ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত

পথের ধুলো থেকে: পর্ব-২ 

মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের পরিবারকে শ্রদ্ধা জানাতে বাড়িতে বাড়িতে ফুল নিয়ে হাজির শিক্ষার্থীরা; সে কী আবেগঘন দৃশ্য!    

২০২১ জুলাই ০৯ ১৩:১১:৩৬
মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের পরিবারকে শ্রদ্ধা জানাতে বাড়িতে বাড়িতে ফুল নিয়ে হাজির শিক্ষার্থীরা; সে কী আবেগঘন দৃশ্য!    

সাইফুল ইসলাম


২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের সফলতা পর উৎসাহ আর দায়িত্ব দুটোই অনেক বেড়ে যায় আমাদের। অনেকেই এগিয়ে আসে পরামর্শ দিতে। কেউ বলেন, দোয়াটা করা প্রয়োজন। কেউ অনুরোধ করেন, অমুককে অতিথি করলে বিষয়টি আরবও জমজমাট হবে। কেউ বা কাজটি এগিয়ে নিতে তহবিল গড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। আমরা এসব পরামর্শ মাথায় নিয়ে ছুটি গণহত্যা স্থানের আশপাশের লোকালয়ে।

দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মধ্যে ‘জ্ঞান’ দেওয়ার একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছে। প্রায় সবাই, নিজ মাথায় থাকা ধারণা থেকে মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিত করে বক্তৃতা দেওয়া চেষ্টা করি। কেউবা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘গ-গোল’ হিড়িক’-এর তফাৎ বুঝানোর চেষ্টা করি। তবে শহিদ স্বজনের কাছে শোনার চেষ্টা করা হয়, কিভাবে তাঁর আত্মীয়-স্বজন শহিদ হয়েছেন। উঠে আসতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের বিয়োগাত্মক অধ্যয়। জানা যায়, শহিদের কবর খুঁড়ে মরদেহ আনতে গিয়ে না পাওয়ার কথা, পরে সে কবরকেই ‘শহিদ স্বজনের করর’ হিসেবে দীর্ঘদিন ‘দোয়া-দরুদ পড়া; পিতার লাশ কাঁধে নিয়ে শরীর রক্তে মেখে সাহস হারিয়ে ফেলা, পরে লোকজন নিয়ে এসে শিয়াল-কুকরে খাওয়া লাশ পাওয়া, স্বজনকে গণকবরে ঠাঁই করে দেওয়ার কথা। কোনো মেয়েটি একাত্তরে স্বামী হারিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে, অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর, কোনো সন্তান জন্ম নেওয়ার আগেই বাবা হয়েছেন শহিদ, ‘বাবার মুখ দেখার’ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি এখনো। কে স্বামী হারিয়ে সন্তানদের এতিমখানায় ভর্তি করে নিজে ভর্তি হয়েছেন নারী পূনর্বাসন কেন্দ্রে। চেষ্টা করেছেন একটি কাজ শিখে আয়-রোজগারের পথ করে নেওয়ার! এ সব কথা বলতে পেরে শহিদ স্বজন যেন হালকা হয়। সাধারণের মধ্যেও বাড়তে থাকে মন খুলে কথা বলার সাহস, স্বতঃস্ফূর্ততা। সংগঠকদের মধ্যেও শোনার একটা অভ্যাস গড়ে উঠতে থাকে। তবে কেউ কেউ ‘জ্ঞান’ দেওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ায় উৎসাহ হারিয়ে ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে পড়ে। তবে জনসমর্থণ থাকায় গতিহীন হয় না সংগঠন। কিছু আসে কিছু যায়, কিছু সংগঠক দীর্ঘস্থায়ী হয়।

সাধারণের মধ্যে থেকে আসতে থাকে নানা প্রস্তাব। দীর্ঘদিন বঞ্চিত শহিদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবই বেশি আসে। শোনা হয়, স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার নানা অভিজ্ঞতার কথা। প্রস্তাব আসে, জাতীয় ভাবে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালিত হয়। এর পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে, যেমন, ‘২৫ এপ্রিল চড়িয়া গণহত্যা দিবস’ ‘২৭ এপ্রিল বাহিরগোলা, বাজার স্টেশন, ধীতপুর গণহত্যা দিবস’ ‘১১ মে তেতুলিয়া-চুনিয়াহাটি গণহত্যা দিবস’ ‘১৭ মে শিয়ালকোল গণহত্যা দিবস’- এ ভাবে প্রতিটি স্থানীয় গণহত্যা দিবস পালন করা যেতে পারে সংশ্লিষ্ট এলাকায়। চমৎকার এ প্রস্তাব নিয়ে আমরা বিভিন্ন গণহত্যা অঞ্চলে আলোচনা করি। তারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থণ জানায় প্রস্তাবটিকে। অঞ্চলগুলি দিবসটি পালন করতে শুরু করে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী। এতে জনগণের মুখে মুখে প্রচার হতে থাকে, অমুক এলাকায় অতো তারিখে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাতে এতো জন শহিদ হয়েছেন। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসা গণহত্যাটি দিন-তারিখ-শহিদের সংখ্যা সহ উঠে আসতে শুরু করে জনতার মাঝে।

চমকপ্রদ এক উদ্যোগের খবর পাওয়া যায়, শিয়ালকোল অঞ্চলে। জানা যায়, সেখানকার বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলীর ছোট ভাই শহিদুল আলম ওরফে আলম মেম্বার প্রতি ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এ কাজটিকে মনে হয় নতুনত্ব আছে। আমরা সংগঠকেরা উদ্বুদ্ধ হই। এ কর্মসূচিকে কিভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় আমাদের মধ্যে। সাধারণের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে এক সময় কর্মসূচিটি পূর্ণতা পায়। শেষে কর্মসূচিটি দাঁড়ায় এমন- প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা (জীবিত ও মৃত) এবং শহিদ পরিবারকে স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসে ‘মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য’ ফুল দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু যাবে কারা? বিভিন্ন স্কুল-কলেজে প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু হয়। কর্মসূচির ধারণা শুনে তারাও সাড়া দেন স্বতঃফূর্তভাবে। ব্যবস্থা করে দেন স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার। তারাও সাড়া দেন দ্বিধাহীন চিত্তে। বসার সুযোগ করে দেন ছাত্রদের সঙ্গে। আলোচনার পর উৎসাহিত হয় শিক্ষার্থীরাও। সংগঠকদের মনে হয়, এ কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারকে যেমন সন্মানিত করা যাবে, তেমনি নতুন প্রজন্মকে করে তোলা যাবে মুক্তিযুদ্ধ চর্চায় আগ্রহীও। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা যখন দল বেঁধে যাবে তখন এলাকার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে নতুন আশাবাদ।

২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে সিরাজগঞ্জের প্রায় কুড়িটি স্কুল-কলেজকে সংগঠিত করা সম্ভব হয়। বিজয় দিবসে তাদের নিয়ে গঠন করা ১৫/২০ জনের একেকটি দল। কোনও টিম কোন রাস্তায় কার কার বাড়িতে যাবে, তার সমন্বয় করা হয় শিক্ষকদের নিয়ে। প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন শিক্ষকও থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষকেরা। ফুলের ব্যবস্থা করে স্কুল-কলেজের শিক্ষকবৃন্দ। বিশাল স্বপ্ন দেখা দিয়ে আসে বিজয় দিবস। সকাল আটটার মধ্যেই বেড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দল, কারণ জেলা প্রশাসন আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও যাবেন অনেকেই।

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পর্বের পরে এর প্রতিক্রিয়া জানতে আগ্রহী আমরা। সংগঠকেরা যাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে। দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা তো বটেই, শিক্ষকেরাও এ কর্মসূচি সফল করতে পেরে আবেগাপ্লুত। তারা বর্ণনা দেন, শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে গেছে সংশ্লিষ্টদের বাড়িতে বাড়িতে। তাদের হাতে হাতে একটি করে ফুল। সংশ্লিষ্ট বাড়িতে ঢুকে শিক্ষার্থীরা পরিবারের অনেকের সামনে বলেছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনাদের পরিবারের অবদান রয়েছে, এ জন্য আমরা নতুন প্রজন্মসহ পুরো জাতি কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এই বিজয় দিবসে আমরা এসেছি।’ বাড়ির লোকজন শিক্ষার্থীদের হাতের ফুল পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। সব বাড়ি থেকেই ওরা পায় আন্তরিক আপ্যায়ন। কোনও বাড়িই কিছু না খাইয়ে ওদের ছাড়েনি। শিক্ষার্থীরাও অভিভূত এমন উষ্ণ আন্তরিক ব্যবহার পেয়ে। তারা আসতে আসতে বলাবলি করে, এমন কাজ তারা আরও আগে কেন শুরু হয়নি। সাধারণ মানুষও এমন কাজের জন্য সাধুবাদ জানিয়েছে শিক্ষার্থীদের। বেড়েছে স্কুল-কলেজের সুনাম।

বিষয়টি নিয়ে ব্যপক আলোচনার জন্ম দেয় সিরাজগঞ্জের মনসুর আলী অডিটোরিয়ামে আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতার এক পর্যায়ে সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. হোসেন আলী হাসান বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এতো আবেগাপ্লুত আর কখনো হননি তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিল তার বাসায় গিয়েছিল একদল শিক্ষার্থী। নতুন ছেলেমেয়েদের এ অভিনন্দন পেয়ে তিনি অভিভূত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যদি মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এ রীতি সারাদেশে চালু করতে পারে তবে স্বাধীনতা বিরোধী কোনও ষড়যন্ত্রই আর টিকবে না বলে তাঁর বিশ্বাস। স্বাধীনতা বিরোধীরা পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাবে না।’

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক।