ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

করোনাকালের শিক্ষাঙ্গন এবং আবুলের ছাগলবন্দি

২০২১ জুন ১০ ১৭:০৫:০৬
করোনাকালের শিক্ষাঙ্গন এবং আবুলের ছাগলবন্দি

রহিম আব্দুর রহিম


লেখার শুরুতে অনিবার্য একটি গল্প উপস্থাপন করছি। কোন এক গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তার ফসলি জমির আশেপাশে ছাগল-গরু চলাফেরা করতে দেখলেই ফসল নষ্টের অভিযোগ এনে আটক করতো। প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রামের কোন ব্যক্তি এধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারতো না। এক দিনের ঘটনা, গ্রামের এক হতদরিদ্র তার একটি ছাগল নিয়ে ওই ব্যক্তির জমির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। জমির মালিক তা দেখে দৌঁড়ে এসে ছাগলটাকে মালিকের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আটক করে ফেলে। হতদরিদ্র ছাগল মালিক তাকে অনুরোধ করল, তার ছাগলটি ফেরত দিতে। না, জমির মালিক দিচ্ছে না। নিরুপায় ছাগল মালিক গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি নালিশ আকারে জানাল। একত্রিত গ্রামবাসী সদল-বলে এর একটা বিহিত করার প্রস্তুতি নিল। জমির মালিকের বাড়ি সবাই হাজির, ক্ষুধার্ত ছাগলটি ভ্যা ভ্যা করছে। দরবার শুরু হল।

এক ব্যক্তি জমির মালিককে জিজ্ঞেস করল, কেন ছাগলটিকে আটক করা হয়েছে? এই কথা শুনে প্রভাবশালী ব্যক্তি চোখ পাঁকিয়ে বলল, দেখেন না, আমার ফসলি জমির আইল ধরে ছাগলটি যাচ্ছিল! তার এমন অযৌক্তিক কথা শুনে দরবারে উপস্থিত অন্য এক ব্যক্তি জমির মালিককে বললেন, ক্ষেতের আইল ধরে ছাগলটি যাচ্ছিল এতে কি ক্ষতি হয়েছে? এবার জমির মালিক উত্তর দিল, আমার ক্ষেতের ফসল যদি তার ছাগল খাইত? এ কথা শোনা মাত্র দরবারে উপস্থিত সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, ঠিকই তো, যদি ফসল নষ্ট করতো! এবার ছাগলের মালিক আগের চেয়ে শতগুনে বেকায়দায় পড়ল। কারণ, যেহেতু ছাগল অন্যায় করেছে, সাজা তো তাকে পেতেই হবে। হলও তাই। দরবারে রায় আসলো, এই ছাগল বিক্রি করে অর্ধেক টাকা, জমির মালিককে দিতে হবে, তাই হল। গল্পের সাথে আজকের বিষয়ের মিল-অমিল বিচারের দায়িত্ব পাঠক সমাজের।

আর সময় নষ্ট নয়, মূল আলোচনা। চীনের উহানে আবিষ্কৃত করোনা নামক অদৃশ্য এক রোগের হাতে পৃথিবী হাবুডুবু খাচ্ছে। এই রোগের ভাইরাস, কখন কোন পাশ দিয়ে কিভাবে আসছে তার কোন হদিস নেই। বিশ^ সওদাগর চীনের বাদশা করোনা তাড়াতে জারি করেছিলেন ‘লকডাউন’। অর্থাৎ ‘বন্ধাবস্থা’। শুরু হল পৃথিবী জুড়ে লকডাউনের মহাতান্ডব। বন্ধ হয়ে গেল স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চালু থাকলো বাকি সকল প্রকার কর্মকান্ড। দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাস ধরে প্রিয় স্বাধীন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচল। ঘুরছে না শিক্ষার চাকা।

প্রায় ৪ কোটি বিভিন্ন শ্রেণি, বয়সের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাদ্বার বন্ধ থাকায় কান্ডারহীন পরিবেশে সময় পার করছে। জুয়া, নেশা, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, হতাশার মত জীবন বিধ্বংসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে জাতির ভবিষ্যত। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে তাদের, যারা অনলাইন ক্লাসের জন্য পিতা-মাতার কাছ থেকে সারপ্রাইজ হিসেবে এনড্রয়েড মোবাইল পেয়েছে। হুজুকের দেশে বাঙালি জাতির ভাবি প্রজন্মের এই গ্রুপটি শিক্ষার নামে বাহারি প্রযুক্তিগত ক্রীড়া বিনোদন ও নীল জগতে প্রবেশ করেছে। আর যে গ্রুপটি অর্থের অভাবে একটি এনড্রয়েড মোবাইল ক্রয় করতে পারছে না, ওই গ্রুপের বড় অংশ একটি ফোননাগালে পাওয়ার নেশায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড চুরি, ছিনতাইর মত গ্যাং অপরাধে শামিল হচ্ছে। একটি শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যে পরিবেশ দেয়, তা কোন ভাবেই প্রযুক্তিগত পদ্ধতি দিতে পারে না। নীতি-নৈতিকতা এবং দেশাত্মবোধ সৃষ্টি হয় সামাজিকতার মাধ্যমে।

দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাসের ব্যবধানে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যে পরিবেশ পেয়েছে, ওই পরিবেশ নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এক অন্ধকার জগতের। সবকিছু মিলে বলতে দ্বিধা নেই, গত১৬ মাসের ব্যবধানে জাতিকেশত বছর পিছিয়ে পড়েছে।এর জন্য মূলত দায়ি কে? উত্তর সোজা-সাপটা, একটি জাতি-গোষ্ঠীর দিক নির্দেশক, বুদ্ধিজীবি, গবেষক, চিকিৎসক এবং রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভ বলে আলোচিত বিশ্ব মিডিয়া। যারা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব পরিমন্ডলের ভ্রান্ত পথ উত্তরণের দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। সেই দিক নির্দেশক পরিমন্ডলের ভুল নির্দেশনায় আজ পৃথিবীর অন্যতম উন্নয়নশীল ‘বাংলাদেশ’ আজ শিক্ষাদ্বার বন্ধ রেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। খুঁড়িয়ে চলছে বললাম এই কারণে, করেনা ইস্যুতে দেশের প্রতিটি সেক্টর যথাযথ চললেও, চলছেনা শুধুমাত্র শিক্ষা কার্যক্রম।

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে ওই দেশের উন্নয়ন শিকড় কোনভাবেই মজবুত থাকে না। বাংলাদেশে করোনাকালের শুরুতে সরকারের শিক্ষামন্ত্রীকে একটি মিডিয়ায় সংবাদ কর্মীরা এমনভাবে ঘিরে ধরেছিলেন যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না করা হলে যেন করোনার মহাসমুদ্রে দেশটা নিমিষে তলিয়ে যাচ্ছে। অথচ দীর্ঘ ১৬ মাসের ব্যবধানে ওই মিডিয়ার কোন সংবাদকর্মী দেশের অন্যান্য সেক্টরের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রেখে এবং করোনা থেকে রেহাই পাওয়ার মত কোন দিক নির্দেশনা দিতে পারছেনা। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সকল দেশই মহামারি বা কোন ক্রান্তিকালে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেন। যে কমিটি সকল প্রকার বাঁধা-বিপত্তি পাশ কাটিয়ে জীবন-যাত্রা সচল রাখার উপায় নির্ণয় করবেন।

মজার এবং হাস্যকর ব্যাপার, সৃষ্টকরোনাকালের লকডাউন এবং স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা ছাড়া জাতীয় কমিটি ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত আজ অবধি দিতে পারে নি। যখনই স্কুল-কলেজ চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখনই জাতীয় কমিটির ঘোষণায় করোনার প্রাদুর্ভাব মাত্রাতিক আকার ধারন করে। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখলে অতিদ্রুত গোটা জাতি করোনা সম্পর্কীয় সচেতনতায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মানতে শতভাগ সচেষ্ট হতো। এটা কোন মনগড়া কথা নয়, বিশে^র সকল ক্রান্তিকাল, মহামারি, দুর্যোগ, বন্যা, খরা, যুদ্ধ-বিগ্রহকালে ছাত্রসমাজ যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, তা ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। শুধুমাত্র করোনাকালে যাদের ভুমিকা শূন্যের কোঠায়।

বর্তমান সরকারের অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন ফিরিস্তি চাঁপা পড়ে যাচ্ছে করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায়। গ্রাম-গঞ্জের তৃণ পর্যায়ে সরকারের কোন উন্নয়ন ফিরিস্তি নেই। আছে শুধু নেতিবাচক সমালোচনা। কেউ বলছেন হেফাজতিদের গ্রেফতার করতে সরকার স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখেছে, কেউ বলছে ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচল করে রাখা হয়েছে, আবার কেউ বলছে, লাখপতি-কোটিপতিদের সন্তানদের লেখাপড়া তো আর বন্ধ হয়নি, ভিক্ষুক জাতি সৃষ্টি করতে সরকার ইচ্ছা করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন।

এর মাঝেই কেউ আবার বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেনসিটিভ জায়গা, এই অঙ্গনের একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হলে দায়ভার সরকারকে বহন করতে হবে, বিধায় সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন। যুক্তিতর্কে এটাও ওঠে আসছে যে, দীর্ঘ ১৬ মাসের ব্যবধানে যে ছাত্র সমাজ স্কুল চালু করার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে রাজপথ গরম করতে পারে নি, ওই ছাত্র সমাজ ইস্যুবিহীন সরকার পতনের আন্দোলন করবে তা নিন্দুকরা না বুঝলেও সরকার বাহাদুর ঠিকই বুঝতে পারছেন।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার-আলবদর, আল শামস কিংবা পাক হানাদার বাহিনীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফাঁকা পেয়ে স্কুল-কলেজগুলোতে যেমন ক্যাম্প করেছিলো, তেমনি করোনাকালে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের সকল গণযন্ত্রে ভাইরাস না ঢুকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে করোনা ভাইরাস ক্যাম্প করেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই করোনা ভাইরাস থেকে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে হলে এমন কিছু করা যায় কিনা?

ক) শিক্ষার্থীদের সিফট অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লাস চালুর ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে এলাকাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সমানুপাতিক হারে ক্লাসে বসানোর ব্যবস্থা।

খ) প্রত্যেক শিক্ষার্থী স স গ্রামে স্কাউট, গার্লস গাইড এবং রোভার এর আদলে স্বাস্থ্যবিধি নিজে মেনে চলবে এবং গ্রামের মানুষদের সচেতন করবে। এতে করে তাদেরকে নাম্বার প্রদান করার ব্যবস্থা করা।

গ) ২ সপ্তাহ পর পর বিষয় রুটিন বদলিয়ে পাঠদান পদ্ধতি চালু রাখা এবং হোম ওয়ার্ক করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ঘ) কোনভাবেই অটোপাশ নয়। প্রত্যেকটি শ্রেণি এবং পাবলিক পরীক্ষা বি সি এস আদলে সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবধানে এম সি কিউ বা লেখিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা।

ঙ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু থাকবে, তবে কোন শিক্ষার্থী ওপর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কড়াকড়ি নিষেধ না রাখা।

তবে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি পালনে বাধ্য করা। এতে করে সত্যিকার আগ্রহী এবং সাহসী শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করা এবং রাষ্ট্রীয় দায়ভার মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাসম্ভব। তবে কোন অঞ্চলে করোনার মত মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ওই অঞ্চলে ‘লকডাউন’র পরিবর্তে ‘স্থিতাবস্থা’ অর্থাৎ সুস্থ এলাকার লোকজনরা আক্রান্ত এলাকায় যাবে না, আক্রান্ত এলাকার লোকজনরা সুস্থ এলাকায় যাবে না।

এক এলাকায় আক্রান্তের জন্য সারাদেশের মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়টি নজরে আনা।কোনভাবেই একটি জাতির ‘মেরুদন্ড শিক্ষা’র কারখানা ‘শিক্ষাঙ্গন’ বন্ধ রাখা সমীচিন নয়। এক্ষেত্রে আর কোন কমিটির বাণী কিংবা দ্বার বন্ধের কারিগরদের সুপারিশ নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেই ঝুঁকি নিতে হবে। যাতে বাংলাদেশের প্রেসক্রাইব করোনাযুক্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশেরটেকনিক্যাল কমিটি গ্রহণ করে। এমনটাই সময়ের দাবি।

লেখক : শিক্ষক, গবেষক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।