ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একজন উপদেষ্টা থাকা উচিত 

২০২১ জুন ১৬ ১৫:৪০:৫৪
প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একজন উপদেষ্টা থাকা উচিত 

আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে সমুন্নত রাখা, রাষ্ট্রীয় সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের চর্চা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের আর্থসামাজিক জীবনের অবস্থান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ পরামর্শ দেয়ার লক্ষ্যে তাঁর সার্বক্ষণিক একজন উপদেষ্টা থাকা প্রয়োজন বলে মনে হয় । কারণ এ পর্যন্ত যাদেরকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী করা হয়েছে তারা প্রতি পদে পদে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন । ঐসব মন্ত্রীরা জানেন না কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হয় । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নে তাদের সীমাহীন ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো । মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা, তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক জীবনযাপন সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই । অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মন্ত্রীদের অযোগ্যতার সুযোগ নিয়ে বা তাদের অগোচরে বা তাদের অন্ধকারে রেখে মুক্তিযুদ্ধ-চেতনাবিরোধী আমলা-কর্মচারীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু অবজ্ঞাই নয়, তাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহারসহ তাদের কাছ থেকে বিরাট অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয় ! কায়দা-কৌশলে নিজেদের বাবা দাদা শ্বশুরসহ অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয় ! এ ব্যতীত গত ক'বছর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের জন্য নির্মিত ক্রেস্টে প্রয়োজনীয় স্বর্ণ না-দেয়ার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটলেও এ-জালিয়াতির সাথে জড়িত আমলা-কেরানি-ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। এ নিয়ে বিদেশের কাছে আমাদের দেশের মর্যাদা দারুণ ক্ষুন্ন হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে হরিলুটের কারবার চলে আসছে ফ্রি-স্টাইলে ।

আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালযটির নামের সাথে জাতীয় চেতনা জড়িত থাকলেও দু:খজনক সত্য এই যে, বলা চলে এ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অমুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার থেকে এসেছে ! মনে হয়, কেউ যেন কোথায় বসে বেছে বেছে এমন লোকজনকে এ মন্ত্রণালয়ে পোস্টিং দিয়ে এমন সব অপকর্ম নির্দ্বিধায় করে চলেছে ! এমনও প্রমাণ রয়েছে যে, যুদ্ধাপরাধে ফাঁসিতে-ঝোলা আলবদর নেতা ও চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর এককালীন একান্ত সচিবকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়েছিল ! অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও রাজাকারদের উত্তরসূরিদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়টি পরিচালনা করার নামে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করার একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যে সম্মানী দেন, সেটিতে ভাগ বসানোর জন্যে এ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা কার্যালয়ের একশ্রেণীর কর্মকর্তা/কর্মচারীরা ইচ্ছেকৃত কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম ভুল বানানে লিখে তাদের ভাতা বন্ধ করার ব্যবস্থা করে । পরবর্তীতে নামের বানান সংশোধন বা শুদ্ধকরণের প্রক্রিয়ায় তাদের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয় ! এছাড়া বিগত কয়েকটি যাচাই বাছাই কার্যক্রমে যারা খ ও গ তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন, এমন সব ব্যক্তিকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার বহু উদাহরণ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকার কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী সৃষ্টি করেছে !

এ ব্যতীত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার রয়েছে এমন অভিযোগ দায়ের করা হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকার ঐসব দুর্নীতিবাজ ও রাজাকার সন্তানরা মনে মনে খুশি হয় । তারা অভিযোগকারীদের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণ করে গোপনে অভিযুক্তদের ডেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে সেসব অভিযোগকে ধামাচাপা দিয়ে দেয় । যেমন একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ঝিনাইদহ জেলার ২৪ রাজাকার মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম উঠিয়ে দীর্ঘ কাল সম্মানীসহ অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করে আসছে এ অভিযোগে ঐসব রাজাকারদের তালিকা করে ওখানকার একজন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার বেশ কয়েক বছর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে অভিযোগ করলে মন্ত্রী মহোদয় যথারীতি তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু দীর্ঘ ৫/৬ বছর অতিবাহিত হলেও মন্ত্রী মহোদয়ের তদন্তের নির্দেশ পালিতই হয়নি! আর এমন একজন মন্ত্রী বাহাদুর আমাদের যে, এমন গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কোনো মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেননি। এতে প্রমাণিত হয় যে, ঐ ২৪ রাজাকারের নিকট থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে তাদেরকে বহাল তবিয়তে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিগত যুগ যুগ ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নিদারুণ অবিচার অবহেলা অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে । ফলশ্রুতিতে তাদেরই ত্যাগ তিতিক্ষা শৌর্য্য ও বীরত্বে অর্জিত বাংলাদেশে তাদের অধিকাংশই চরম মানবেতর জীবন যাপন করতে করতে বর্তমানে মরণসাগর পাড়ে এসে পৌঁছেছে। অপর দিকে সরকারের মধ্যে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি পাষন্ড আমলাশক্তি মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের প্রতিও নানাভাবে বিরূপ আচরণ করেছে, শেষ পর্যন্ত জাতির পিতা প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছে! মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মেধা নেই বলে অনেক আমলা ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নির্দয় কথাবার্তা বলে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান দেখানোর ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করেছে, যা সহ্যসীমার বাইরে। অথচ প্রজাতন্ত্রের অনেক মেধাবী (!) সচিব আছেন, যারা অনেকেই মাতৃভাষা বাংলায় একটি সঠিক বাক্য লিখতে পারে না !

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে একটি ভুয়া সংজ্ঞা আবিষ্কার করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-জামুকা ও আমলারা যে কী নিদারুণ ব্যর্থতা অযোগ্যতা ও অপদার্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন তা দেখলে হতাশায় মন ভরে ওঠে । অপরদিকে মন্ত্রণালয় ও জামুকার অপরিণামদর্শিতায় গত কিছুদিন পূর্বে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে সর্বকালের সেরা নপুংসক সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তথাকথিত নির্বাচিত কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে, তাদের বিরাট অংশ সব সভ্যতা ভব্যতা ও নৈতিকতার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে বিভিন্ন স্হানে ভূয়াদের রক্ষা ও প্রকৃতদের অমুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করে অনৈতিক আর্থিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার কারণে পুরো কার্যক্রমটি ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিলো, যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে । সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই পুনরায় শুরু হলেও দেখা যাচ্ছে, জামুকা নামক আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা বানানোর কারখানার নেতৃত্বেই এখন যাকে-তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অপকর্মটি হচ্ছে । কিসের ভিত্তিতে তারা প্রায় প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েই চলেছেন, তা কেউ বুঝতে পারছেন না । মূলত: বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রদত্ত বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে ত্রুটিমুক্ত স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে বিচারবিভাগ, সামরিক বাহিনী ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে যাচাই বাছাই কার্যক্রমটি পরিচালনা করা উচিত ছিলো ।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সব অঙ্গন পরিচালিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও আর্থসামাজিক অবস্থান সম্পর্কিত বিষয়াদি সরকারকে ভেবে সে-অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি সেল গঠন করে, তাঁকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার লক্ষ্যে একজন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে বলে আমার ধারণা। এর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারেন। বিষয়টি গভীরভাবে মূল্যায়ন করার জন্য সরকারসহ মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক দেশবাসীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।