ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

কথিত জ্বীনের তৈরী মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে ১৬১ বছর! 

২০২১ জুন ১১ ১৭:০৪:২০
কথিত জ্বীনের তৈরী মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে ১৬১ বছর! 

ফরিদুল ইসলাম রঞ্জু, ঠাকুরগাঁও : ঠাকুরগাঁওয়ে এক শিল্প নৈপুণ্যে তৈরী এক ঐতিহাসিক মসজিদ। ১৬১ বছর ধরে দাড়িয়ে আছে ঠাকুরগাঁওয়ের এই মসজিদটি। তৈরি করেছিলেন খোদাভীরু এক মহিয়সী নারী।এই মসজিদের পুকুরঘাটে বাঘ নাকি পানি খেত। পানি খেয়েই পাশের জঙ্গলে এক বিশাল গর্তে ঢুকে যেত। সঙ্গে কয়েকটা বাচ্চাও ছিল। বাঘের সঙ্গে আবার অনেক খরগোশও বাস করত। আর মসজিদটি নাকি তৈরি হয়েছিল এক রাতেই। জ্বীন-পরীরা সারা রাত জেগে এই মসজিদ বানিয়েছিল। অলংকরণ করা পুরু দেয়াল বানাতে গিয়ে শেষ হয়ে যায় রাত। দিনের আলোয় জ্বীন-পরীরা থাকে না, তাই গম্বুজের কাজ শুরু না করেই চলে যায় তারা। আর এভাবেই অসম্পূর্ণ থেকে যায় বালিয়ার চৌধুরী মসজিদের কাজ। ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে উত্তর দিকে পঞ্চগড় মহাসড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই ভুল্লিবাজার।

বাজার থেকে ডান দিকে তিন কিলোমিটার দূরে বালিয়া গ্রাম। সরু রাস্তা হলেও পাকা। দুই পাশে ঘন গাছপালা। গাছগাছালি ঘেরা লালচে স্থাপনা। উঁচু গম্বুজ উঁকি দিচ্ছে। ছায়ামাখা শান্ত পরিবেশ। সদর দরজা, খোলা চত্বর আর মূল দালান তথা নামাজঘর—এই তিন অংশ নিয়েই মসজিদ কমপ্লেক্স। ঢাকার মোগল স্থাপনাগুলোর সঙ্গে বেশ মিল।মসজিদটি কিন্তু এ রকম ছিল না। এর চারপাশটা ঘন জঙ্গলে গ্রাস করেছিল।

দেয়ালে শ্যাওলা, ইটের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রকমের জংলি গাছ। ছাদও ছিল না। এখন যে গম্বুজ আছে, সেটাও ছিল না। ছিল না কোনো দরজা-জানালাও। বৃষ্টিতে ভিজে মসজিদের ভেতরটা বেশ স্যাঁতসেঁতে থাকত। এককথায় এটা হয়ে উঠেছিল সাপের বসতবাড়ি । এই মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এটিকে নামাজ আদায়ের জন্য উপযুক্ত করা হয়। এর কাজ শুরু হয় ২০০৫ সালে। পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে মসজিদটি উদ্বোধন করা হয়। ’

আর এই মসজিদের পুনর্নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তরুণ ভাস্কর কামরুজ্জামান স্বাধীন। তিনি এই এলাকার চৌধুরী বংশেরই সন্তান। মূলত তাঁর পরিকল্পনায়ই মসজিদটি পুনর্নির্মিত হয়। ভগ্নদশা থেকে মসজিদকে আজকের এই অবস্থায় আনতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

মসজিদে কোনো পিলার নেই। একটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এটি। মসজিদের ভিত্তি পর্যন্ত এই প্রশস্ততা বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মের দেয়াল একেবারে নিচের দিকে ৭৪ ইঞ্চি চওড়া। মাটির নিচে সেটি আরো বেশি। আয়তাকার এই মসজিদ উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আর পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি দীর্ঘ। মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত। প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। মসজিদটিতে হাতে তৈরি ইটের সঙ্গে চুন-সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। লালচে ইট কেটে তৈরি করা হয়েছে নানা রকমের নকশা। অলংকৃত নকশাগুলো ঘণ্টা, আমলকী, কলস-বাটি ও পদ্ম আকৃতির। যা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা। দেয়ালে কোনো রকমের আস্তরণ নেই। সেই পুরনো অবয়বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওপরে তৈরি করা হয়েছে তিনটি সুউচ্চ গম্বুজ। মসজিদের প্রধান ফটকের দৈর্ঘ্য ২১ ফুট, প্রস্থ ৯ ফুট। বিশাল আকৃতির সদর দরজাটিই এ মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ রকম ফটকওয়ালা মসজিদ এ অঞ্চলে চোখে পড়ে না।

জানা যায়, জলপাইগুড়ি অঞ্চলের মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের অধীনস্থ শালবাড়ী পরগনার স্থানীয় বালিয়ার জমিদারকন্যা গুলমতি চৌধুরানিই মূলত এই মসজিদের নির্মাতা। তবে সব কর্মকাণ্ড তদারকি করতেন তাঁর স্বামী মেহের বক্স চৌধুরী। তাঁর পূর্বপুরুষ মোগলদের সঙ্গে এই এলাকায় আসেন বলে জানা যায়। স্বামীর আগ্রহেই ১৮৬০ সালের দিকে মসজিদ তৈরির কাজ শুরু করেন গুলমতি চৌধুরানি। এ জন্য দিল্লি থেকে নিয়ে আসেন কারিগরও। ১৯০৫ সালে মেহের বক্স চৌধুরী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত নানা ধাপে মসজিদের কাজ চলতে থাকে। এরপর নানা কারণে মসজিদটির কাজ আর এগোয়নি।

এ রকম বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রাচীন মসজিদ একেবারে ব্যক্তিগত চেষ্টায় পুনর্নির্মাণের ঘটনা এ দেশে বিরলই বলা চলে। চমৎকার এই মসজিদ একনজর ঘুরে দেখার জন্য প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন।

(এফ/এসপি/জুন ১১, ২০২১)