালি খেলোয়াড় ঢাকার মাঠে দাপটের সাথে রাজত্ব করেছেন তাদের মাঝে আমার বাবার নাম তাদের ভুলে যাবার কথা নয়। পাকিস্তানের ২৪ বছরে মাত্র ২৪ জন বাঙালি ফুটবলার পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেছেন। তাঁরা হলেন: সাহেব আলী, তারাপদ, নবী চৌধুরী, ফজলুর রহমান আরজু, আব্দুর রহীম, তাজুল ইসলাম মান্না, এম. ওয়াজেদ আলী মিয়াজি, মারী, আশরাফ চৌধুরী, কবীর, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, গজনবী, আবুল খায়ের, সেকেন্দার আলী, জহিরুল হক, দেবনাথ, বলাই দে, প্রতাপ শংকর হাজরা, হাফিজউদ্দিন আহমদ, গোলাম সারওয়ার টিপু, শহীদুর রহমান চৌধুরী শান্টু, জাকারিয়া পিন্টু, কাজী মাহমুদ হাসান ও মোঃ. নুরুন্নবী। ফুটবলের জগতের এইসব রত্নদের কি সরকার একটি বারের জন্যও স্মরণ করেছে ? পাক ভারত উপমহাদেশে ফুটবলের এইসব রত্নদের আমরা কতটুকু সম্মান জানাতে পেরেছি ? "উপমহাদেশে ফুটবলের পরিচিতি আর বিস্তার ঘটে ইংরেজ সেনা, বণিক, সিভিল সার্ভেন্ট ও শিক্ষাবিদদের কল্যাণে। তবে বিদেশি এ খেলাকে দেশি বানিয়েছে বাঙালি। তৈরি হয়েছে নাড়ির সম্পর্ক। একটা সময় এমন পুরুষ বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার ছিল, যিনি জীবনে একবারও ফুটবলে লাথি মারেননি।গবেষণায় লক্ষণীয়, কৌতূহল প্রিয়, স্বভাবগতভাবে আবেগপ্রবণ এবং হুজুগে বাঙালি কোনও রকম সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ছাড়া নেহাতই ভালো লাগা এবং অবসরের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে প্রথমে ফুটবলকে গ্রহণ করেছে, ভালবেসেছে এবং উৎসাহ দেখিয়েছে। একসময় তারা ফুটবলের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে আস্থা, আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা, জাতিগত ঐক্য, স্বাতন্ত্র্য, জড়তা ভঙ্গের উপাদান, আত্মপরিচয় এবং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার ইঙ্গিত।" স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বাংলাদেশের একটি ফুটবল দল ঢাকা আবাহনী ক্লাবের ইতিহাস আপনাদের সবারই জানা , জনাব হারুন, গোলাম সরওয়ার টিপু ও কাজী সালাহউদ্দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল ছিল এই আবাহনী ক্লাব আর শেখ কামাল ছিলেন এই ক্লাবের জন্মদাতা, সে সময় আমার বাবাকে দেখেছি প্রাক্তন সচিব রশিদ সাহেবের ও অনেককে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ড ঢেলে সাজানোর জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন বাবার সহযোগিতায় আমার মনে আছে জাকারিয়া পিন্টু , মান্না সাহেব, সাহেব আলী তাহাদের ভূমিকাও ছিল অসামান্য। আজো এসব স্মৃতি মনের কনে ভেসে বেড়ায়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সে সময় ফুটবলকে সার্থক ভাবেই সাজাতে পেরেছিল, আর সে কারণেই ফুটবল হয়ে উঠে বাংলাদেশের একমাত্র জনপ্রিয় খেলা, ফুটবলে জন্ম নিতে থাকে অসাধারণ সব তারকা। ১৯৭৫ সাল ১৫ই আগস্ট জাতি তার সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হারিয়ে খেলাধুলার জগতেও নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা, রাজনীতি, দুর্নীতিতে আস্তে আস্তে ধস নামতে থাকে বাংলাদেশের খেলাধুলায়, ক্লাব পলিটিক্স থেকেই শুরু হয় দুর্নীতি, তখন বিভিন্ন ক্লাবগুলোতে খেলাধুলা প্রেমিকদের চাইতে ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটতে থাকে আর তারাই হয়ে উঠেন ক্লাবগুলোর কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীদের একটাই কারণ ক্লাব গুলোতে অংশ গ্রহণ করার তা হচ্ছে কোনো ব্যবসায়ী যদি তাদের উপার্জনের থেকে কিছু টাকা ক্লাবগুলোতে দান করেন, তবে সেই টাকার পরিমাণ অথবা আংশিক কর মৌকুফ করে নিতে পারেন , এই সুযোগে ১০ লক্ষ টাকা দান করে ২০ লক্ষ টাকার রশিদ গ্রহণ করার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়ে প্রথম বিভাগের সব ক্লাব গুলোতেই দারুণ রকম দুর্নীতি ঢুকে পরে, ওপর দিকে ক্লাব কোচদের মাঝে অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরেন, একজন খেলোয়াড় যদি ৪০ হাজার টাকাতে কোনও ক্লাবের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় ২০ হাজার টাকাই গোপনে কোচের পকেটে চলে যেতো , তাই খুব সহজেই একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে সারাটা বছর সাইড লাইনে বসে থাকতে হতো। ক্লাবের রেগুলার টিমে এরকম অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুব সহজেই বাদ পরে যেতো, আর তাতেই দিন দিন দিন ফুটবলের মান যাচ্ছে তাই জগতের দিকে ধাবিত হতে থাকে, ঢাকার ফুটবল ৮০ দশকের মাঝা মাঝি সময়ে তার মান সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে ফেলে, ফুটবল তার জৌলুস হারিয়ে নির্জীব হয়ে পরে। তারপর সমস্যা ছিল আরও , দুর্নীতিবাজ ক্লাব কর্মকর্তাদের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে অনেক অযোগ্য খেলোয়াড়কেও ক্লাবের রেগুলার টিমে সুযোগ করে দেয়ার প্রবণতাও কোচদের মাঝে লক্ষ্য করা যেতো। আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না এগুলো আমার স্বচক্ষে দেখা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকেই লিখছি। আমার বাবাকেও দেখেছি খুব অসহায় চিত্তে এসব অবলোকন করতে। আমিও তখন ফুটবলের পাগল, অনেক বড় বড় তারকাদের খেলা দেখেই শুধু মুগ্ধই হতাম না বরং তাদের স্বপ্ন দেখতাম । অনেকের খেলা আজ আমার চোখে বেশে বেড়ায় , বাঁটু, আশরাফ, বাদশা, রাকিব, অমলেশ, সালাউদ্দিন, টুটুল, চুন্নু, ছোট নাজির, নাউশের, বড় নাজির, রামা লুসাই, শরীফ, মহসীন, সেলিম, বাবুল, নান্নু, মঞ্জু , মুকুল, লোভন, কাওসার, আশীষ ভদ্র এ রকম আরও তারকাদের মিছিলে ঢাকা স্টেডিয়াম মুখরিত ছিল। আমি তখন সবে মাত্র ঢাকার খেলাধুলার জগতে প্রবেশ করেছি কি করছিনা এরকম একটা অবস্থায়, আর ঠিক সেই সময়েই শুরু হয় খেলাধুলার মানের ধস, আমার আজ মনে পরে , সালটা হয়তো ১৯৮০ সনেই হবে , জাতীয় যুব দলের বাছাই প্রতিযোগিতায় আমাকে শেষ মুহূর্তে জাতীয় যুব দল থেকে বাদ দেয়া হয়, কারণটা ব্যাখ্যা আমাকে এ ভাবেই দেয়া হয়েছিল যে যোগ্যতা থাকলেও ঢাকার মাঠে আমার খেলার অভিজ্ঞতা খুবই কম যদিও সে বছর আমি অনূর্ধ্ব ২০ যুব দলের অধিনায়ক হয়ে সমগ্র জেলাতেই খেলে বেশ সুনাম অর্জন করেও জাতীয় যুব দল থেকে বাদ পরি , আমার বাবার কাঁধে মাথা রেখেই প্রতিজ্ঞা করি, এ দেশে আমি ফুটবলের ইতি টানছি, আমি সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম অনেকেই চাইতো না ছেলেও বাবার মত বড় হবে। ফেডারেশনের বড় বড় কর্মকর্তারা তাদের ক্লাবের নিজস্ব খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে দুর্নীতির মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেবার প্রবণতা বেশ লক্ষনীয় ছিল। ফুটবলের কোচদের মাঝেও দুর্নীতির প্রভাব লক্ষ্য করেছিলাম, একজন খেলোওয়ারের যোগ্যতা না থাকলেও টাকার বিনিময়ে একজন যোগ্য খেলোওয়ারকে মাঠের বাহিরে বসিয়ে রেখে অযোগ্য খেলোওয়ারকে খেলতে সুযোগ করে দেয়া হতো, অযোগ্য খেলোওয়ারের কন্ট্রাক্টের টাকার একটি অংশ কোচদের পকেটে চলে যেতো, এ সব কিছুই গল্পের মত শোনালেও, এ গুলো ছিল আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা | বিভিন্ন ক্লাবে খেলার সুবাদে আমি নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে এইসব লিখতে বাধ্য হচ্ছি | আমি ৮০ দশকের ফুটবল ও তার ধসের একটা চিত্র আপনাদের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার বাবার ক্রীড়া নৈপুণ্যের কথা শুনেছি ১৯৪৯ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন ইপি জিমখানা দলের হয়ে শিরোপা জয়ের পেছনে বাবার একক নৈপুণ্যের অবদান ছিল বেশি। ১৯৫১ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় ঐতিহ্যবাহী ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, যতদূর শুনেছি বাবার মুখে, আমার বাবা ফজলুর রহমান আরজু তখন ওই ক্লাবের খেলোয়াড় । ১৯৫২ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় বিজি প্রেস। ১৯৫২ সালেই পাকিস্তানের জাতীয় ফুটবলের আসর বসে ঢাকায়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ফুটবল সে সময় ব্যাপক সাড়া জাগায়। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত যারাই আমার বাবার খেলা দেখেছেন তাদের মুখে শুনেছি আমার বাবা ছিলেন একজন অপ্রতিভে-দ্য ফুটবলার, বল নিয়ে তার ছুটে চলার গতিকে আটকে দেবার মত তখনকার দিনে ঢাকার মাঠে কাউকে দেখা যায়নি। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার লীগ শিরোপা ছিল ওয়াল্ডারার্স ক্লাবের দখলে, আর ওই সময়টার ফুটবলের মাঠে রাজত্ব করে বেড়িয়েছেন, আরজু। ১৯৫৭ সালে প্রথমবারের মতো লীগ শিরোপা লাভ করে মোহামেডান। এর পর থেকে এই দলটি বছরের পর বছর ধরে দাপটের সঙ্গে ফুটবল খেলেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্লাব মোহামেডানের সঙ্গে লীগ শিরোপা লড়াইয়ে পাল্লা দিয়েছে এবং একসময় পিছিয়েও গেছে। ১৯৫৮ সালে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে দল গঠন করে রণজিৎ দাসের নেতৃত্বে আজাদ স্পোর্টিং লীগ চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে। এ দেশের বাঙালিদের ফুটবল উন্নয়নে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। (collected) একাত্তরে বাঙালি ফুটবলাররা মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই নজির আর কোনো দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে আছে কি না, তা জানা নেই। অস্ত্র হাতে যুদ্ধের পাশাপাশি ফুটবল মাঠ থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন ফুটবলাররা। স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মোট ১৬টি ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ’৭১ সালের ২৪ জুলাই ফুটবলাররাই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের মাটিতে পতাকা ওড়ান। নদীয়ার কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে ১০ মিনিটের জন্য বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচ ছিল সেটা। নদীয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে। ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল। গোল দুটি করেছিলেন এনায়েত ও শাহজাহান। ১৬টি ম্যাচের মধ্যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল জেতে ১২টিতে, ড্র একটি আর হেরেছে তিনটি ম্যাচে। স্বাধীন বাংলা দলে ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), আলী ইমাম, কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, আইনুল হক, শেখ আশরাফ আলী, বিমল কর, শাহজাহান আলম, মনসুর আলী, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান, কে এম নওশেরুজ্জামান, সুভাষ সাহা, ফজলে সাদাইন খোকন, আবুল হাকিম, তসলিমউদ্দিন শেখ, আমিনুল ইসলাম, আবদুর মমিন জোয়ারদার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, সাত্তার, প্রাণ গোবিন্দ কু-ু, মজিবর রহমান, খন্দকার নুরুন্নবী, লুৎফর রহমান, অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি, সঞ্জীব কুমার দে, মাহমুদুর রশিদ, সাইদুর রহমান প্যাটেল, দেওয়ান মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন ও নিহার কান্তি দাস। ফুটবল দলের ম্যানেজার ছিলেন তারকা ক্রিকেটার তানভীর মাজহার তান্না।স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৩ বছরের বাঙালির ফুটবল পর্যালোচনায় অনেক কথাই লিখতে হয়, যা ছোট পরিসরে সম্ভব নয়। তাই সংক্ষেপে আলোচনা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালিদের সেই মাঠের ফুটবল হারিয়ে গেছে। দেশজুড়ে ফুটবলের চর্চা এবং প্রতিযোগিতামূলক খেলা এখন তলানিতে। ফুটবলকে কোনোরকমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ফুটবলকে ঘিরে নেই সেই আবেগ আর উন্মাদনা। এই মুমূর্ষপ্রায় অবস্থার নেপথ্যে রয়েছে সাংগঠনিক অদক্ষতা, সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। আশি থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি ঢাকার ফুটবল লীগ ঘিরে সাধারণ মহলের ছিল প্রচুর উৎসাহ। বিশেষত ঢাকা লীগে আবাহনী ও মোহামেডানের খেলা মানেই ছিল অন্য রকম উত্তেজনা। অথচ আবাহনী ও মোহামেডানের খেলা আজ আর দর্শক টানতে পারে না। আবাহনী, মোহামেডানের পর ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ জামাল গত কয়েক বছরে কোনো ধরনের ফুটবল খেলেছে? গত পনেরো থেকে বিশ বছরে বাঙালি ফুটবলারদের কয়জনের নাম স্মরণ করে বলতে পারবেন ফুটবলরসিকরা, যাদের খেলা তাদের নজর কেড়েছে? দেশি-বিদেশি কোচ নিয়োগ আর বিদায় কিন্তু ফুটবলের মানোন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখেনি। ফুটবলকে চাঙা করার উদ্যোগগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। এএফসির চাহিদা অনুযায়ী পেশাদার লীগ চালু করা হলেও কোনো ফল মেলেনি। দেশজুড়ে এখন মাঠের অভাব। এককথায় দিকভ্রান্ত এখন বাঙালির প্রাণের খেলা।এখানে একটু সংযোজন প্রয়োজন, ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই গঠিত হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের প্রভিশনাল সদস্যপদ পায় ১৯৭৩ সালের ১০ আগস্ট। চুয়াত্তরের জানুয়ারিতে ফিফার সভায় এএফসির সদস্যপদ অনুমোদিত হয়। জুন মাসে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ফিফার প্রভিশনাল সদস্যপদ পায়। আর ১০-১৫ জুন ফ্রাঙ্কফুর্টে অনুষ্ঠিত ফিফা কংগ্রেসে বাংলাদেশের সদস্যপদ অনুমোদিত হয়।১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৯তম মারদেকা ফুটবলে জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় দল প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ফুটবলে অংশ নেয়। সেবার সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে ১-১ গোলে ড্র করে। হারে কুয়েত, বার্মা ও থাইল্যান্ডের কাছে। ওই দলে ছিলেন: শহীদুর রহমান সান্টু, আবদুর মোতালেব, শেখ আশরাফ আলী, নাজির জুনিয়র, আবদুল হাকিম, ফারুকুজ্জামান ফারুক, দিলীপ কুমার বড়–য়া, মনোয়ার হোসেন নান্নু, মো. কায়কোবাদ, শরীফুজ্জামান, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান, সুনীল কৃষ্ণ দে, নওশেরুজ্জামান ও মো. ফিরোজ কবীর।১৯৭৮ সাল ছিল বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ঘটনাবহুল। সেবার ১৮ দেশের অংশগ্রহণে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল প্রতিযোগিতা। এশিয়ান যুব স্কোয়াডে বাংলাদেশ দলে ছিলেন: সুহাষ বড়ুয়া, মঈনুল করিম, দেওয়ান শামসুল আরেফিন (টুটুল), আবুল হোসেন, স্বপন কুমার দাস, মো. মোস্তফা হোসেন (মফুল), মো. বাদল, কায়সার আলী, মো. মহসিন (অধিনায়ক), আবদুস সালাম, আশীষ ভদ্র, শেখ মো. আসলাম, হাসানুজ্জামান বাবলু, কাজী আনোয়ার হোসেন, হাসান আহমেদুল হক (হাসান), গোলাম রাব্বানী হেলাল ও আবদুস সালাম মুর্শেদী।গত ৪৩ বছরের ফুটবলে বাঙালিদের সফলতা হলো একবার করে সাফ গেমস ও সাফ ফুটবলের (যথাক্রমে ১৯৯৯ ও ২০০৩ সালে) শিরোপা অর্জন। এর বাইরে পুরো জাতিকে আলোড়িত করার মতো কোনো সফলতা নেই। আন্তর্জাতিক ফুটবল গ্রাফে আমাদের অবস্থান নিতান্ত নড়বড়ে। ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে চলার জন্য যে ধরনের অঙ্গীকার, দৃঢ়তা ও উদ্যোগ প্রয়োজন, তা একেবারেই নেই। বাঙালিদের পেছনে যারা ছিল, তারা সবাই টপকে গেছে। বাঙালির ফুটবল-সাফল্য এখন কেবলই স্মৃতি। বলতে দ্বিধা নেই, ফুটবলে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও সাংগঠনিক ব্যর্থতায় তা সম্ভব হয়নি। অতএব আমরা রয়েছি সেই তিমিরেই।

লেখক: সুইডেন প্রবাসী