ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » ঘুরে এলাম » বিস্তারিত

ঘুরে আসুন সিলেট

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ০৮ ১৪:৪৪:২৮
ঘুরে আসুন সিলেট

নিউজ ডেস্ক : প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত বাংলাদেশে ঘুরতে যাওয়ার জায়গা অনেক আছে কিন্তু তার মধ্যে সিলেটকে গুরুত্ব বেশি দিতেই হয় তার বৈচিত্রের কারণে৷ একসাথে হ্রদ, পাহাড়, বন, নদী, নামকরা মাজার বা মন্দির এত অল্প পরিসরে আর কোথাও নেই৷ বাংলাদেশের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর গুলোর মধ্যে একটি সিলেট৷ যদিও এখানে ঘুরতে আসা মানুষের ভীড় দেখে তা মনে হয়না৷ বেশির ভাগ মানুষ ই আসে মাজার জিয়ারত এর উদ্দেশ্য নিয়ে৷ আসুন জেনে নেয়া যাক সিলেট ভ্রমণের খুটিনাটি সব কিছু৷

যাত্রা
ঢাকা থেকে সিলেট এর উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায় গাবতলী এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে৷ এর মাঝে শ্যামলী, হানিফ, সোহাগ ভলভো এবং ইউনিক পরিবহন উল্লেখযোগ্য৷ বাস গুলোর ভাড়া ৩৮০ টাকা থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে৷ বাস গুলো সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় পরপর ছেড়ে যায়৷

এছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্টারসিটি ট্রেন আছে 8 টি৷ কালানি এক্সপ্রেস (বিকেল ৩ টা), পারাবত এক্সপ্রেস (সকাল ৬ টা ৪০ মি), উপবন এক্সপ্রেস (রাত ৯ টা ৫০ মি), জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস (দুপুর ১২ টা)৷ এর মধ্যে পারাবত মঙ্গলবার এবং উপবন বুধবার বন্ধ থাকে৷ অন্য দুইটি সপ্তাহে ৭ দিন ই চলে৷ এ ছাড়াও একটি মেইল ট্রেন আছে সুরমা মেইল নামের৷

ট্রেন এর টিকেট এর দাম
এসি বার্থ ৬৯৮ টাকা, এসি সিট ৪৬০ টাকা, ফার্স্ট ক্লাস বার্থ ৪২৫ টাকা, ফার্স্ট ক্লাস সিট ২৭০ টাকা. স্নিগ্ধা ৪৬০ টাকা, শোভন চেয়ার ১৮০ টাকা, শোভন ১৫০ টাকা, সুলভ ৯৫ টাকা৷

সিলেট বাস স্ট্যান্ড বা ট্রেন স্টেশন থেকে অল্প ভাড়ায় সিএনজি অটোরিক্সা সবসময় পাওয়া যায়৷ তাই থাকার ব্যবস্থা যেখানে করা আছে সেখানে যাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না তা যত রাত ই হোক৷

থাকার জায়গা :
সিলেট এ প্রবাসী বাঙালিদের বেশিরভাগ বিনিয়োগ এর কারণে হোটেল বা মোটেল পর্যাপ্ত পরিমানেই আছে৷ এখানে সব মানের হোটেলই আছে৷ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকার মত ঘরোয়া হোটেল যেমন আছে তেমনি আছে বাইরের ভ্রমনকারীদের জন্য সব সুবিধা সহ হোটেল৷

নাজিমগড় এস্টেট রিসোর্ট, জাকারিয়া এস্টেট রিসোর্ট, হিল সাইড হলিডে হোমস, রোজ ভিউ হোটেল (৪০০০ থেকে ২৪০০০ টাকা পর্যন্ত)

হোটেল গুলোতে অনলাইন বুকিং এর ব্যবস্থা আছে৷ ঘুরতে যাওয়ার ২/৩ দিন আগে বুকিং দিলে ভালো হয়৷ কারণ মাজার জিয়ারতের জন্য সিলেট এ অনেক মানুষ আসায় অনেক সময় সমস্যা হয়৷

হোটেল অনুরাগ, হোটেল ডালাস ইন্ট:, হোটেল হলি সাইড, হোটেল সুপ্রিম, হোটেল সিলভার শাইন, পর্যটন মোটেল (১২৫০ টাকা থেকে ৩৫০০ টাকা)৷

এ ছাড়াও লালা বাজার এলাকায় কম ভাড়ায় অনেক মানসম্মত রেস্ট হাউস আছে৷

ঘোরাঘুরি
সিলেটে শহর ও শহরের বাইরে অনেক ঘোরার জায়গা আছে৷ শহরের ভিতরে ঘুরতে হলে আছে রিক্সা ও সিএনজি অটো-রিক্সা৷ আর শহরের বাইরে যেতে চাইলে আম্বরখানা ও মদিনা মার্কেট এলাকায় তুলনামূলক কম টাকায় মাইক্রোবাস বা কার পাওয়া যায়৷


নৌকা ভ্রমণের জন্য কানিশাইল বেশ পছন্দের জায়গা। এখানে ঘন্টা প্রতি ৭০ টাকা দিয়ে আপনি নৌকা ভ্রমণ করতে পারবেন।৷

১৯৩৬ সালে ইংলিশ গভর্নর মাইকেল কিন এর নামে লোহা ও স্টিল দিয়ে সুরমা নদীর উপর তৈরি হয়৷ ব্রিজ এর একপাশে আছে সিলেট রেল স্টেশন৷ একে সিলেটের প্রবেশ দ্বার ও বলা হয়৷

টাওয়ার টি কিন ব্রিজ এর এক পাশে অবস্থিত৷ এখান থেকে একটু সামনেই সুরমা নদীর পার এ আছে সুন্দর বসার জায়গা আর চটপটি র দোকান৷

হজরত শাহ জালাল (রাঃ) এর দরগাহ শরিফ কমপ্লেক্স এ আছে নামাজ আদায় এর মসজিদ আর অজুখানা৷ রাত এ কেউ যদি মাজারেই থাকতে চায় সে ব্যবস্থাও আসে৷ মহিলাদের নামজের জন্য আলাদা জায়গা আছে৷ মাজারে দেয়ার জন্য হালুয়া, মোমবাতি, আগরবাতি বা যে কোনো কিছু মাজার গেট এ পাওয়া যায়৷ জালালী কবুতর ও গজার মাছকে খাবার দিতে হলে ১০ টাকা দিয়ে ধান এর প্যাকেট ও ছোট মাছও কেনা যায়৷

হজরত শাহ জালাল (রাঃ) এর দরগাহ থেকে ৮ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত৷ শহর থেকে সিএনজি অটো-রিক্সা নিয়ে যেতে হবে৷ মাজার এর সামনের পুকুরে অজু করতে হবে৷ মেয়েদের নামাজের আলাদা জায়গা আছে৷ মাজার এ যাওয়ার সময় মনে কুচিন্তা থাকা যাবেনা এবং মাজার জিয়ারত করে নামার সময় পিঠ দেখিয়ে নামা যাবেনা এমন লোকজ বিশ্বাস প্রচলিত আছে৷

ইস্কন ভাবধারার অসাধারণ একটা জায়গা৷ অনেক ধরনের তৈজসপত্র, বিভিন্ন ইস্কন ভাবধারার মনীষীর বই ও মন্দিরের লোকেদের তৈরী প্যাকেটজাত খাবার পাওয়া যায়৷ রাত ৮ তার দিকে প্রার্থনা হয়৷ এখানকার মহারাজ এর তৈরী পলান্ন, সয়াবিন আর পায়েসের রান্না বিখ্যাত৷

মাজার এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মাজারের পুরোটা জুড়েই আসে শতশত বানর৷ পীরের সাগরেদরা বানর এর রূপ ধরে আছে এমন কথা শোনা যায়৷ বানর কে খাওয়ানোর জন্য বুট ভাজা বিক্রি হয়৷

মরমী সাধক হাসন রাজার সিলেটের বাড়ি বলা হয় এটাকে৷ এখন মিউজিয়াম এর রূপ দেয়া হয়েছে৷ ভিতরে হাসন রাজা সম্পর্কে অনেক মজাদার তথ্য পাওয়া যাবে৷ টিকেট ৫ টাকা৷

সুন্দর ছায়াময় পরিবেশে আড্ডা দিতে বা হেটে বেড়াতে হলে যেতে হবে টিলাগড়৷ যাওয়ার পথে চোখে পর্বে সিলেট পলিটেকনিক, গবাদি পশু উন্নয়ন ফার্ম, ছোট বড় পাহাড় আর শেষ সীমানায় আচ্ছে গাস ফিল্ড৷ এখানে একটি ছোট চা বাগান ও আছে৷

টিলার উপরে বানানো বাংলাদেশের অন্যতম বড় এবং বিখ্যাত কলেজ৷ অনেক বিখ্যাত লোকজন এই কলেজে পড়াশোনা করেছেন৷ চাইলে তাদের তখনকার রুম গুলো ও দেখে আসতে পারেন৷

অন্যতম সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়৷ এখানে গিয়ে চাইলে দেখা করতে পারেন ড: মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর সাথে৷ তবে বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রধান আকর্ষণ এর অসাধারণ শহীদ মিনার টি৷

প্রতিষ্ঠানের চার পাশ ঘিরেই আছে চা বাগান৷ একটু হেটে ভিতরে গেলেই আছে ভালো কিছু ফটোগ্রাফিক স্পট আর অল্প বসতি সম্পন্ন কিছু আদিবাসী গ্রাম৷

এ ছাড়াও আছে ওসমানী মেডিকেল কলেজ, ওসমানী মিউজিয়াম, মনিপুরি রাজপ্রাসাদ, সিলেট সার্কিট হাউস ও শাহী ঈদগাহ৷

শহরের বাইরে ঘোরার জায়গা গুলো
বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার যেখানে "বাংলাদেশ ০ কি: মি:" লেখা মাইলফলক আছে৷ মাইলফলক এর পাশে দাড়িয়ে দুই দেশের মাটিতে পা দিয়ে ছবি তোলার অনন্য সুযোগ থাকবে৷ এখানে কিচু চা বাগান ও আছে৷

স্বচ্ছ পানিতে তাকালেই দেখা যাবে পাথর গড়াতে গড়াতে আসছে৷ ট্রলার নিয়ে একটু ভিতরের দিকে গেলে পাওয়া যাবে আরেকটা বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার৷ একই সাথে বি ডি আর এবং বি এস এফ প্রহরীরা যেভাবে ঘুরাফেরা করে তাতে হয়ত মনে হতে পারে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে কোনো উত্তেজনা বিরাজ করছেনা৷ আর জাফলং গেলে সাথে এক জোড়া শুকনো কাপড় ও নিয়ে যেতে হবে কারণ ওখানকার শীতল পানিতে একটু গোসল করার ইচ্ছা দমিয়ে রাখা কষ্ট৷

১৮শ শতকের জৈন্তা রাজবংশের রাজাদের বাসভবন ছিল এই প্রাসাদ৷ জৈন্তাপুর ছিল তখন রাজধানী৷ অল্প কিছু নিদর্শন এখনো আছে৷ পিকনিক স্পট হিসেবে নাম আছে৷

সিলেট শহর থেকে দক্ষিনে জৈনপুর এ আছে এই শক্তি পিঠ৷ এখানে একটি ভৈরব মন্দির আছে৷

মাধবকুন্ড ঝরনার জন্য বিখ্যাত৷ তবে ঝরনা দেখতে চাইলে শীতকালে যেতে হবে৷বর্ষার সময়ে একটু বিপদজনক হয়ে যায় বন্যা আর জোক এর কারণে৷ অবশ্য শীতকালে ঝরনার পানি কমে যায় অনেক৷ মাধবকুন্ডের মাগুরছড়াতে পরিত্যক্ত গাস ও তেল খনি আছে৷ রাবার ও লেবুর বাগানও দেখতে পাওয়া যায়৷

বাংলাদেশের অন্যতম সংরক্ষিত বন৷ ঘন জঙ্গলের ফাকে প্রচুর বানর এবং পাখি দেখতে পাওয়া যায়৷ বনে বাঘ, অজগর, হরিন দেখতে পাওয়া যায় বলে শোনা যায়৷ টিলার উপরে কিছু রেস্টুরেন্ট আছে৷ এশিয়ার এক মাত্র ক্লোরোফর্ম গাছ এখানেই আছে যার বাকল এর গন্ধ নিলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে৷ ৫০ টাকা দিয়ে হাতির পিঠে ওঠার সুযোগ আছে৷

বাংলাদেশের চা শিল্পের রাজধানী দুটি পাতা একটি কুড়ির শ্রীমঙ্গল৷ কার্পেটের মত সাজানো চা বাগান সবদিকে৷ এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চা বাগান সহ বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট ও অনেক গুলো প্রসেসিং প্লান্ট আছে৷ চা পাতা থেকে চা প্যাকেটজাত করা পর্যন্ত পুরোটুকু দেখতে চাইলে ফ্যাক্টরী ঘুরে দেখা যায়৷ শ্রীমঙ্গলের নিলকন্ঠ কেবিন এর সাত রঙের রংধনু চা (৭০ টাকা) ও বিখ্যাত৷ লেবু ও কমলার বাগানও আছে৷

শ্রীমঙ্গল এর কমলগঞ্জ এ আছে এই লেক৷ সবসময় শতশত পদ্ম আর শাপলা ফুটে থাকে৷ এখানে একটা পার্ক আর পিকনিক স্পট আছে৷ পাশের টিলার উপর থেকে শ্রীমঙ্গল এর চা বাগান এর বিস্তৃতিটা ভালো মত বোঝা যায়৷ এখানকার মনিপুরি পাড়াতে ঘুরে আসা যায়৷ তাদের শিল্পকলার সাথেও পরিচিত হওয়া যায়৷ চা পাতা দিয়ে তৈরী আলাদা আর মজাদার বিভিন খাবার পাওয়া যায়৷

মাধবপুর লেক থেকে বর্ডার এর দিকে গেলে বি ডি আর চেক পোস্ট আছে৷ ওখানে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান এর সমাধি আছে৷ সীমানা জটিলতায় ভারতের অংশে তার কবর টা পড়ে গেলে আবার সেখান থেকে এনে এই চেকপোস্ট এর এখানে সৌধ তৈরী করা হয়৷ একটু সামনে গেলেই দেখা যাবে চা গাছ এর চারা তৈরি হচ্ছে আর ছোট একটা খাল দিয়ে ভাগ করা বাংলাদেশ- ভারত সীমান্ত৷

খাবার
সিলেট শহরে খাবার এর মান ভালো কিন্তু দাম একটু বেশি৷ ভালো মানের সব গুলো আবাসিক হোটেল এ সকালের নাস্তা কমপ্লিমেন্টারী দেয়া হয় এবং বাংলাদেশী ইন্ডিয়ান চাইনিজ সহ অনেক রকম এক্সটিক ডিশঅর্ডার দিলে পাওয়া যায়৷ বাইরে খেতে চাইলে আছে পানসি, পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট (এখানে মুরগি, কবুতর, কোয়েল সহ বিভিন্ন পাখির মাংশ পাওয়া যায়) ও জিন্দাবাজারের ইটোপিয়া৷ সিলেট এর সাতকরা দিয়ে গরুর মাংশ বিখ্যাত৷ এমনিতে বাইরে পাওয়া না গেলে ভালো আবাসিক হোটেল গুলোতে অর্ডার দিলে তারা রান্না করার ব্যবস্থা করে৷ এ ছাড়াও আছে লামা বাজার এর বাঁশ এর মূল আর শুটকির মনিপুরি রান্না৷

কেনাকাটা
কেনাকাটার জন্য সবগুলো দেশী ব্র্যান্ড এর শোরুম আচ্ছে৷ তাছাড়াও লামা বাজারে মনিপুরি শাড়ি আর হাতের তৈরি জিনিসের দোকান আছে৷

(ওএস/এএস/ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৭)