ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বাঙ্গালির মুক্তির সনদ 'ছয় দফা'

২০২১ জুন ০৭ ১৬:৪৭:০২
বাঙ্গালির মুক্তির সনদ 'ছয় দফা'

নিউজ ডেস্ক : ৭ জুন, বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ নামে খ্যাত ঐতিহাসিক 'ছয় দফা' দিবস আজ। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। ঐ দিন আওয়ামীলীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জেসহ সারাদেশে পুলিশের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মজিবুল হকসহ ১১ জন শহীদ হয়েছিল।

পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা পেতে ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা তুলে ধরেন।সেখানে ছয় দফা গৃহীত না হলে শেখ মুজিব ঢাকাতে ফিরে আসেন এবং ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের সামনে ছয় দফা তুলে ধরেন।

কেন ছয় দফা?

‌ছয় দফা দাবি উত্থাপন পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাসে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রেরর সৃষ্টির পর থেকে পূর্বাঞ্চলের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ঔপনিবেশিক মনোভাব, এ অঞ্চলের জনগণ ও রাজনীতিবিদদের অবমূল্যায়ন, অর্থনৈতিক অবহেলা, সামরিক বৈষম্য ছয় দফার দাবিকে যুক্তিযুক্ত করেছিল।‌ রাজনৈতিকভাবে পূর্বপাকিস্তান অবহেলিত ছিল। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিক্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও পূর্ব পাকিস্তানকে কখনোই লাহোর প্রস্তাব ভিক্তিক স্বায়ত্তশাসনাধিকার দেওয়া হয় নি। ১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা ও গণমুখী সংবিধান প্রণয়নের কথা বললেও প্রায় একদশক লেগে যায় সংবিধান প্রণয়ন এবং সরকার গঠন করতে।এর মাঝেই ১৯৫২ সাথে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও যুক্তফ্রন্ট সরকার পূর্ণমেয়াদে সরকারে থাকতে পারে নি। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান 'মৌলিক গণতন্ত্র' নামক অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে বাংলার মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে ১৯৬০ এবং ১৯৬৫ সালে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে সামরিক দিক দিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল।

‌পাকিস্তানেরর প্রশাসনে প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্যমাত্র।আইয়ুব আমলের ৬২ জন মন্ত্রীর মধ্যে মাত্র ২২ জন ছিলেন বাঙ্গালি। জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব-পাকিস্তান অর্থনৈতিক ভাবে শোষিত, বঞ্চিত হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা। ১৯৬০-৬১ সাল থেকে ১৯৬৪-৬৫ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যয় হয়েছিল ৯৭০ কোটি টাকা,‌ বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছিল ২১৫০ কোটি টাকা।‌ সামরিক দিক দিয়েও পূর্ব-পাকিস্তান ছিল অবহেলিত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিক, নৌ এবং বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনীর অফিসার পদে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব-পাকিস্তানিদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তান সামরিক দিক দিয়ে অরক্ষিত হয়ে পড়ে।

‌রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক দিক দিয়ে শোষিত, অবহেলিত হবার পথ বন্ধ করে বাঙ্গালি জাতিকে মুক্তি দিতে পূর্ব-পাকিস্তানেরর স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শেখ মজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি প্রণয়ন করেন।

‌ছয় দফাঃ

১. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিক্তিতে পাকিস্তান হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির। প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিক্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলো হবে সার্বভৌম।

২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি এবং অবশিষ্ট ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে।

৩. দেশের দুই অঞ্চলের জন্য সহজে বিনিময় যোগ্য মুদ্রা থাকবে এবং লেনদেনের হিসাব রাখার জন্য দু'অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র ব্যাংক থাকবে। মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনা করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। অথবা দু'অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে,তবে এক অঞ্চলের মুদ্রা অন্য অঞ্চলে যেন পাচার হতে না পারে সেজন্য পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দু'অঞ্চলের জন্য দু'টি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

৪. সকল প্রকার কর ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে এবং আদায়কৃত অর্থের একটি অংশ ফেডারেল ব্যাংকে জমা দিবে।

৫. বৈদেশিক বাণিজ্য ও মুদ্রার ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর হাতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

৬. আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রদেশগুলো নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে আধাসামরিক বাহিনী বা অঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও পরিচালনা করার ক্ষমতা দেওয়া হবে।।

ছয় দফা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ছয় দফা কার্যকর হলে পূর্ব-পাকিস্তান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাররিক দিকে শোষণ, অবহেলার হাত রেখে মুক্তি পেয়ে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতো।

ছয় দফার প্রতিক্রিয়াঃ

লাহোরে ছয় দফা উত্থাপিত হবার পরদিনই পাকিস্তানিদের পত্রপত্রিকায়য় শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যা দেওয়া হয়।প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফাকে 'হিন্দু আধিপত্যাধীন যুক্তবাংলা গঠনের যড়যন্ত্র' বলে আখ্যা দেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) করাচিতে পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও সংসদীয় মন্ত্রী আব্দুল হাই চৌধুরি ছয় দফাকে 'রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা' বলে আখ্যা দেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুসলিম লীগ ৬ দফাকে 'পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার দাবি' হিসেবে চিহ্নিত করেন। ধর্মভিক্তিক দল জামায়াত-ই -ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলামী ছয় দফা প্রত্যাখ্যান করেন। পিপিপি সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয় দফাকে 'দেশ বিভাগের ফর্মুলা' হিসাবে আখ্যা দেন। মওলানা ভাসানী ছয় দফাকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে বর্ণনা করে একে অর্থনৈতিকভাবে অসম্পূর্ণ বলে প্রত্যাখ্যান করেন।

শেখ মুজিব ছয় দফাকে 'আমাদের বাঁচার দাবি' বলে আখ্যা দেন এবং দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিব সহ আরো ৩৪ জনের নামে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' দায়ের করা হয়।

পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছয় দফার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ছয় দফাকে বাংলার কৃষক, মজুর, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত তথা আপামর জনসাধারণের মুক্তির সনদ এবং বাংলার অধিকার আদায়ের নিশ্চিত পদক্ষেপ। ছয় দফা আন্দোলনে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দেয়, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।

এই আন্দোলন করতে গিয়ে বাঙ্গালি অধিকার সচেতন হয়, আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় যার প্রভাব পড়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। ড.কামাল হোসেন যথার্থই বলেছেন,"চূড়ান্তভাবে নির্ধারক নির্বাচনী ফলাফল ছিল শেখ মুজিব,আওয়ামীলীগ ও তাঁর ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষে জনগণেরর সুস্পষ্ট রায়।''

ছয় দফাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, ৬৯'এ গণঅভ্যুত্থান, ৭০'এ নির্বাচনে জয়লাভ, ৭১'এ স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ।।এজন্য বলা হয় ছয় দফা বাঙ্গালির মুক্তির সনদ, ছয় দফাতেই স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।

লেখক:
নুরুজ্জামান শুভ
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

(পিএস/জুন ৭, ২০২১)