ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী মান্দা রঘুনাথ মন্দিরে হাজারো ভক্তের ঢল

২০১৬ এপ্রিল ১৫ ১৫:১২:২৮
নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী মান্দা রঘুনাথ মন্দিরে হাজারো ভক্তের ঢল

নওগাঁ প্রতিনিধি : শুক্রবার রামনবমী উৎসবে নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী ঠাকুর মান্দায় শ্রীশ্রী রঘুনাথ মন্দির প্রাঙ্গনে ঢল নেমেছিল হাজারো ভক্তের। কীর্তন, প্রসাদ বিতরণ, ভক্তদের পুজো অর্চনা, ভোগ নিবেদন এবং মানত দেয়ার মধ্যদিয়ে উৎসব মুখর হয়ে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গন। মন্দিরে যাওয়ার কাঁচা অপ্রসস্থ সড়ক দিয়ে সবাই যেনো আগে যাবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রচন্ড ভিড়ে সে চেষ্টা ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া ফল হচ্ছেনা কিছুই। কতইনা আত্মবিশ্বাস আর ধর্মীয় অনুভুতি নিয়ে মনবাসনা পুরনের আশায় মানুষ আসছে সেখানে। সেই সংখ্যা হাজার পেড়িয়ে পৌঁছে যায় লাখে ।

ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ব নিদর্শনে সমৃদ্ধ উত্তরের নওগাঁ জেলার অন্যতম পূণ্যভূমি স্থাপত্যের মধ্যে মান্দা উপজেলার ঠাকুর মান্দা রঘুনাথ জিঁউ মন্দিরটি প্রায় আড়াই শ’ বছর ধরে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সতের শতকের অন্যতম স্থাপত্যের মধ্যে এটি একটি অন্যতম। এখনো চৈত্র-বৈশাখ মাসের নবমী তিথিতে রামনবমী উৎসবে ১৫দিন ধরে চলে এখানে নানা ধর্মীয় উৎসব ও মেলা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এটি একটি অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে সারা ভারত উপ-মহাদেশে।

বাসন্তী পুজোর শুরু তথা ষষ্ঠি থেকে নবমী এবং এর ৯দিন পর লক্ষনভোজের মধ্যদিয়ে একটানা ১৫ দিন ব্যাপী ধর্মীয় উৎসব চলে মহা ধুমধামের মধ্যদিয়ে। এই উৎসবে বিশেষ করে রামনবমী উৎসবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ভক্তবৃন্দ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও ভক্তরা আসেন ঠাকুর দর্শনে ও তাঁদের মানত দিতে। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভক্তের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দিরের চারিপাশে প্রায় ১ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে। শত শত বাস, মাইক্রোবাস, জীপ আর হাজার হাজার ভ্যান ও ভটভটিতে চড়ে ভক্তরা আসেন এই রঘুনাথ মন্দিরে। মন্দির থেকে কমপক্ষে দেড় কিঃমিঃ দূরে রাখতে হয় এসব যানবাহন। ভক্ত-দর্শনার্থীদের ভিড়ে প্রাচীন এই মন্দিরটি মুখরিত হয়ে ওঠে এই তিথিতে। এবারেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৪০কিঃ মিঃ পশ্চিমে মান্দা উপজেলার এই ঠাকুর মান্দা গ্রামের অবস্থান। এক সময় এই মন্দিরের চারি ধারে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল শুধু বিল। মন্দিরের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শিব নদী। একসময় এই নদী ছিল স্রোতস্বিনী। এই নদীতে ভক্ত দর্শনার্থীরা গঙ্গা স্নান করে ভেজা কাপড়ে পাশের বিল থেকে পদ্মের পাতা তুলে মাথায় দিয়ে মন্দিরে যেত ঠাকুর দর্শনে। এখনো কিছুটা হলেও ভক্তরা সেই রীতি-নীতি মেনে চলার চেষ্টা করেন। নদী এবং বিলে পানি না থাকলেও ভক্তরা মন্দির সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে ভেজা কাপড়ে কেউ কেউ আবার দুর্লভ পদ্মপাতা সংগ্রহ করে তা মাথায় দিয়ে তার ওপর মাটির পাতিল বোঝাই ভোগের মিষ্টান্ন মাথায় নিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে প্রভুর চরনে নিবেদন করে থাকেন। কেউ কেউ এক সপ্তাহ ধরে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী মাঠেই আস্তানা গাড়ে। সেখানেই রান্না করে খেয়ে তারা সেখানেই অবস্থান করে। ভক্ত বৃন্দদের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে কমিটির লোকজন সেখানে পদাবলী কীর্তনের আসর বসিয়ে থাকেন প্রতিবছর। নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবীর পাশাপাশি পর্যাপ্ত পুলিশ সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে রেখেছে এবারেও।

প্রবীনদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৭৮০ সালে নাটোরের রানী ভবানী মান্দার এই রঘুনাথ মন্দির নির্মাণ করেন। এর গঠন পিরামিডাকৃতির। মন্দিরের সম্মুখে ডরিক স্তম্ভবিশিষ্ট অর্ধবৃত্তাকার বারান্দা আছে। মন্দিরটি সপ্তদশ শতকের হলেও এর অভ্যন্তরে স্থাপিত বিগ্রহ গুলো আরো অনেক পুরনো। এই বিগ্রহগুলো প্রাপ্তির বিষয় নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ বলেন, মান্দার বিল খননকালে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা ও রামভক্ত হনুমানের বিগ্রহ গুলো পেয়ে ওই মন্দিরে স্থাপন করা হয়। আবার কিংবদন্তি রয়েছে, ওই গ্রামে বাস করতেন দরিদ্র এক অন্ধ ব্রাহ্মন। তিনি অতীব রামভক্ত ছিলেন। একদিন তিনি বিলে স্নান করতে যান। সেখানে স্নানে নামলে বিগ্রহগুলো বিলের পানিতে ভাসতে ভাসতে এসে তার শরীরে স্পর্শ হয়। তখন তিনি প্রনাম করে মূর্তিগুলো মাথায় ও কোলে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করেন। সেখানে প্রতিদিন ৩ বেলা পুজো-অর্চনা করতে শুরু করেন।

এক পর্যায় তিনি দৃষ্টি ফিরে পান এবং সাংসারিক স্বচ্ছলতা ফিরে পান। তখন থেকেই রঘুনাথের মাহাত্মের কথা চারিদিকে প্রচার হতে থাকে। বাড়তে থাকে ভক্তদের ভিড়। এক পর্যায় প্রভুর মাহাত্মের কথা পৌঁছে নাটোরের রানী ভবানীর কানে। তিনি ঠাকুর মান্দায় পৌঁছে মন্দিরের জীর্ণতা দেখে নিজেই মন্দির তৈরি করে দেন। সেই প্রাচীন কাল থেকে এখনো প্রতি বছর জন্মান্ধ শিশুদের শুয়ে রাখা হয় মন্দিরের সামনে। মানত করা হয়, স্বর্ণের চোখ ও নানা রকম ভোগরাগ। যাদের চোখ ভাল হয় বা দৃষ্টি ফিরে পায় তারা প্রতিবছর এসব মানত দিয়ে থাকে। অন্ধ তথা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের মন্দিরের সামনে শুয়ে রাখার পর অনেক শিশুর চোখ ভাল হয়ে যায় বলে স্থানীয় লোকজন জানায়। মানত দিতে আসা ভক্তরাও ঠিক এমন কথাই বলেছেন।

বৃহস্পতিবার ছিল মহাঅষ্টমীর স্নান। ভক্তরা এই স্নান সেরে শুক্রবার রামনবমী উৎসবে ঠাকুর দর্শনে মেতে ওঠেন। এই দিনটিই ভক্তদের মানত দেয়ার দিন। এইদিনই অন্ধ শিশুদের কেউ কেউ দৃষ্টি ফিরে পায়। যে সব গৃহবধূ মা হতে চেয়েও পারছেননা, তারাও মন্দিরের সামনে স্নান করে ভেজা কাপড়ে আঁচল পেতে মাটিতে বসে সন্তানের জন্য মানত করে থাকেন। যাদের মনবাসনা পূর্ণ হয় তারা পরবর্তীতে সন্তান কোলে নিয়ে মানত দিতে আসেন। এসব ক্ষেত্রে শুধু হিন্দু নয়, অনেক মুসলিম পবিারের লোকজনদেরও দেখা যায় সেখানে মানত দিতে।

ঠাকুর মান্দা রঘুনাথ জিঁউ মন্দির কমিটি সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে চন্দন কুমার মৈত্র ও সত্যেন্দ্র নাথ প্রামানিক বলেন, ইতিহাস প্রসিদ্ধ অলৌকিক মাহাত্ম সংবলিত ঠাকুর মান্দায় শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরে বৃহস্পতিবার রাত্রি ২টা ৪৭ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের পর থেকে শুক্রবার রাত ২টা ২৯ মিনিট ১৬ সেকেন্ড পর্যন্ত নবমী উৎসব। এই সময়ে শ্রীশ্রী রামচন্দ্রের জন্ম উৎসব হিসেবে নানা ধর্মীয় আঙ্গিকে প্রতিবছর এখানে উৎসব পালিত হয়ে আসে। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে জানান তারা। তাদের মতে, এই মন্দিরে সকল ধর্মের-বর্নের মানুষ নানা মানত করেন এবং সুফলও পেয়ে থাকেন অনেকেই।

(বিএম/এএস/এপ্রিল ১৫, ২০১৬)