ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

তালেবানদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও আমেরিকার পরাজয়

২০২১ জুলাই ২০ ১৪:১২:৩২
তালেবানদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও আমেরিকার পরাজয়

শোভন সাহা : ১৯৭৯ সালে সর্বপ্রথম পৃথিবীর বুকে তালেবান নামক সংগঠন। উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্থান থেকে সোভিয়ত ইউনিয়নের সৈন্যদের দূর করে দেশকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা। তালেবান শব্দের উৎপত্তি তালেব শব্দ থেকে যার অর্থ ছাত্র। অর্থাৎ ছাত্রদের নিয়ে এই সংগঠন গঠিত হয়।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে আফগানিস্তান দখল করে লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ওই সময়ে সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট মোহাম্মদ দাউদ খানের সরকার ক্ষমতায় ছিল। তখন থেকে আফগান মুজাহিদীনরা সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। মুজাহিদীনদের সঙ্গে ওই যুদ্ধে শরিক হতে গঠিত হয় তালেবান। অনেকে মনে করেন, স্নায়ুযুদ্ধের কারণে তালেবানরা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন পায়।

ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মূলত এই সংগঠনটি গঠিত হয়। প্রথমে তাদেরকে সাহায্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। অস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য সহ সবধরনের সাহায্য দেয়া আমেরিকা। এ সময়ে প্রায় পনের হাজার সোভিয়ত সৈন্য নিহত হয় ( সূত্র: নিউইয়ক টাইমস)।১৯৮৯ সালে সোভিয়ত সৈন্যরা আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হল। স্বার্থ উদ্ধার হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ক্ষমতাচ্যুত করে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট সাঈদ মুহাম্মদ নাজিবুল্লাহকে। দেশকে এক ও স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে নতুন সরকার গঠন করা হল।

বোরহানউদ্দিন রাব্বানীকে করা হল মধ্যবর্তী সরকার। কিন্তু দেশকে এক করতে ব্যর্থ হল তালেবানরা।১৯৯৪ সালে দেশকে তালেবান দেশকে দখল করে নিল। ১৯৯৬ সালে রাজধানী কাবুল দখল করে নিল। দেশে চালু করল ইসলামী শরীয়া আইন। এটাই প্রধান করান তাদের জঙ্গী হিসেবে পরিচিত হওয়ার। এটা সত্য তারা অনেক কট্টর পন্থি ছিল। তারা মেয়েদের সম্পূর্ন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল না। তারা ইসলামী শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল। কারন তালেবানকে জঙ্গী হিসেবে পরিচিত করেছে পশ্চিমা মিডিয়া। আর পশ্চিমা মিডিয়া কখনই ইসলামের পক্ষে ছিল না।
পশ্চিমাদের বিরোধী হওয়ার নেমে আসল অত্যাচার।

তালেবানরা যদি সন্ত্রাসী হয়ে থাকে তাহলে তাদেরকে তো গড়ে তুলেছে আমেরিকা। আমেরিকা যখন সোভিয়তকে দমন করার প্রয়োজন হল তখন তালেবানকে অস্ত্র, অর্থসহ যাবতীয় সহায়তা করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন আমেরিকার বিরুদ্ধে গেল তখনই তালেবান জঙ্গী হয়ে গেল।

৯৬ পরবর্তী সময়ে তালেবান আফগানিস্তানে ইসলামী আইন চালু করে ছিল। এটাই ছিল তাদের জঙ্গী হবার মূল কারন।

যা হোক পরবর্তীতে ২০০১ এ আমেরিকা ওয়ান ইলেভেন হামলাকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। আজ
আমরা জানি মূলত ওয়ান ইলেভেন হামলা কে করেছিল। এই ইস্যু কে কেন্দ্র করে একটি দেশের ওপর হামলা করা কি কোন ধরনের সন্ত্রাস নয়? সেটিই প্রশ্ন। আসলে কি তালেবানরা সন্ত্রাসী না আমেরিকা সন্ত্রাসী। আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশের চিত্র একইরকম: সরকার শহর এবং বড় বড় শহরতলীগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু তাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে তালেবান। আশপাশের বিস্তীর্ণ গ্রাম এলাকা জুড়ে রয়েছে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ।

আফগানিস্তানের পরিস্থিতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে বাংলাদেশ। মার্কিন বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহারের আগে দেশটিতে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। সরকারি বাহিনী ও তালেবানের মধ্যে চলছে তুমুল যুদ্ধ। এর মধ্যে ১১৬ জেলা সরাসরি যুদ্ধ ও বিনা বাধায় তালেবানরা সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে দখল করেছে।

আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাণিজ্য সম্পর্ক থাকলেও দেশটিতে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে ওই ধারায় ছেদ পড়ে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক আফগানিস্তানে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ব্র্যাকের বাংলাদেশি কর্মীসহ বিদেশি কর্মীদের কার্যক্রম রাজধানী কাবুলে সীমিত করে আনা হয়েছে। দেশটিতে ব্র্যাকের কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে অপহৃত হয়েছেন। যদিও সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, তালেবানের নামে আসলে মাফিয়ারা চাঁদাবাজির জন্য তাদের কর্মীদের অপহরণ করেছিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় সার্কভুক্ত দেশ হিসাবেও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) দুই মুসলিম দেশ একসঙ্গে কাজ করে। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে দেশটিতে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার কখনো তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। পুরো তালেবানের শাসনকালে বাংলাদেশে আফগানিস্তানে আগের সরকারের সিডিএ (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স) তার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় আফগানিস্তানের দূতাবাস রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কয়েক বছর আগে কাবুলে দূতাবাস খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দেশটিতে যুদ্ধ চলতে থাকায় নিরাপত্তাজনিত কারণে তা চালু করেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের আশ্রয়ে পালিয়ে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়ে তালেবান সরকারকে সরিয়ে দেয়। ইসলামাবাদের কাছে অ্যাবোটাবাদ থেকে ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেফতারের পর তাকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।

আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় থেকে মার্কিন সৈন্য সেখানে মোতায়েন থাকে। আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে বাংলাদেশ মার্কিন যুদ্ধবিমানে জ্বালানি নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের বিমানবন্দর ব্যবহারে অনুমতি দেয়।

অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ সত্ত্বেও আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়নি বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কেউ মনে করেন, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য চলে যাওয়ার পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সুযোগে চীন দেশটিতে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। আবার আফগানিস্তান অস্থিতিশীল থাকলে ওই অঞ্চলে চীনের অনেক বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আফগানিস্তানে বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি ভারতেরও বিশেষ নজর থাকবে। কারণ ভারতের কৌশলগত প্রতিপক্ষ পাকিস্তান ও চীনের তৎপরতা সেখানে বিশেষভাবে রয়েছে। আফগানিস্তানে ২০ বছর আগের অবস্থা নেই। চাইলেই তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। লিবিয়া, সিরিয়া কিংবা ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পরের পরিস্থিতি আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন কেউই চায় না।

মার্কিন সরকারের হিসাব বলছে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশটিতে এক লাখ মার্কিন সেনা ছিল, যার কারণে বছরে যুদ্ধের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের লক্ষ্য সরাসরি সামরিক অভিযান থেকে সরিয়ে আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণে বেশি মনোনিবেশ করার পর ব্যয় বেশ কমে আসে।

২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে বার্ষিক ব্যয় নেমে দাঁড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে জানা যায়, এ বছর ব্যয় হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার।মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে মিলে ৪৪ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন ধরণের পুননির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় করেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী সব মিলিয়ে ২০০১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে।

তালেবানরা প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কাবুলে আশরাফ গানি সরকারের পতন ঘটানো। এদিকে মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মার্কিন বাহিনী সরে যাবার ছয় মাসের মধ্যে তালেবানদের হাতে কাবুলের পতন ঘটবে।আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সাথে সাথে তালেবানরা আবার আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ বছরের ১১ সেপ্টেম্বর নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। তবে ৬৫০ জনকে রাখা হচ্ছে সেখানে মার্কিন দূতাবাস পাহারা দেওয়ার জন্য।

(এস/এসপি/জুলাই ২০, ২০২১)