ঢাকা, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

রাজধানীতে 'সাদা প্রিমিও' আতঙ্ক

২০১৪ জুলাই ১৬ ১৫:১২:২৪
রাজধানীতে 'সাদা প্রিমিও' আতঙ্ক

নিউজ ডেস্ক : প্রিমিও ব্র্যান্ডের সাদা প্রাইভেটকার। তিন-চার যুবক সেই প্রাইভেটকারে ঘুরে বেড়ায় রাজধানীর বিভিন্ন ভিআইপি এলাকায়। সুযোগমতো গাড়ি থেকে নেমে আগলে দাঁড়ায় পথচারীদের। যুবকদের কারও হাতে থাকে দেশি অস্ত্র, কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিনিয়ে নেয় গহনা, টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। ছিনতাইয়ের শিকার তরুণী হলে ওখানেই শেষ হয় না তাদের অপারেশন। তরুণীদের প্রাইভেটকারে জোরপূর্বক তুলে নেওয়ার চেষ্টাও করা হয়।

সফল হলে পরে তরুণীর মুক্তিপণের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা পরিবারের কাছে দাবি করা হয়। রোজা ও ঈদ উপলক্ষে রাজধানীতে অভিনব পন্থায় দামি গাড়িতে এভাবেই ছিনতাই আর অপহরণ করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ। ইতিমধ্যে রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ধানমণ্ডিতে একাধিক তরুণ-তরুণী এই চক্রের কবলে পড়েছেন। ভুক্তভোগী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, প্রতিটি ঘটনায় একই ব্র্যান্ডের একই রঙের একটি গাড়ি ব্যবহার হয়েছে।

মূলত ভিআইপি এলাকার ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানকে টার্গেট করছে তারা। লোকলজ্জার ভয়ে অনেক তরুণী এই চক্রের কবলে পড়লেও অভিভাবকরা পুলিশকে অবগত করেননি। কিছু ঘটনায় থানায় অবশ্য মামলা হয়েছে।রাজধানীতে এই চক্রের ব্যাপারে সচেতন করতে কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে আলাদা পাতা খুলে চলছে সচেতনতামূলক প্রচার। ভুক্তভোগীদের বন্ধু-বান্ধব এসব প্রচার চালাচ্ছেন। একের পর এক এ ধরনের ছিনতাইয়ে উদ্বিগ্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।

ধানমণ্ডিতে এই চক্রের হাত থেকে এক তরুণীকে বাঁচানোর ঘটনায় সাহসী তরুণদের সংবর্ধনা দিয়েছেন পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি শেখ মারুফ হাসান। নিজ কার্যালয়ে ডেকে এনে সাহসী তরুণদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান তিনি।

রাজধানীর ধানমণ্ডির ৯/এ নম্বর সড়ক। ৮ জুলাই রাত ১২টার দিকে এই সড়কের পাশে খালি জায়গায় ফুটবল খেলছিলেন এলাকার কিছু তরুণ। তাদের মধ্যে আসিফ রহমান নামে একজন মোবাইল ফোনে কথা বলতে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ান। এ সময় তিনি হঠাৎ দেখতে পান রিকশারোহী তরুণ-তরুণীকে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই করা হচ্ছে। এর পর তিন অস্ত্রধারী ওই তরুণীকে টেনেহেঁচড়ে সাদা রঙের একটি প্রিমিও গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে। এমন দৃশ্য দেখে দৌড়ে খেলার মাঠ থেকে বন্ধুদের ডেকে আনেন আসিফ।

১০-১২ বন্ধু মিলে অস্ত্রধারীদের ধাওয়া করেন। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় অস্ত্রধারীরা। অবস্থা বেগতিক দেখে তরুণীকে ছিটকে ফেলে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। অস্ত্রধারীদের গুলিতে আহত হন আসিফ। তাকে দ্রুত প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পর স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শুধু ধানমণ্ডি নয়, গত দুই সপ্তাহে রাজধানীর গুলশান, বনানী ও উত্তরা এলাকায় সাদা রঙের প্রিমিও প্রাইভেটকার ব্যবহার করে একই স্টাইলে একাধিক তরুণীর কাছ থেকে গহনা, টাকা, মোবাইল ছিনতাইয়ের পর অপহরণ করার চেষ্টা চালানো হয়। গুলশানে এক তরুণীকে অপহরণের পর তার পরিবারের কাছ থেকে দুুই লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে অপহরণকারীরা। এর পর ওই তরুণীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার শেখ মারুফ হাসান বলেন, ধানমণ্ডিতে তরুণীকে যারা অপহরণকারীদের হাত থেকে বাঁচাল, তারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। আত্মকেন্দ্রিক শহুরে সমাজ ব্যবস্থায় এমন উদাহরণ খুব একটা দেখা যায় না। তাই এ ধরনের ঘটনাকে উৎসাহিত করতে তাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। ছিনতাই ও অপহরণ ঠেকাতে পুলিশের তৎপরতা আগের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবীর বলেন, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ছিনতাই ও অপহরণের ঘটনা সম্পর্কে জেনেছি। দামি গাড়ি ব্যবহার করে যেসব চক্র এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে, দ্রুত তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

ভুক্তভোগীদের বন্ধু-বান্ধব ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রোজা শুরুর পর থেকে একটি চক্র দামি প্রাইভেটকার ব্যবহার করে তরুণীদের টার্গেট করে ছিনতাই করে আসছে। সম্প্রতি বনানী এলাকায় স্কলাসটিকার দুই শিক্ষার্থী ছিনতাইয়ের শিকার হন। অপহরণকারীরা প্রথমে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মানিব্যাগ, মোবাইলসহ সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। এর পর তাদের একটি প্রাইভেটকারে তুলে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে থাকে। একপর্যায়ে অপহরণকারীরা তরুণীর বাবার কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। শেষ পর্যন্ত দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দেওয়ার পর ওই তরুণীকে জিয়া কলোনি এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

একইভাবে গুলশান ৩৬ নম্বর সড়কে ছিনতাইয়ের শিকার হন আরেক ছাত্র। গুলশান ২ নম্বরে একইভাবে ছিনতাইয়ের শিকার হন এক দম্পতি। এই ঘটনায় তারা গুলশান থানায় একটি মামলা করেছেন। গুলশান ২ নম্বরে একটি বেসরকারি ব্যাংকের বুথের সামনে সম্প্রতি দুই তরুণী ও একই এলাকায় এক দম্পতি ?িছনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ফেসবুকে তাদের পরিচিতরা এসব ঘটনার বিবরণ দিয়ে অন্যদের সতর্ক করেন। সেখানে বলা হয়, 'গুলশান-বনানী এলাকায় বের হওয়ার আগে সাবধান থাকুন।'

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছিনতাই ও অপহরণকারী এই চক্রের সদস্যরা কালো গ্গ্নাসের প্রিমিও গাড়ি ব্যবহার করে। চক্রের সদস্যরা অধিকাংশ সময় গুলশান ২ নম্বর পাকিস্তান দূতাবাস সংলগ্ন সড়ক, মার্কিন দূতাবাসের পাশের সড়ক, গুলশান ১ নম্বরে পিৎজা হাট সংলগ্ন সড়ক ও বনানী এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর আগে উত্তরা এলাকায় একই স্টাইলে এক তরুণীকে তুলে নেওয়া হয়। পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, অপহরণকারী ও ছিনতাইকারী চক্র শনাক্তে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।

ধানমণ্ডি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ঘটনার শিকার তরুণ-তরুণীর মধ্যে সম্ভবত প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। থানায় অভিযোগ করলে বাড়িতে জানাজানি হওয়ার আশঙ্কায় তারা পুলিশকে জানাননি। তবে বিষয়টি শুনে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল।

(ওএস/অ/জুলাই ১৬, ২০১৪)