ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত

পথের ধুলো থেকে: পর্ব-৩

'শহিদ পরিবার সমাবেশে বেশ কয়েকজনকে পাওয়া যায়, যাদের জন্ম নেওয়ার আগেই পিতাকে উৎসর্গ করতে হয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য'

২০২১ জুলাই ১১ ১৬:৩৯:২০
'শহিদ পরিবার সমাবেশে বেশ কয়েকজনকে পাওয়া যায়, যাদের জন্ম নেওয়ার আগেই পিতাকে উৎসর্গ করতে হয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য'

সাইফুল ইসলাম


প্রতিটি চিন্তা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হইসিস্ত। সাধারণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার চিন্তাও এর ব্যতিক্রম নয়। এই চিন্তাটি নেতা নির্ভর হতে চায়নি, হতে চেয়েছে জনগণ নির্ভর। চেনা পথের বাইরে এসে হতে চেয়েছে জনগণ এবং সংগঠকদের নিজস্ব সামর্থ্য নির্ভর। আবার এটাও বলার সুযোগ যেন কেউ না পায় যে, ‘সংগঠন’ করতে এসে ‘পথে বসে গেছি।’

‘একাত্তরের গণহত্যায় নিহতদের শহিদের মর্যাদা দাও’ স্লোগান, পঁচিশ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে গণহত্যা স্থান, যুদ্ধস্থান ও শহিদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কর্মসূচিকে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে চলতে থাকে গ্রাম-মহল্লায় বৈঠক। তাতে উপস্থিত থাকেন শহিদ পরিবার এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তারা। বেঠকে অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকেন তারা। শহিদ পরিবারের সদস্য এবং সাধারণের আলোচনায় সংগঠকদের মনে হতে থাকে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাধারণের মধ্যে অভিমান মিশ্রিত ক্ষোভ আছে, আছে প্রচণ্ড আবেগ। সংগঠকেরা সুযোগ দেন তাদের ক্ষোভ প্রকাশের। মু্ক্তিযোদ্ধাও যুক্ত করার চেষ্ঠা শুরু হয় এ পর্যায়ে। কারণ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার অপূর্ব সমন্বয়ের ফলেই সহজ হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ। অথচ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে জনগণ এখন মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধারা ক’দিনই বা যুদ্ধ করেছেন, তাদের এত সন্মানী, সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে কেন? অনেকে মনে করেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়লেও ‘বাড়ির পাশে ছাগল চড়িয়ে খাওয়া’দের নামও এসেছে তালিকায়। আর শহিদ পরিবারের তো কোনও অবস্থানই নেই। তারা স্বজন হারিয়ে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অবস্থায় টিকে আছে। শহিদ পরিবার ও জনগণ সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধারাও কেউ কেউ মনে করেন, নিজেদেরই ঠাঁই হয় না, আবার ‘লস্করের মা’কে টানবো কখন!

জনগণের ক্ষোভের কারণ বোঝা খুব কঠিন নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশাল স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এ থেকে হতাশা ছড়িয়েছে জনগণের মধ্যে। স্বাধীনতা বিরোধীরাও টিকে থাকার সুযোগ পেয়ে এখনো উস্কে দিচ্ছে সে হতাশাকে। বাঙালি জাতির বটবৃক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সেক্টর কমাণ্ডার জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে নিজেদের ‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’ মনে করতে ব্যর্থ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে এক ধরণের হতাশা তাদের মধ্যে বাসা বেঁধে জন্ম দিতে থাকে ‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে’র। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে বুঝতে পারেন যে, মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ না করে এ দেশের রাজনীতিতে দাঁড়ানো কঠিন। তখন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসা করে বক্তৃতা দিতে থাকেন। কারাগার থেকে মুক্ত করেন অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের আখ্যা দেন ‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’। এতে ফল হয় উল্টো, অনেকের মধ্যেই জন্ম নেয় ‘সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স্।’ কেউ ভাবেন, এটাই উপরে ওঠার সিঁড়ি, যা জনগণ থেকে বিচ্ছিহ্ন করে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের। আর বিজয়ের পর পর জনগণ বা শহিদ পরিবারের সদস্যদের খোঁজ কিছুদিন নেওয়া হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা ভুলে গেছে রাষ্ট্র ও সমাজ। এ সব ধারণা থেকে সবাইকে কথা বলা বা ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ করে দিতে চায় সংগঠকেরা।

বিভিন্ন বৈঠক থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব আসতে থাকে। তার মধ্যে দুটি প্রস্তাব আমলে নেয় সংগঠকেরা। এক. তাদের কথাকে লিপিবন্ধ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করা এবং দুই. শহিদ পরিবার সমাবেশ করা। ‘শহিদ পরিবার’ ‘সাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ’ ‘মুুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধস্মৃতি’ ‘গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ ‘স্কুল ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তা নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে সিরাজগঞ্জের স্থানীয় পত্রিকাগুলিতে।

দ্বিতীয় প্রস্তাব ‘শহিদ পরিবার সমাবেশ’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয় বিভিন্ন বৈঠকে। সংগঠকদের কথা, এখন সমাবেশ মানেই তো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাকড়ি, লোক আনা-নেওয়া, খাওয়া-দাওয়ার খরচ। এত টাকা তো সংগ্রহ করতে পারবে না সংগঠকেরা। শহিদ পরিবার ও জনগণের কথা, তারা নিজেরাই যাতায়াতের খরচ জোগাবে। সমাবেশে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলে চাল-ডাল জোগাড় করে দেবে তারা। সবার এ সব প্রতিশ্রুতিতে সাহসী হয়ে ওঠে সংগঠকেরা। ঠিক হয় সিরাজগঞ্জের শহিদ এম মনসুর আলী অডিটোরিয়ামে করা হবে এ সমাবেশ। সমাবেশের তারিখ নির্দ্ধারণ হয় ১৩ অক্টোবর, ২০১৮।

বৈঠক হতে থাকে বিভিন্ন গ্রাম মহল্লায়। এক ধরণের আগ্রহ সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে, কারণ, এমন বিনি-পয়সার আয়োজন তারা দীর্ঘদিন ধরে নেন না। বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতাকর্মী মনে করেন, ‘রাজনীতি করতে টাকার প্রয়োজন’ তা সংগঠকদের জোগাড় করার সামর্থ্য নেই। আবার সমাবেশে কোনও তারকা অতিথিও নেই, তাই তাদের আগ্রহ ‘শহিদ পরিবার সমাবেশ’ কেমন হয় তা দেখার। নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো হয় সাদামাটা, তা পৌঁছানো হতে থাকে জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়নসহ শ্রমজীবী-পেশাজীবী সংগঠনে। অর্থ জোগাড়েও সমস্যা হয় না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছে নিমন্ত্রণপত্র নিয়ে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল ইসলাম জগলু চৌধুরী। তিনি উদ্যোগের প্রশংসা করেন। স্থানীয় এমপি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হাবিবে মিল্লাত মুন্না এমপির কাছে যান সংগঠকদের আহ্বায়ক ও নব কুমার কর্মকার। তিনি বললেন, এত বড় হল নিয়েছেন, লোকজন আসবে কোথা থেকে? তবে তিনি এমন উদ্যোগের প্রশংসা করে সমাবেশে আসার প্রতিশ্রুতি দেন। জগলু চৌধুরী ও নব কুমার কর্মকার যান সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের কাছে। তিনি মজা করে বলেন, সমাবেশের শোঁ-সাঁ তো ভালোই শুনি, অর্থ পাচ্ছেন কোথায়? – আপনি দেবেন। তিনি তখনই দশ হাজার টাকা ব্যবস্থা করে দেন। সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ সূর্যর কাছে যাওয়া হলে তিনিও নিজ আগ্রহেই পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করে দেন। এক হাজার, দুই হাজার করে পাওয়া যায় অনেকের কাছে থেকেই, কারো কাছে চাইতে হলো, কেউ কেউ নিজে যেচে দিলেন। শহিদ পরিবারের খাদ্য-ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফজলু এবং শহিদ পরিবারের সন্তান মঞ্জুরুল ইসলাম রুবেল। তারা আয়োজন করলেন ডিম-খিচুড়ির। এভাবেই সম্পন্ন হলো শহিদ পরিবার সমাবেশের আয়োজন। কিন্তু তখনো অনুষ্ঠান সূচি করা বাকি। সূচি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় সংগঠকদের আহ্বায়কের ওপর। বিএমএ সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জহুরুল হক রাজা পরামর্শ দেন- ‘মঞ্চে কোনও নেতা-অতিথি না তোলাই ভালো। তাহলে দর্শক সারি খালি হয়ে মঞ্চ ভরে যাবে। কাকে রেখে কাকে তুলবেন, শেষে সমালোচনার মুখে পড়বেন। তার চেয়ে আহ্বায়ক সভাপতি হিসেবে মঞ্চে থাকবেন। আর দুজন অনুষ্ঠান ঘোষণার জন্য মঞ্চে উঠবে। মঞ্চে সভাপতি ছাড়া অন্য কারো চেয়ার না রাখাই ভালো। কারো শুভেচ্ছা বক্তৃতাও না রাখা ভালো।’

সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা সকাল সাড়ে দশটায়। কিন্তু সকাল থেকে শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। তবুও সাহস হারায় না সংগঠকেরা। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে শহিদ পরিবারের সদস্যরা আসতে শুরু করঅন। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় সাড়ে সাত শ’ আসনের অডিটোরিয়াম। আহ্বায়ক সিদ্ধান্ত দেন, প্রথমে পতাকা উত্তোলন, তারপর র্যালি। র্যালি শেষে আলোচনা সভা। আলোচনা সভা পরিচালনার জন্য মঞ্চে উঠবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল ইসলাম জগলু চৌধুরী ও রাজনীতিক নব কুমার কর্মকার। সভাপতি আসন নেবে, শুরু হবে আলোচনা সভা। সংগঠক হিসেবে মঞ্চে থাকবেন মঞ্জুর আলম শাহিন ও প্রভাষক হান্নান সরদার। সভায় শুধু শহিদ পরিবারের সদস্যরা বক্তৃতা করবেন। আহ্বায়কের নির্দেশ জারির পর পতাকা উত্তোঅন। কিন্তু আযোজকরা পতাকার কাছে যাওয়ার আগেই সিনিয়র নেতৃবৃন্দ পতাকা তুলে ফেললেন। মিছিলেরও সামনে রইলেন তারাই।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকার্মীদের উপস্থিতিতে অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে শুরু হয় শহিদ পরিবার সমাবেশ। অর্ধ শতাধিক শহিদ পরিবারের সদস্য সেখানে কথা বলার সুযোগ পান। কেউ কেউ স্বজন হারানোর কথা বলতে গিয়ে ভেঙ্গে পড়েন কান্নায়। সমাবেশে টাঙ্গাইল থেকে শহিদ এসডিও একে শামসুদ্দিনের ছোট ভাই আবুল কাসেম, নড়াইলের শহিদ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুজ্জামান বাদশা এবং ফরিদপুরের শহিদ সন্তান সাংবাদিক প্রবীর সিকদার উপস্থিত হন।

শহিদ পরিবার সমাবেশে বেশ কয়েকজনকে পাওয়া যায় যাদের জন্ম নেওয়ার আগেই পিতাকে উৎসর্গ করতে হয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য। এদের পেয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে আসা স্বপ্নবাজদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে জাতীয় ভাবে নতুন এক সমাবেশ আয়োজনের। সে সমাবেশে তারা সমবেত করবে সেই সব শহিদ সন্তাদের ‘যারা বাবার মুখ দেখেনি।’ শহিদ সমাবেশে তারা বলবে তাদের মায়ের মুখ থেকে শোনা বাবার গল্প, তার বেড়ে ওঠা গড়ে ওঠার সংগ্রামের গল্প।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক।