ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

রোহিঙ্গা সমস্যা ও সমাধান

২০১৭ সেপ্টেম্বর ১৬ ১৫:৪৪:৫৮
রোহিঙ্গা সমস্যা ও সমাধান

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম


আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার, আমরা অনেকে যাকে বার্মা বলেই বেশি চিনি, সেখানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চরম দমন-পীড়ন চলছে। গণহত্যা চলছে বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না।

বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে নিরীহ রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, লুট করা হচ্ছে সহায়সম্পদ। প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার অসহায় রোহিঙ্গা সীমান্তের সব পয়েন্ট দিয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকছে।

ঘুম থেকে ওঠার পর আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে এখন সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা শুনি তা হল ‘রোহিঙ্গা’। অনেকেই তাদের পক্ষে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করছে কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই জানে না ‘রোহিঙ্গা’ কারা। আমরা যদি সহজভাবে চিন্তা করি ‘রোহিঙ্গা’ কারা, তাহলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছু মানুষ বিশাল জলরাশির মাঝে খাবার পানি ও খাদ্য ছাড়া মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

অভিযোগ করা হয়েছে, গত ২৫ আগস্ট ভোররাতে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি সংক্ষেপে ‘আরসা’ নামের একটি বিদ্রোহী সংগঠন সেনাবাহিনী ও পুলিশের ৩০টি ক্যাম্পে একযোগে হামলা চালায়। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এর জেরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কমপক্ষে ১০০ রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। দেখামাত্র গুলি করছে। লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে অথবা আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান নতুন না হলেও এবার তারা তাদের অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

১৯৭৮ সালে প্রথম সামরিক হামলার মুখে রোহিঙ্গারা ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তখন বিষয়টি সাময়িক মনে করা হলেও তা একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। মাঝখানে নানা কূটনৈতিক উদ্যোগের কারণে কিছু শরণার্থী বার্মা ফিরিয়ে নিলেও বিভিন্ন ঘটনায় তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে এসে এক মারাত্মক মানবিক সংকট তৈরি করেছে। ধারণা করা হয়, আনুমানিক ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের পক্ষে বছরের পর বছর কয়েক লাখ শরণার্থীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। তার পরও মানবিকতার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ দশকের পর দশক ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের থাকতে দিয়েছে। এবার যে হারে রোহিঙ্গারা আসছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো।

সংকট সৃষ্টিকারী দেশটির নাম মিয়ানমার বা বার্মা। বার্মাকে অনেকে দুনিয়াছাড়া দেশ বলে থাকেন। এটা খুব বেঠিক নয়। ভারত ভাগের এক বছর পর ইংরেজরা বার্মাকে স্বাধীনতা দেয়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জেনারেল অং সান। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই অং সান এবং তার মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। তখন থেকে বার্মা চলে যায় সামরিক শাসনের অধীন। লৌহকপাটের দেশ বলেই বার্মা পরিচিতি পায়। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনাধীন চলার রেকর্ড নেই। বাইরের দুনিয়াকে বার্মা খুব হিসাবের মধ্যে নেয়— তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। চরম স্বেচ্ছাচারী বার্মার সামরিক কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশের মানুষ বলে মনে করে না। ধর্মের দিক থেকে রোহিঙ্গারা মুসলমান, আবার তাদের ভাষা বাংলা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষার অভিন্নতার কারণে বার্মিজ শাসকরা কখনো তাদের বার্মার অধিবাসী বলে মনে করে না। তাদের ‘বাঙালি’ বলা হয়। সমস্যাটা এখানেই। যেহেতু তাদের বহিরাগত মনে করা হয়, সেহেতু তাদের দেশছাড়া করার অধিকার বার্মার শাসকদের আছে বলে তারা মনে করে। একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার যে পথ মিয়ানমার সেনাবাহিনী গ্রহণ করছে, তা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা এথনিক ক্লিনজিং। এটা মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ। অথচ পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো রোহিঙ্গা নিধন পর্ব না দেখার ভান করে আছে। এখন তারা অন্ধ। এমনকি মুসলিম দেশগুলোকেও এ ব্যাপারে প্রতিবাদী হতে দেখা যাচ্ছে না। ‘উষ্মা’ এখানে কাজ করছে না।


পাঠকদের জন্য রোহিঙ্গাদের ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হলো।

রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন মানুষ। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বসবাস। রাখাইন রাজ্যের আদি নাম আরাকান। যদিও রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষরা শত শত বছর ধরে সেখানে আছে কিন্তু মায়ানমার / বার্মা সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে কখনো নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। রাষ্ট্রহীন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যসহ প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বাস করে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।

খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরাকান অঞ্চল শাসন করতো চন্দ্র বংশ। আরব বণিকদের একটা জাহাজ রামব্রী দ্বীপের তীরে ভেঙে পড়ে। কিছু আরব তীরে এসে স্থানীয়দের কাছে সাহায্য চায়। রাজা মহত ইং চন্দ্র তাদের সাহায্য করেন। কিছু আরব স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে। এসব আরব বণিক বসতি স্থাপনের আর্জি করলে মহত ইং চন্দ্র তা মঞ্জুর করেন।

চতুর্দশ শতকে আরাকানে মুসলিমরা বসতি স্থাপণ করে। ততকালীন বৌদ্ধ রাজা নারেমেইখলি ( যিনি তার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহের সহযোগিতায় ) তার রাজ দরবারে মুসলিম উপদেষ্টা এবং সভাসদদের স্বাদরে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরে দক্ষিণের বৌদ্ধ বর্মীরা আরাকান দখল করে নেয়, নারেমেইখলি পরাজিত হন। আরাকান দখলের পর বৌদ্ধ বর্মীরা সব রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাড়িয়ে দিয়েছিলো। তখন প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা ততকালীন ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্গত বাংলায় ( বর্তমান চট্রগ্রাম এলাকায় ) পালিয়ে গিয়েছিলো।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণ বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে তাড়িত করবে। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে।

১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিম বিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম হত্যা করে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তারা থেকে যায় ভাগ্য বিড়ম্বিত। স্বাধীন দেশের সরকার তাদেরকে নাগরিকত্ব দূরে থাক মানবিক অধিকারটুকুও দেয়নি।

নাসাকা বাহিনী ও বৌদ্ধদের হামলার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে ‘বসবাসকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাদের ভোটাধিকার নেই। নেই কোন সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। তারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যেখানে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু আজ সেখানে তারা সংখ্যালঘু। রাখাইন বৌদ্ধদের সেখানে এনে মুসলিমদের সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে।

রোহিঙ্গারা পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। ধর্মের বিশ্বাসে এরা অধিকাংশই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হল রোহিঙ্গা। মায়ানমারের সরকারী হিসেব মতে, প্রায় আট লক্ষ রোহিঙ্গা আরাকানে বসবাস করে। রোহিঙ্গারা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি।

মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। মায়ানমার সরকার ১৩৫ টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, রোহিঙ্গারা এই তালিকার অর্ন্তভুক্ত নয়। মায়ানমার সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা হল বাংলাদেশী, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মায়ানমারে বসবাস করছে। যদিও ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা মায়ামারে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে।

সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানী, বার্মিজ, বাঙালী, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভুত এই সংকর জাতি এয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজ্য ছিল।

মায়ানমার সরকারের দাবি, রোহিঙ্গারা হল ভারতীয়, বাঙালী ও চাঁটগাইয়া সেটলার, যাদেরকে ব্রিটিশরা আরাকানে এনেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় শাসক হিসেবে আসার কয়েক শতাব্দী আগে হতেই রোহিঙ্গারা আরাকানে পরিষ্কার জাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।

হতে পারে যে রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ চট্টগ্রাম থেকেই আরাকান রাজ্যে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছেন। কিন্তু সেটা তো নিশ্চয়ই কয়েক শ বছর আগের কথা। বংশপরম্পরায় তারা সেখানে আছেন। এখন তারা আরাকানের মাটির সন্তান। তাদের অধিকারহীন, মর্যাদাহীন রাখার কোনো নৈতিক এবং আইনি সুযোগ বার্মার শাসকগোষ্ঠীর নেই। যুক্তি-বুদ্ধির ধারেকাছে যেতে রাজি নন বার্মার সামরিক কর্তৃপক্ষ। দুনিয়াজুড়ে যারা মোড়লি করেন, গণতন্ত্র-মানবাধিকারের যারা ফেরিওয়ালা, তারা বার্মায় পৌঁছতে পারেন না। ওখানে নাক গলালে নাক কাটা যাওয়ার ভয় আছে বলে তারা ও পথ মাড়ান না। রোহিঙ্গাদের ওপর প্রথম বড় সামরিক হামলা হয় ১৯৭৮ সালে, যেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বার্মার একগুঁয়ে সামরিক শাসকদের চাপে ফেলার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক মাতব্বরকে এত বছরেও এগিয়ে আসতে দেখা যায় না।

ধারণা করা হয়েছিল, বার্মার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী, বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী অং সানের কন্যা অং সান সু চির দল ক্ষমতায় এলে হয়তো পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও সরকার গঠন করতে হয়েছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস-সমঝোতা করে। সু চিকে প্রধানমন্ত্রীও হতে দেওয়া হয়নি। সু চি এখন স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বেসামরিক ছদ্মাবরণে শাসন চালাচ্ছে আসলে সেনাবাহিনী। তাই রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চির আমলেও নীতিগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। হবে তেমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সু চি যে সামরিক বাহিনীর ইচ্ছার বাইরে যাবেন না, তা এরই মধ্য তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি সামনে এনে বলছেন, তার দল ক্ষমতায় থাকতে রোহিঙ্গাদের ওপর এই বর্বর আক্রমণ ও মানবতাবিরোধী আচরণ প্রত্যাশিত নয়। যারা এমন বলেন, তারা শান্তিতে নোবেল পাওয়াটাকে যত বড় বিষয় বলে মনে করেন প্রকৃত অর্থে এখন শান্তিতে নোবেল তত বড় বিষয় নেই। শান্তিতে নোবেলবিজয়ী হওয়া যে এখন পশ্চিমা দুনিয়ার রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে শান্তিতে নোবেলজয়ীদের তালিকা দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সু চি দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আপস করেছেন। আর একবার আপসের পথে হাঁটলে মনের দৃঢ়তা বজায় রাখা যায় না। তা ছাড়া গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা সু চি কতটুকু অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী, তাও আমাদের জানা নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার পর একজন মুসলিম সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাংবাদিকের মুসলিম পরিচয় জেনে তিনি যে খুশি হননি, সে খবরও তখন গণমাধ্যমে এসেছিল। রোহিঙ্গারা মুসলমান, তাই তাদের প্রতি সু চি সদয় হবেন না— এটাই তো বরং স্বাভাবিক।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব আইন করে বাতিল করা হয়েছে মিয়ানমারে। নাগরিকত্বহীন মানুষদের বার্মাছাড়া করার অজুহাত কর্তৃপক্ষ খুঁজছিল এবং তাদের হাতে মোক্ষম হাতিয়ার তুলে দিয়েছে ‘আরসা’ নামের বিদ্রোহী সংগঠনটি। তারা সেনা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করেছে— রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হামলে পড়ার জন্য এর চেয়ে বড় যুক্তি আর কিছু থাকতে পারে না। সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ হলো এমন এক ইস্যু যার পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বর্তমান বিশ্বে। রোহিঙ্গাদের আগে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো এবং এখন বলা হবে জঙ্গি। ব্যস, রোহিঙ্গারা আর কারও সহানুভূতি পাবে কীভাবে?

মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় সকল প্রকার নাগরিক ও মৌলিক সুবিধা হতে বঞ্চিত রোহিঙ্গারা। মায়ানমারে ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য পরিচয় পত্র থাকাটা খু্ব জরুরি বিষয়। কিন্তু মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিচয় পত্র ইস্যু করে না, ফলে, এমনিতেই পিছিয়ে পড়া রোহিঙ্গারা আরো পিছিয়ে পড়ছে।

মায়ানমার সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুসারে বিদেশীরা কোন সম্পত্তি ও ভূমি মালিক হতে পারে না। রোহিঙ্গারা মায়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে অবৈধ অভিবাসী তথা, বিদেশী। তাই, রোহিঙ্গারা কোন ভূমি বা, স্থায়ী সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে যেসকল ভূমিতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে, মায়ানমার সরকার যেকোন মুহুর্তে সেগুলো দখল করে নিতে পারে।

মায়ানমার সরকার আইনের মাধ্যমে রীতিমত অসহনীয় করে তুলেছে রোহিঙ্গাদের জীবন। রোহিঙ্গারা সরকারী চাকুরী করতে পারে না, সরকারী কোন দপ্তরে রোহিঙ্গা কোন সেবা পায় না, ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুত, পানি, জ্বালানী) জন্য আবেদন করতে পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। প্রায় ৮০% রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত।

প্রায়ই মায়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা নিপীড়ণের খবর পাওয়া যায়। রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে খাটানো হয়। প্রায়শ স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধন, সরকারী জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়। এর মধ্যে প্রাচীন কিছু মসজিদও আছে। অনেক রোহিঙ্গাদের ব্যবসায় দখল/বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য 'গ্যাটো' জাতীয় বিশেষ ধরণের ব্যবস্থা করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কয়েকটি বিশেষ বসবাসের স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা থেকে ওরা অনুমতি ছাড়া বের হতে পারে না। সেই গ্যাটোগুলোর ভিতরে আবদ্ধ মানবেতর জীবনযাপন করে রোহিঙ্গারা। চিকিৎসা, শিক্ষা ও উপযোগ সেবার ব্যবস্থা এই গ্যাটোগুলোতে থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ও নিম্নমানের।

রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার জন্যও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেয়া লাগে। এছাড়া দুটোর বেশি সন্তান নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করায় ও দুজনের বেশি সন্তানের জন্ম দেয়ায় রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তানদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার। এইসব পরিবারের সন্তানরা সরকারের 'গ্যাটো ব্যবস্থা' তালিকাভুক্ত নয়, ফলে, এদের জীবন ফোঁড়ার উপরে বিষ ঘা এর মত। এরা গ্যাটোগুলোতে থাকতে পারে না। আবার, গ্যাটোর বাইরেও থাকতে পারে না, কারণ, মায়ানমারের নাগরিক নয় ওরা। অবস্থাটা ওদের এমন যে, মায়ানমার সরকার ওদের কোন অস্তিত্বই স্বীকার করে না। এইসব পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের পথে পা বাড়ায়। নৌপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা ঢুবে মারা গেছে।

বৃটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সনে বার্মাও স্বাধীনতা পায়। এর পর থেকে বেশীরভাগ সময়ই সামরিক বাহিনীর কব্জাতেই ছিল দেশটি। যদিও সম্প্রতি এক ধরণের নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত গণতন্ত্র এসেছে দেশটিতে। মিয়ানমানের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আইনে রোহিঙ্গাদেরকে সেই দেশের নাগরিক হিসাবেই স্বীকার করা হয়নি। মিয়ানমারের নাগরিকদের কয়েক ধরণের শ্রেণী আছে। তার কোনটাতেই নেই রোহিঙ্গারা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম, শত শত বছর ধরে যারা বাস করছে তারা নাকি সে দেশের নাগরিক নয়। আর এমন একটি আইনকে সমর্থন করেন যিনি সেই অং সান সুচি পান নোবেল শান্তি পুরস্কার!

বিগত কয়েক দশক ধরে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশ ইন করছে। রুটিনমাফিক নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে। বর্তমানে সাত লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় বসবাস করছে। যদিও রিফিউজি হিসেবে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরো কম।

রোহিঙ্গাদের প্রতি যা করছে মায়ানমার সরকার, তা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধেই অপরাধ। এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আরাকানে বিকশিত হতে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সুবিধা না দেয়া, গ্যাটো সৃষ্টি করে সেখানে অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা, বিচারবর্হিভূতভাবে গ্রেফতার করা, মালিকানাস্বত্ব, সার্বজনীন শিক্ষা, চিকিৎসা, উপযোগ সেবা ও মৌলিক মানবাধিকার হতে বঞ্চিত করার মাধ্যমে নিমর্মতার শেষ সীমানাটুকু অতিক্রম করেছে মায়ানমার সরকার।

মায়ানমার সরকারের নিপীড়ণের সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রোহিঙ্গা বিরুদ্ধে রাখাইনসহ অন্যান্য বৌদ্ধ আরাকানীদের উস্কানি দিচ্ছে মায়ানমার সরকার। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে বৌদ্ধ মৌলবাদকে সরাসরি ইন্ধন ও মদদ যোগাচ্ছে মায়ানমার সরকার।

মায়ানমার সরকারের মনে রাখা দরকার, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মাঝে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সুসংগঠিত অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। রোহিঙ্গাদের ক্রমাগত নিপীড়ণ করে ওদেরকে চরমপন্থার দিকেই ক্রমশ ঠেলে পাঠাচ্ছে মায়ানমার সরকার।

মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফেরার পর রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার যেন আরো বাড়লো। নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিক অধিকার রক্ষা ও বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে আনার কথা বলে রাজনীতি করে এসেছেন। কিন্তু গত তিন বছর ধরে উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ গণহত্যা চালালেও অং সান সুচি মুসলমানদের রক্ষায় একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। বরং তিনি সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমানদেরকে স্বীকৃতি না দেয়ার পক্ষে নানান সাফাই গেয়েছেন।

বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা:

উপরে বলা হয়েছে, মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং আরাকান সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এটি সত্য যে, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের আরাকানের উত্তরাঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসী। কিন্তু তারপরও অর্ধশতাব্দী ধরে, মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে 'পুশ ইন' করেছে।

◘ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা দখল করলে বার্মিজ জাতীয়তাবাদী ও জাপানীরা মিলে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, জাতিগত ধোলাই শুরু করে। এসময় প্রায় পঞ্চাশ হাজার রোহিঙ্গা ভারত উপমহাদেশের বিভিন্নি অঞ্চলে পালিয়ে আসে।

◘ জেনারেল নে উইনের সময় আশির দশকে আদমশুমারির সময় রোহিঙ্গাদের বিদেশী ঘোষণা করে নিপীড়ণ করা। এসময় প্রায় দুই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। উদ্বাস্তুরা গণহত্যা, ধর্ষণ, সন্তান চুরিসহ নানান ধরণের জাতিগত ধোলাইয়ের অভিযোগ আনে।

◘ ১৯৯১-৯২ সালে The State Law and Order Restoration Council (SLORC) এর মাধ্যমে মায়ানমার সরকার উত্তর রাখাইন স্টেটে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দমনের নামে রোহিঙ্গাদের জাতিগত ধোলাই শুরু করে। এসময় মায়ানমারের সৈন্য ও স্থানীয় রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, শিশু চুরি, গ্যাটোতে স্থানান্তর, মসজিদ ভেঙে দেয়া, ধর্মপালনে বাধা দেয়া, বাংলাদেশে পুশ ইনসহ সামরিক ক্যাম্পে বাধ্যতামূলক শ্রমে বাধ্য করে। এসময় বাংলাদেশে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে।

◘ এছাড়া, আশির দশক হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতিনিয়ত মায়ানমার সরকারের নিপীড়ণের শিকার হয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।

জাতিসংঘ ও আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের চাপে মায়ানমার সরকার কিছু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিলেও তা সংখ্যায় অতি নগণ্য। এছাড়া, ফেরত নেয়া রোহিঙ্গাদের আগের মতই নিপীড়ণ করছে মায়ানমার সরকার। ফলে, পরিস্থিতি আগের মতই রয়ে গেছে। এখনো অসংখ্য রোহিঙ্গা মায়ানমার সরকারের নিপীড়ণের শিকার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।

এই নিপীড়িত রোহিঙ্গারা সহজেই বাংলাদেশের মুসলিম জঙ্গি গোষ্টীর শিকারে পরিণত হয়। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের আরাকানে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো এদের জঙ্গি হিসেবে রিক্রুট করে। বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মীদের একটি বড় অংশ রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গা ইস্যু, ২০১২:

দুই তিনজন রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারী এক রাখাইন নারীকে ধর্ষণ ও হত্যাকে কেন্দ্র করে জুন, ২০১২ তে শুরু হয় রাখাইন-রোহিঙ্গা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক পর্যায়ে, মায়ানমারের সামরিক বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধ মৌলবাদীরা মিলে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত ধোলাই শুরু করে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ছাড়া নিপীড়িত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ সরকারের নতুন করে আরো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণের অনিচ্ছার কারণে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে না। তবে, বাংলাদেশ সরকার বিজিবির মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যতটুকু সম্ভব মানবিক সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু দুর্গম সীমান্ত দিয়ে ঠিকই হাজার হাজার নিপীড়িত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।

২০১২ সালের দাঙায় মারা যায় প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা এবং গৃহহীন হয় প্রায় লক্ষাধিক রেহিঙ্গা।

রোহিঙ্গা সংকট যেভাবে শুরু

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ছিল মিত্র বাহিনীর পক্ষে। ১৯৪২ সালের মধ্য জানুয়ারির দিকে জাপান বার্মা আক্রমণ করে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র বার্মায় জাপানি সেনাদের হাতে অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তখন প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে চট্টগ্রামে ঢুকেছিল। এছাড়া আরাকানের স্থানীয় রাখাইনদের ( বৌদ্ধ মগদের) সঙ্গে এসব উদ্বাস্তু মুসলিম রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু দাঙ্গাও হয়েছিল।

১৯৪৬ সালের মে মাসে রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করেন। তাদের প্রস্তাব ছিল রাখাইন প্রদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করে বুথিডং ও মংদৌ নামে দুটি শহরের একত্রীকরণ। এর দুই মাস পর রোহিঙ্গা মুসলিম নেতৃত্ব আকিয়াবে নর্থ আরাকান মুসলিম লীগ গঠন করে। তখন রোহিঙ্গা মুসলিমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আলাদা প্রদেশ হিসেবে বার্মা থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই স্বাধীনতার দাবি ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যায়। ১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৮ সালে জেনারেল নে উইন বার্মার রাখাইন প্রদেশে মুসলিম সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের দমন করতে ‘অপারেশন কিং ড্রাগন’ পরিচালনা করে। সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের কারণে মিয়ানমারের মূল কেন্দ্র থেকে উত্তর-পশ্চিমের রাখাইন প্রদেশ বা আরাকান অঞ্চল কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এই সুযোগটি ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলো।

রোহিঙ্গাদের ওপর দীর্ঘ নিপীড়নের ইতিহাস

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় সকল প্রকার নাগরিক ও মৌলিক সুবিধা হতে বঞ্চিত রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারে ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য পরিচয় পত্র থাকাটা খ্বু জরুরি বিষয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিচয় পত্র ইস্যু করে না, ফলে, এমনিতেই পিছিয়ে পড়া রোহিঙ্গারা আরো পিছিয়ে পড়ছে।

মিয়ানমার সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুসারে বিদেশিরা কোন সম্পত্তি ও ভূমি মালিক হতে পারে না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে অবৈধ অভিবাসী তথা, বিদেশি। তাই, রোহিঙ্গারা কোন ভূমি বা, স্থায়ী সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে যেসকল ভূমিতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে, মিয়ানমার সরকার যেকোন মুহূর্তে সেগুলো দখল করে নিতে পারে।

মিয়ানমার সরকার আইনের মাধ্যমে রীতিমত অসহনীয় করে তুলেছে রোহিঙ্গাদের জীবন। রোহিঙ্গারা সরকারি চাকরি করতে পারে না, সরকারি কোন দপ্তরে রোহিঙ্গা কোন সেবা পায় না, ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুত, পানি, জ্বালানী) জন্য আবেদন করতে পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। প্রায় ৮০% রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত।

প্রায়ই মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা নিপীড়ণের খবর পাওয়া যায়। রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে খাটানো হয়। প্রায়শ স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধন, সরকারি জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়। এর মধ্যে প্রাচীন কিছু মসজিদও আছে। অনেক রোহিঙ্গাদের ব্যবসায় দখল/বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য ‘গ্যাটো' জাতীয় বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কয়েকটি বিশেষ বসবাসের স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা থেকে ওরা অনুমতি ছাড়া বের হতে পারে না। সেই গ্যাটোগুলোর ভিতরে আবদ্ধ মানবেতর জীবনযাপন করে রোহিঙ্গারা। চিকিৎসা, শিক্ষা ও উপযোগ সেবার ব্যবস্থা এই গ্যাটোগুলোতে থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ও নিম্নমানের।

রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার জন্যও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেয়া লাগে। এছাড়া দুটোর বেশি সন্তান নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করায় ও দুজনের বেশি সন্তানের জন্ম দেয়ায় রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তানদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার। এইসব পরিবারের সন্তানরা সরকারের ‘গ্যাটো ব্যবস্থা' তালিকাভুক্ত নয়, ফলে, এদের জীবন ফোঁড়ার উপরে বিষ ঘা এর মত। এরা গ্যাটোগুলোতে থাকতে পারে না।

আবার, গ্যাটোর বাইরেও থাকতে পারে না, কারণ, মিয়ানমারের নাগরিক নয় ওরা। অবস্থাটা ওদের এমন যে, মিয়ানমার সরকার ওদের কোন অস্তিত্বই স্বীকার করে না। এইসব পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের পথে পা বাড়ায়। নৌপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা ঢুবে মারা গেছে।

বিগত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশ ইন করছে। রুটিনমাফিক নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে। বর্তমানে সাত লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় বসবাস করছে। যদিও রিফিউজি হিসেবে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরো কম। রোহিঙ্গাদের প্রতি যা করছে মিয়ানমার সরকার, তা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধেই অপরাধ। এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আরাকানে বিকশিত হতে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সুবিধা না দেয়া, গ্যাটো সৃষ্টি করে সেখানে অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা, বিচারবর্হিভূতভাবে গ্রেফতার করা, মালিকানাস্বত্ব, সার্বজনীন শিক্ষা, চিকিৎসা, উপযোগ সেবা ও মৌলিক মানবাধিকার হতে বঞ্চিত করার মাধ্যমে নিমর্মতার শেষ সীমানাটুকু অতিক্রম করেছে মিয়ানমার সরকার।

নতুন করে ভয়াবহ মুসলিম নিধন অভিযান

যুগ যুগ ধরে মুসলিম নিধনের ধাবাহিকতায় গত ৩ জুন থেকে পূর্ব পরিকল্পিত ইতিহাসের নৃশংসতম এ গণহত্যা শুরু করেছে সন্ত্রাসী রাখাইন বৌদ্ধরা। রোহিঙ্গাদের হাতে বৌদ্ধ মহিলা নির্যাতনের অজুহাতে তারা এ গণহত্যার সূচনা করে। শুরুতেই কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী বৌদ্ধরা ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে শহীদ করে। গত রোববার দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের তুয়ানগোকিতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মুসলিম রোহিঙ্গারা জুমুয়াবার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করলে ভয়াবহ দাঙ্গা বেঁধে যায়।

মিয়ানমারের আকিয়াব শহরের রামবী গ্রামের এক রাখাইন শিক্ষিকা কর্তৃক ছাত্র পিঠানোকে কেন্দ্র করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের গালিগালাজ ও উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, এতে এক শিক্ষিকা মারা যায়। এরই জের ধরে আকিয়াব শহর থেকে গাড়িযোগে একদল রোহিঙ্গা মুসলিম ইয়াঙ্গুন যাওয়ার পথে ৩ জুন টংগু নামক স্থানে পৌঁছলে রাখাইন যুবকেরা গাড়ির হেলপারসহ ১০ রোহিঙ্গা মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা করে। ড্রাইভার কৌশলে পালিয়ে গিয়ে টংবু ইমিগ্রেশনকে অবহিত করে।

নির্মম এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে ৫ জুন বাদ যোহর ও আছরের নামায শেষে মুসলমানরা ইয়াঙ্গুন শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ ঘটনায় মুসলিম অধ্যুষিত পুরো আরাকান রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইয়াঙ্গুনে শীর্ষ মুসলিম নেতারা বৈঠক করে। ৮ জুন শুক্রবারে জুমুয়ার নামাযে মুসলমানদের জমায়েত করে শান্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ৮ জুন পুরো আরকানে জুমুয়ার নামাযে মুসল্লীরা সমবেত হতে থাকে। মংডু শহরের মসজিদে জুমুয়ার নামায চলাকালে মংডুয়ে বৌদ্ধদের ইউনাইটেড হোটেল থেকে মসজিদে ও মুসল্লীদের উপর পাথর নিক্ষেপ শুরু করে ।

অতঃপর রাখাইন বৌদ্ধরা সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের উপর হামলা শুরু করে। হাজার হাজার মুসলমানদের শহীদ করা শুরু করে। মসজিদ-মাদরাসা, ঘর-বাড়ি পোড়ানো শুরু করে। সরকারি মদদে কারফিউ জারি করে সেনা, পুলিশ ও নাসাকা বাহিনীর উপস্থিতিতে রাখাইন বৌদ্ধরা মুসলমানদের গণহত্যা চালাচ্ছে। সংঘর্ষ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক এ দাঙ্গার যে খবরাখবর গণমাধ্যমে এসেছে তা খানিকটা একপেশে ও তথ্য গোপনের অপচেষ্টায় দুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। কারণ প্রকাশিত খবরে এ দাঙ্গার মূল ঘটনা আড়ালে চলে গেছে এবং দাঙ্গার প্রকৃত উৎসকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বৌদ্ধদের প্রাধান্য থাকায় দেশটির প্রচারমাধ্যম তাদের নিয়ন্ত্রণে। মুসলমান বা রোহিঙ্গাদের তেমন খবরদারি নেই সেখানে।

এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে এক বার্মিজ নাগরিক বলেছে, রোহিঙ্গা হত্যা একটি ভালো কাজ। এদিকে যাদের বিরুদ্ধে সম্ভ্রমহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার নেশায় উন্মাতাল হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর হামলা চালায় বৌদ্ধ রাখাইনরা। ধর্ষণের ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও এর প্রতিশোধ এত নির্মম হতে হবে? আবার একই প্রশ্নে জর্জরিত রোহিঙ্গারাও। হামলার প্রতিবাদে তারা কেন সশস্ত্র সংঘাতের পথ বেছে নিল? এ প্রশ্ন দুটোর উত্তর খুঁজতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আশ্রয় নেয়ার কোন বিকল্প নেই। ধর্ম ও জাতিগত বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মধ্যে এর উত্তর পাওয়া যাবে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক দাঙ্গার প্রকৃতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু হলেও তাদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা কখনও প্রকাশ করেনি মিয়ানমার সরকার। তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জাতিসংঘ নিযুক্ত মিয়ানমারের বর্তমান প্রতিনিধি ইয়ে মিয়িন্ট অংয়ের উদ্ধৃতি থেকে।

সে মুসলমান ধর্মানুসারী রোহিঙ্গাদের ‘বন্য ও বর্বর’ বলে উল্লেখ করেছে। তাছাড়া সেই ১৯৮২ সাল থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু বলে ঘোষণা করে আসছে। তাদের দেশটির নাগরিকত্ব দেয়া হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এরা বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি আদিগোষ্ঠী। এদের সঙ্গে মিয়ানমারের কোন সম্পর্ক নেই। সে মতামত প্রতিষ্ঠা করতে মিয়ানমার সরকার তাদের উপর এমন অমানবিক নির্যাতন চালায়, যাতে করে তারা দেশ ছেড়ে পালায় অথবা দাসত্ব স্বীকার করে নিতে বাধ্য

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭)