ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

ল্যান্ডফিলিং’র চ্যালেঞ্জসমূহ

২০২১ জুলাই ২৮ ১৬:৫৮:২৩
ল্যান্ডফিলিং’র চ্যালেঞ্জসমূহ

হাবিবা আক্তার হ্যাপি : পৃথিবীতে প্রায় ৭ বিলিয়ন মানুষ বসবাস করছে। মানুষের উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ হিসেব করলে দেখা যায়, জনপ্রতি প্রতিদিন প্রায় ১.২ কেজি বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। বছর শেষে এই বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১.৩ বিলিয়ন টন। ধারনা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মাঝে বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়ে প্রায় ২.২ বিলিয়ন টন হবে।

দ্রুত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের কারনে দিন দিন বেড়েই চলেছে কঠিন বর্জ্যরে পরিমান। তাই সঠিবকভাবে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে উন্নয়নশীর দেশগুলোর জন্য। উচ্চ এবং নিম্ম আয়ের দেশগুলোতে এই বর্জ্যের এক বিরাট অংশের (প্রায় ৫৯%) জায়গা হচ্ছে ল্যান্ডফিলিংয়ে। বিশ্বজুড়ে ল্যান্ডফলিং পদ্ধতি বর্জ্য নিষ্পত্তিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ল্যান্ডফিলিং হলো বর্জ্য অপসারনের এক ধরনের মাধ্যম। যেখানে বর্জ্য অন্তর্নিহিত সেকশনগুলোতে জমা হয় এবং পচে যায় সেখান থেকে নির্গত হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং মিথেন। মিথেন হলো শক্তিশালী গ্রিন হাউজ গ্যাস। এই মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে ল্যান্ডফিলগুলোর বর্জ্য হতে এবং আমরা সবাই জানি যে মিথেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গ্লোবাল গ্রিন-হাউজ গ্যাস উৎপাদনে।

বিশ্বব্যাপী বছরে ১.৩ বিলিয়ন টন কঠিন বর্জ্যরে মাত্র ১৩.৫% পুনব্যবহারযোগ্য। ৫.৫% কম্পোজ করা হচ্ছে যখন প্রায় ৫৯% বর্জ্যরে জায়গায় ল্যান্ডফিলে। জীবনযাপনের জন্য পরিবেশ থেকে আমরা কতো কিছু নিই। বিনিময়ে পরিবেশের জন্য আমরা কি করছি?

দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারনে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য আমরা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছি। ফলস্বরূপ আমাদের বাস্তুসংস্থান অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

ল্যান্ডফিলিং এর বর্জ্যসমূহ আমাদের মেরিন সিস্টেমকে প্রভাবিত করছে। বায়ু দূষণ করছে। এমনকি ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের অন্যতম কারন গ্রিনহাউজ যা ল্যান্ডফিলের বর্জ্য থেকে নিঃসরণ হচ্ছে। বর্জ্য থেকে বিষাক্ত পাদার্থগুলো আমাদের খাদ্য চেইনে প্রবেশ করছে। যা গুরুতর বিষয়। এসব আমাদের সবার বিবেচনায় আনা উচিত।

ল্যান্ডফিলগুলো বর্জ্যগ্রহণ করছে কোনোরকম পৃথিকীকরণ ছাড়াই। শিল্পকারখানা, হাসপাতাল এবং অন্যান্য উৎস থেকে উৎপন্নকারী বর্জ্যগুলোকে পৃথক না করে ল্যান্ডফিলে একসাথে ডাম্পিং করার কারনে সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে না। ফলে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান ভারসাম্য হারাচ্ছে। যথাযথভাবে বর্জ্য পৃথকীকরণ না করায় সব ধরনের বর্জ্য একত্রে মিলে বিষাক্ত পরিবেশের সৃস্টি করছে। এতে ল্যান্ডফিলগুলোর শক্তি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বর্জ্য প্রসেসিং করতে বাড়ছে সময় ও অর্থব্যয়।

যদি বর্জ্যগুলো পৃথক করে ল্যান্ডফিলে হস্তান্তর করা হয় তাহলে সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও উপলব্ধি না থাকা আমাদের একটি বড় সমস্যা। আমরা বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমরা নিজেরাই এই চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছি।

ডিকম্পোজিশন এবং জীবনচক্রের ক্রিয়াকলাপ প্রক্রিয়ায় গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনে পৌর কঠিন বর্জ্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই নির্গমনের সিংহভাগ ল্যান্ডফিলিংয়ের ফলাফল। ফলস্বরূপ আমাদের পরিবেশের পাশাাপাশি নিজেদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছি। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের প্রধান পরিবেশর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ল্যান্ডফিল সাইটগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। কারন ল্যান্ডফিলের বায়োগ্যাস বায়ুমন্ডলে জেনারেট করে এবং ছেড়ে দেয়। বায়োগ্যাস মূলত মিথেন গ্যাস এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমন্বয়ে গঠিত। এই দুটি গ্যাসের কারনে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ল্যান্ডফিল সাইটগুলোর কারনে ২০২৫ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস আরো ১০% নির্গমন হবে।

ল্যান্ডফিলগুলো মুখ্য ভূমিকা রাখে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করতে। বর্জ্যগুলো রোদের তাপে শুষ্ক হয়, গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলো বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং মিথেন আকারে নির্গত হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতায় মিথেন গ্যাস কার্যকরি ভূমিকা রাখে।

‘দেখা যায়, ২০ বছর সময়কালের মাঝে বৈশ্বিক উঞ্চতায় মিথেন গ্যাসের সম্ভব্যতা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ৮৬ গুন বেশি। অর্থাৎ কার্বন-ডই-অক্সাইডের তুলনায় মিথেন ৮৬ গুন বেশি কার্যকরভাবে বায়ুমন্ডলে তাপ ধরে রাখতে পারে। সুতরাং মিথেন গ্যাস সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রিন হাউজ গ্যাস। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ হবে না যে কিভাবে মানুষের দ্বারা উৎপাদিত এবং নিষ্পত্তি করা বর্জ্য বৈশ্বিক উষ্ণতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কেননা মানুষের কর্মকা-ে উৎপাদিত মিথেনের বৃহত্তম উৎস হলো ল্যান্ডফিলে নিষ্পত্তি করা বর্জ্য।’

সাম্প্রতিক বৈশ্বিক উষ্ণতা বিশ্বজুড়ে চ্যালেঞ্জিং সমস্যা সৃষ্টি করছে। যেমন অতিরিক্ত হিটওয়েভস, আকস্মিক বন্যা, হারিকেন, হিমবাহ গলে যাচ্চে, সমুদ্রের স্তরকে স্ফীত করছে, বণ্যজীবের আবাস সংকুচিত হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। জানতে হবে সঠিকভাবে বর্জ্য নিষ্পত্তি না হলে জলবায়ুতে কিরূপ প্রভাব পড়তে পারে উৎপাদিত বর্জ্যরে ফলে।

ল্যান্ডফিলগুলো সঠিকভাবে নির্মিত হয় না। যথাযথভাবে রক্ষনাবেক্ষণ করা হয় না। ফলে বর্জ্য হতে বিষাক্ত ক্ষতিকর পদার্থ লিচেটের মাধ্যমে স্থানীয় স্ট্রমস, মাটি, ভূ-গর্ভস্থ পানিতে প্রবেশ করে। সুতরাং ল্যান্ডফিল সাইটগুলো মাটি এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষণের জন্য দায়ী। ল্যান্ডফিল সাইটগুলো পাখির স্থানান্তরের উপর আংশিক নেতবাচক প্রভাব ফেলছে। দেখা যায়, কিছু পাখি ল্যান্ডফিল সাইটগুলো থেকে খাবার আহোরন করে। অনিবার্যভাবে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, জিপসাম এবং নানা রকম বিষাক্ত পদার্থে বিদ্যমান থাকার কারনে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় পাখিসহ প্রাণীকূল। এছাড়ায় ল্যান্ডফিলগুলোর কারনে পাখিদের অভিবাসনের ক্রিয়াকলাপেও বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ছে। এমনকি অনেক গাছপালা এবং প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ল্যান্ডফিলগুলো আপেশপাশের এলাকার কোয়ালিটি নস্ট করে। ল্যান্ডফির সাইটগুলো থেকে উদ্ভুত দুর্গন্ধ কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অনিবার্যভাবে প্রায় ল্যান্ডফিলিংয়ের কাছের জনবসতিতে পৌঁছায়।

বর্তমানে করোনাকালে মেডিক্যাল বর্জ্যরে পরিমান বাড়ছে পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে সবাই মাস্ক, গ্লাসভ এবং অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করছে। ফলে বাড়ছে বর্জ্যরে পরিমাণ। করোনা পজিটিভ ব্যক্তির ব্যবহৃত সরঞ্জামাদিও জায়গা হচ্ছে ল্যান্ডফিলে। সাথে পরিবেশের পাশাপাশি মানুষের জীবনের জন্য বাড়ছে মারাত্মক হুমকি। বর্জ্য এবং দূষিত পানির মাধ্যমেই বেশি রোগ ছড়ায়। যেসব এলাকায় সেনিটেশন ব্যবস্থা অনেক দুর্বল এবং মানুষ খোলা নর্দমার পানি ব্যবাহর করতে বাধ্য হয় সেসব এলাকায় মানুষ দ্রুত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।

করোনাবর্জ্য থেকে খুব তাড়াতাড়ি বায়ুর মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। যা আমাদের সকলের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেকেই মনে করেন ল্যান্ডফিল বলতে সাধারণত খোলা জায়গায় বর্জ্য নিষ্পত্তি করা। আর এই ভাবনা হওয়া স্বাভাবিক। কেননা আমাদের চলাফেরার পথে আমরা দেখতে পারি, রাস্তার একপাশে খোলা স্থানে বর্জ্যবহনকারী গাড়িগুলো এসব বর্জ্য জমা করছে। নূন্যতম অবকাঠামো থাকে না বেশিরভাগ ল্যান্ডফিলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের পর্যাপ্ত অভাব, অইন প্রণয়নের অভাব, দক্ষ লোকবলের অভাব, সচেতনতার অভাব, ল্যান্ডফিল উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের মতো সমস্যা রয়েছে। আর এসবের দায়ভার আমাদের নিজেদের। আমরা সুরক্ষিত জায়গাকে দিনে দিনে বসবাসের জন্য অনুপযোগী করে তুলছি।

আমাদের উচিৎ অন্যের উপর দোষ দেয়া বন্ধ করা। নিজেদের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। বর্জ্যগুলোকে সঠিকভাবে কম্পোজিং ও পুনব্যবহারযোগ্য করা। আমাদের সচেতনতাই পারে পৃথিবীকে সুন্দরভাবে সাজাতে।

লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।