ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » ঘুরে এলাম » বিস্তারিত

বালি ভ্রমণ : পর্ব-৪

ধনীদের জন্য আলাদা বিচ ‘নুসাদোয়া’

২০১৯ মার্চ ০৯ ১৫:৪০:৩৪
ধনীদের জন্য আলাদা বিচ ‘নুসাদোয়া’

মুহাম্মদ সেলিম হক : যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের গড়া সৌন্দর্য্যরুপ এক কাতারে মিশে। সেখানে ভ্রমণ পিঁপাসু মানুষের ভিড় জমে। আল্লাহ প্রদত্ত সাগর আর সমুদ্র সৈকত এক পাশে অন্য পাশে পাহাড় পর্বত এ যেন সবুজ প্রকৃতি ও নীল জলরাশির মায়া খেলা ইন্দোনেশিয়ায়।

পাঠকের কাছে হাজির হলাম ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের চতুর্থ পর্ব নিয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপ রাষ্ট্র ঘুরে অনেক মজার তথ্য ও ঘটনা আমার ঝুঁলিতে। যা ক্রমান্বয়ে আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।

বালির পথে ঘাটে আজ টানা চার দিন । ক্লান্ত শরীর তবে মন ছিল চাঙ্গা ভাব। বেড়ানোর ইচ্ছায় কোন কমতি ছিলনা। তবে ওখানকার পরিবেশ, একেক সময় একেক জায়গায় বেড়ানো আর সময়ের আবর্তনে ঘুমের একটু ব্যাঘাত ঘটেছে। টানা কয়েক দিনে বালির পথঘাট, আশেপাশ এরইমধ্যে চেনাজানা হয়েছে অনেকটা।

৪দিন পর ভ্রমণের পর খরচ কমানোর ভাবনায় আমার সফর সঙ্গী সমীর বাবু কে নিয়ে শলা-পরামর্শ করলাম। কিভাবে কি করতে হয়। এমনকি অল্প টাকা খরচে কিভাবে অনেক দর্শনীয় জায়গা দেখা যায়!
হোটেল থেকে বের হয়ে এবার রাস্তা থেকে ভাড়া নিলাম গাড়ি। অনেক দরাদরি করে ১লাখ রুপিয়া কমে নুসাদোয়া আর পেনডোয়া বিচ দেখার জন্য চুক্তি করলাম। এবার ৬ ঘন্টার সময়ের জন্য নিলেন এক লাখ রুপিয়া। ড্রাইভার একটা সাদা কাগজে এগ্রিমেন্ট এ সাইনও নিলো। কেউ যাতে কথার বরখেলাপ না করতে পারে। আমাদের জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা ছিলো । কেন না বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ সিস্টেম রয়েছে কিনা জানিনা।

গাড়ি চলতে চলতে ড্রাইভারের কাছে জানাতে চাইলাম। সৌদি আরবের বাদশা সালমান বালির সফরের কথা। বাদশা সালমানের বালির সফরের শুরু হতে শেষ। সবই সে বলল আমরা ও জেনে নিলাম।
ড্রাইভার জানালো বছর খানিক আগে সৌদি কিং বালিতে সফরে আসেন। পুরো শহর তখন নিয়ন্ত্রণে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। জাকার্তা থেকে আসে নিরাপত্তা কর্মীরা। পুরা শহরের অলিগলি তখন নিরাপত্তার চাদরে ডাকা ছিল। নুসাদোয়া তিনটা বিচের সাথে ফাইভ স্টার হোটেল মোটেলও বুকিং ছিলো সব।

কথা শেষে প্রকৃতির দিকে খেয়াল হল। আজকের সকালের আকাশটা ছিলো একেবারে গম্ভীর। মেঘের আনাঘোনা চলছে আকাশে। বৃষ্টি হবে এমন ভাব তবে ভারি হবে না। এমনটা অভয় দিলেন ড্রাইভার। ওখানকার আবহাওয়াটা নাকি এ রকম থাকে প্রায়। টাকা কম দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে একটু বিড়ম্বনায়ও পড়লাম।

ড্রাইভার কোন একটা বিচে নামিয়ে দিয়ে বললো এটা নুসাদোয়া বিচ। একটু খড়কা লাগলো। এখানে সৌদি কিং আসলো! ১০ মিনিটে হাঁফিয়ে পড়লাম। প্যারাসুট আর বোটে ভ্রমণের সুযোগ ছিল। দামের কারণে বেড়াতে মন চাইলো না। জনপ্রতি পড়বে ৫ লাখ রুপিয়া। ভাবলাম কম টাকায় কক্সবাজার শহরে এর চেয়ে ভালো উপভোগ করা হবে।

ড্রাইভারকে বললাম, এটা ডার্টি বিচ। এটা আমাদের পছন্দ হয়নি। আমাদের অন্য বিচে নিতে। সে বললো এখানে নুসাদোয়া বিচ দেখা শেষ। অন্যটিতে চলেন আমি তার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়লাম। আমি এখানে কয়েক ঘন্টা থাকবো। যেহেতু আমার সময় আছে। এভাবে ৫ মিনিটের মতো চললো যুক্তিতর্ক। তাকে বললাম ১ লাখ রুপিয়া নিয়ে চলে যান। আমি অন্য গাড়িতে করে যাবো।

পরে ড্রাইভার কি যেনো ভেবে বাধ্য হয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ভিআইপি রোডে প্রবেশ করলো। গাড়ি চলছে অন্য বিচে ট্যুরিস্টদের টিকেট কাটতে হল। পরে বুঝতে সহজ হলো ড্রাইভার ৮০ হাজার রুপিয়া বাঁচানোর কৌশলে আমাদের কে বোকা বানিয়ে ছেঁড়ে দিতে চেয়েছিলো। হয়তো টাকার লোভ সবখানে।

এ জন্য হোটেলের গাড়ি ভাড়া কয়েক টাকা বেশি হলেও ভালো বললো সমীর বাবু। বাংলা বুঝতে না পেরে ড্রাইভার মশায় ফেল ফেল করে অভিমানের দৃষ্টিতে থাকিয়ে রইলো। জানা যায়, নুসাদোয়া কে বলা হয় ধনীদের বিচ।

সবুজের সাথে কংক্রিটের ভাস্কর্য্যে নিখুঁত গাথুঁনী সৌন্দর্যময় যেন অপরুপ। অপুর্ব ছিলো ঝর্ণার ফোয়ারা গুলি। শব্দহীন গাড়ি চলা আর শত শত ট্যুরিস্টদের হাসির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো প্রকৃতির উদারতায়।
প্রায় ৪ কিলোমিটার মতো নুসাদোয়া বিচের সৌন্দর্য্যময় ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। গুগলে তথ্য খুঁজে জানলাম এখানে সব ফাইভ স্টার হোটেল এর সর্বনিম্ন রেইট বাংলার মুদ্রায় ৩৮ হাজার টাকা। হোটেল গুলোর নিমার্ণশৈলী অসাধারণ। যেন প্রকৃতি থেকে একটু এগিয়ে বা নিচে।

আগেই বলছি বালিতে অস্ট্রেলিয়ান ট্যুরিস্ট একটু বেশি। নুসাদোয়া বিচে এরা খেলে সাফারিং। সাগরের ঢেউ এর সাথে দুরে চলে যাওয়া। ভয়কে একেবারে নখের ডগায় রেখে জীবনের সেরা উপভোগ তারাই করছে।
সাদা বালি। স্বচ্ছ নীল পানির সাথে নীলের আবরণে সারি সারি গাছ। উঁচু নয় তেমন আবার বেশ বেঁটে ও নয়। কেবল চেয়ে থাকতে মন চায়। যেন চোখ ফেরানোর সুযোগটা দিবে না প্রকৃতির সাঁজানো এ সংসার। কয়েক ঘন্টা এখানে চলে গেল এভাবে ঢেরও পেলাম না।

গাড়িতে এসেই ড্রাইভারকে আনন্দ সূচক আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম ভেরি নাইস। তার ও চোখে মুখে আমাদের সন্তুষ্টিতে খুশি খুশি ভাব। আগের ঝগড়া কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের সাথে।
এবার গাড়িতে ওঠলাম। গাড়ি চলতে চলতে ড্রাইভার জানাচ্ছেন অনেক তথ্য। আকাবাঁকা পথে মিলছে শহরের এতিহ্যের কিছু চিহ্ন। বালি ভ্রমণের ক্লান্তিতে নিজের গলাকে সতেজ রাখতে ডাব খেতাম। ২০ হাজার রুপিয়ায় একটি ডাব। সারাদিনের আহার শেষ। আমি আর সমীর বাবু ডাবের পানি খেতে কাপর্ন্য করতাম না। রোজ রোজ ভ্রমনে এটা চলতো। দরাদরি করলে ১৫ হাজারে মিলে।

দুপুরবেলা নুসাদোয়া শেষে পেনডোয়া বিচে যাওয়ার পথে একটি বিষয় দেখে খুব অদ্ভুত লাগল। পাচঁটি ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রার্থানা ঘর এক জায়গায়। শুরুতে হিন্দুদের মন্দির, তারপর বৌদ্ধদের প্যাগোডা, খ্রিষ্টানদের গির্জা, ক্যাথলিকদের চার্চ, সবর্শেষ মুসলিমদের মসজিদ। বালিতে আসার পর প্রথম মসজিদ দেখাতে যোহরের নামায পড়ে নিলাম।

মাজাহাব ভিন্ন হওয়াতে নামাযের ভিন্নতা দেখতে হলো। এখানে মহিলাদের জন্য আলাদা নামায পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। যোহরের সময় অনেক মহিলা কে মসজিদে দেখলাম। সফরে থাকাতে যোহর ও আসর এর নামাজ এক সাথে পড়লাম।

পেনডোয়া বিচের পথে যেতে যেতে চোখে পড়লো ট্যুরিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। বিশাল আয়তন। ঐতিহ্য আর মূর্তির কারুকার্য্য বিশ্ববিদ্যালয় রুপকে আরো বাড়িয়ে দিল কয়েক গুণ। বালির হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীরা রপ্ত করছে ট্যুরিস্টদের মন জয় করার কৌশল। এজন্য বোধহয় ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর এক নাম্বার উদারতার দেশ।

দুপুর বেলার শেষ দিকে পৌঁছলাম পেনডোয়া বিচে। প্রবেশ পথে পাচঁটি বড় বড় দেবতার মূর্তির ছবি। এরা নাকি পাঁচ ভাই। ভারত থেকে আসলো ধর্মের প্রচারনায়। পাহাড়ের পাদ দেশে এ বিচের সৌন্দর্য্য যেন রুপকথা গল্পের মতো। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে পেনডোয়া বিচ। অনেকটা কক্সবাজার এর মতো।

পর্যটকদের জন্য সারি সারি বসার ছাতা। হেলিয়ে সাগর দেখা আগের বিচগুলোর চেয়ে ভালো মনে হলো।
সারাদিন বসলে দিতে হবে ৫০ হাজার রুপিয়া। সাথে হাত বাড়লে পাবেন সী-ফুডের সমারোহ সাজানো নানান খাবার। পাহাড় আর সাগর এক সাথে। কক্সবাজার বিচে পুরা মাস থাকলেও টাকা নেয়না।

প্যানডোয়া বিচকে করেছে অন্যদের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম। বেলা শেষে আরো মনোমুগ্ধকর করে তুলে সাগরের গর্জনে সাঁ সাঁ শব্দ। প্রকৃতি যেন সবগুলো নিজ হাতে যতœ সহকারে তৈরি করে দিয়েছে। বালির সাদাবালি আর স্বচ্ছ জলের স্পর্শ যেন পযর্টকদের নাড়া দেয়। হৃদয়ে লুকায়িত অনুভূতি গুলো শিহরিত হয়।
বার বার দেখতে মন চাই কিন্তু সময়ের চাকা ঘূর্ণায়মান। সময় বড় নিষ্ঠুর এ কারণে ডাক পড়ে ফিরে যাওয়ার...

চলবে....

লেখক : সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সংগঠক কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম।