ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক বিপ্লব একান্ত জরুরি

২০২১ এপ্রিল ২৩ ১৪:২৬:৪২
মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক বিপ্লব একান্ত জরুরি

আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অঙ্গীকার ও দেশপ্রেমের প্রতি যারা দায়বদ্ধ নয় তাদের কাছে দুর্নীতি ও লুটপাটসহ নানান সমাজ ও দেশবিরোধী কার্যকলাপ তাদের হৃদয়ে দাগ কাটে না । ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে যেকোনো অন্যায় ও অপরাধ করতেও তাদের বিবেকে বাঁধে না । দেশটা যে মুক্তিযুদ্ধের রক্তের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত হয়েছে, এটা তাদের মনেই নেই । মনে থাকার কথা নয় । আজ যারা সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেসব রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী----এদের অধিকাংশের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই । যারা মুক্তিযুদ্ধের কষ্ট দেখেছে, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করছে তারা দুর্নীতি ও লুটপাট করতে পারে না । আজকে দেশের মধ্যে যেসব মহাদুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নয় । যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, দু:খের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, দেশের সিংহভাগ দুর্নীতিবাজ লুটেরা স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তার পকেটে ঢুকে গেছে ! বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের মধ্যে নেই, ফলে তাদের প্রতি আমাদের কোন অনুযোগ নেই । আছে শুধু ধিক্কার । আমাদের আদর্শ, আমাদের চেতনা, আমাদের আশা-আকাঙ্খা, আমাদের মান-অভিমান-অনুযোগ সবকিছুই আওয়ামী লীগকে ঘিরে । আজ আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে যোজন মাইল দূরে অবস্থান করছে ।

আওয়ামী লীগের গর্ভ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আবির্ভাব । বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ----এই তিন মিলেই আওয়ামী লীগ । সেই আওয়ামী লীগের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে গোটা মুক্তিযোদ্ধা সমাজ চেয়ে আছে । কিন্তু তাদের কোনোই প্রতিক্রিয়া নেই । মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক উন্নতজীবনের আকাঙ্খা আজ মানবেতর জীবনে পর্যবসিত হয়ে গেছে । অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার মাথা গোঁজার ঠাই নেই । সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাদের কোনো মর্যাদা নেই । এইতো কিছুকাল আগে, ওমরা হজ্বে ষাটজন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হেফাজতি মোল্লাকে নেয়া হলো, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও নেয়া হলো না । সরকার প্রধানের বিদেশ সফরের সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতিবাজ-লুটেরা অনেকেই জামাই আদরে সফরসঙ্গী হয়, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও সে-সফরে নেয়া হয় না ! যে যৎকিঞ্চিত ভাতা দেয়া হয়, তাতে তাদের চিকিত্সা নিতেই তা খরচ হয়ে যায় । তার ওপর আছে তাদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি । ইদানীং রাজাকারগোষ্ষ্ঠী তাদের ওপর একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে । বলা চলে তারা (রাজাকাররা) প্রায় সবাই এখন আওয়ামী লীগ করে । গ্রামেগঞ্জে কিংবা শহরের সর্বত্র চলছে মুক্তিযোদ্ধা উৎপাটনের হলাহল ।

এটাই হলো আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অবস্থা । চারিদিকে দুর্নীতি ও লুটপাটের হোলিখেলা । সামাজিক মূল্যবোধে চরমতম ধস নেমেছে । মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধ হারিয়ে গেছে । সবকিছুই মূল্যায়িত হচ্ছে আর্থিক মাপকাঠিতে । সমাজের সৎ মেধাবী, ত্যাগী মানুষেরা অবমূল্যায়নের চরম শিকার হচ্ছে । দেশের প্রতি মমত্ববোধ আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে । মনে হয় যেন, বেছে বেছে খারাপ মানুষগুলোকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বসিয়ে দেয়া হয়েছে । বেকারত্বের অভিশাপে বিশাল শিক্ষিত যুবসমাজ দিশেহারা । দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে বলেও মনে হয় না । সবাই আজ বিভ্রান্ত । সবাই আজ মরীচিকার পানে অন্ধের মতো ছুটে চলেছে । আর এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ জঙ্গি অপশক্তির নিরব উত্থান ঘটছে । যেকোনো সময় তার মহাবিস্ফোরণ ঘটা অস্বাভাবিক নয় ।

দেশের চলমান সার্বিক রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ শুভশক্তি তথা দেশপ্রেমিক সৎ মেধাবী ও সাহসী মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে অশুভ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । এর বিকল্প পথ খোলা নেই । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংস্কৃতিক গণবিপ্লব যেসব অশুভশক্তির প্রতিবিপ্লবী অপচেতনায় কলুষিত হয়েছে, সেই হারিয়ে যাওয়া বিপ্লবকে আবার টেনে আনতে হবে----যে বিপ্লবের খরস্রোতে দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে । অন্যথায় বাঙালি জাতি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশ চিরতরে হারিয়ে যাবে ।

লক্ষ্য করুন, আগে গ্রামবাংলার সর্বত্র বিভিন্ন পালাপার্বন, জাতীয় দিবস, পহেলা বোশেখসহ প্রতিটি গ্রামীণ জনপদের মাঠে ও বাড়িতে নানান খেলাধুলা, যাত্রা ও পালাগানসহ হরেক রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হতো । সেসব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও খেলাধুলা নেই বললেই চলে । তদস্থলে প্রতি গ্রামে গঞ্জে জনপদে জেকে বসেছে অর্দ্ধশিক্ষিত কাঠমোল্লাদের ধর্মীয় ওয়াজ নসিহত । নানান কিংভূতকিমাকারি আরবী-ফার্সি ভাষার মসজিদ মাদ্রাসা ও এতিমখানা নামীয় প্রতিষ্ঠান । সেখানে ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় চার মৌলনীতি , জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু , জাতীয় পতাকা , জাতীয় সঙ্গীত তথা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে কোমলমতী শিশু-কিশোরদের মগজ ধোলাই করা হয় । মসজিদের খুতবা ও ওয়াজের নামে জনমনে দেশ-জাতি-প্রগতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয় । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলিকে কুফরি মতবাদ বলে সরলমনা মানুষের সামনে প্রচার করে তাদের দৈশিক চেতনাজাত মনোজগতকে বিষিয়ে দেয়া হয় ।

এককথায় ধর্মীয় অনুভূতির আচ্ছাদনে সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে রাজাকারি অপচেতনার মধ্যে নিয়ে আসার কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হচ্ছে । আমরা চাই, ধর্ম তার আপন অঙ্গনে আপন মহিমায় থাকুক । মানুষ তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌলিক শান্তিসুখের আশায় ধর্মকর্ম পালন করবে তাতে কারো মাথাব্যথা নেই । কিন্তু ধর্মের নামে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের জাতিত্ব, আমাদের ভাষা, ইতিহাস , ঐতিহ্য, সংস্কৃতি কৃষ্টি ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে তো দেয়া যায় না ।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন ঘটাতে হলে বাঙালি চেতনাকে সর্বাগ্রে জাগ্রত করতে হবে । প্রতি পাড়া মহল্লা গ্রাম গঞ্জ শহর নগর বন্দর তথা গোটাবাংলার সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের নানান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে । এসব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নানান অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির করে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে হবে । আমাদের এ বাংলা জনপদে বসবাসকারীদের আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষ হতে হবে----তারপর কে ধার্মিক হবে, কে হবে না----কে মুসলমান হবে, কে হিন্দু হবে, কে বৌদ্ধ হবে, কে খৃস্টান হবে, কে আর কী হবে, সেটা তার নিজস্ব বিশ্বাসের বিষয় । মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি জাতীয় রূপরেখা তৈরি করে এক্ষুনি কার্যক্রমটি পরিচালনা করা জরুরি বলে মনে করি ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।