ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : পর্ব-৪

২০২১ জুলাই ৩১ ২৩:৩২:৪৩
বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : পর্ব-৪

আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, সমাজের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের সমন্বয়ে তিনি একটি সুখীসমাজ গড়ে তুলবেন । তিনি হিংসা বিদ্বেষ জবরদস্তি ও রক্তপাতমূলক কার্যকলাপের ঘোর বিরোধী ছিলেন । ভালবাসা ও বিশ্বস্ততা দিয়েই তিনি সকল বাঙালিকে একতাবদ্ধ করতে চেয়েছেন । তিনি আরো বিশ্বাস করতেন যে, বাংলাদেশ কেবলই বাঙালির দেশ, বাঙালি একটি বৃহত্ পরিবার । এই পরিবারের মধ্যে ভাল মানুষ আছে, খারাপ মানুষও আছে । শোষকও আছে শোষিতও আছে । ধনী আছে, গরীবও আছে । শিক্ষিত-জ্ঞানী আছে, মূর্খও আছে । এসব নিয়েই বাঙালি পরিবার । আমরা সকলে পরের তরে, এ চেতনার পরিবার । এই চেতনার চিরন্তন বিশ্বাসের ওপর ভর করে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শোষক-শোষিতের প্রশ্ন তুলে জাতিকে বিভক্ত করেননি । ফলে আওয়ামী লীগ হয়ে দাঁড়ায় এদেশের জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী ও উঠতি পুঁজিবাদীদের একটি সমন্বিত রাজনৈতিক ফ্লাটফরম । এককথায় আওয়ামী লীগ বহু শ্রেণীভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্থা (মাল্টিক্লাস অরগানাইজেশন) হিশেবে পরিগণিত হয় ।

অপরদিকে মুসলিম লীগ ছিল সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ তথা সমাজের উচ্চস্তরের শাসক ও শোষকদের প্লাটফরম । বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া ধনিক বণিক শিল্পপতি জমিদার আমলা ও জেনারেল সামন্তবাদী, সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের সম্মিলিত রাজনৈতিক ক্লাব । ঐ সব চক্রের স্বার্থে ও পরামর্শে মুসলিম লীগ পরিচালিত হতো । পূর্ববাংলার দু'চারটি ধনিক পরিবার দালালির মাধ্যমে তাদের সাথে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছিল । বাকি উঠতি পুঁজিপতি বা ধনিকগোষ্ঠী ভবিষ্যত্ ক্ষমতার আশায় আওয়ামী লীগের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক গড়ে তোলে । এ-ব্যতীত আরো কতিপয় রাজনৈতিক দল যেমন, জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি, নেজামে ইসলামি প্রভৃতি ইসলামপন্থী-পুঁজিবাদী দল শাসক ও শোষকদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অবস্থান করলেও এরা ছিল শাসক-শোষকদের বি-টিম । এদের কাজই ছিল আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা, বিশেষ করে বামপন্থা বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ইসলাম ও আল্লাহবিরোধী নাস্তিকতাবাদের দর্শন বলে জনগণের মাঝে ধূম্রজাল ছড়ানো, যাতে শাসক-শোষকগোষ্ঠীর বিরোধী সংগঠন আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলগুলোর প্রতি জনগণ ঝুঁকে না পড়ে ।

সমাজতান্ত্রিক বা বামপন্থী রাজনৈতিক দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দল যেমন, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রভৃতি মার্কসবাদী-লেনিন-মাওবাদী রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে একমাত্র পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির দু'টি উপদল (ভাসানী-মোজাফফর) ব্যতীত অন্যান্য দলগুলো ছিল নিষিদ্ধ । আণ্ডারগ্রাউণ্ডেই তারা তাদের সংগঠন পরিচালনা করতো । শাসক-শোষকগোষ্ঠী ও ইসলামওয়ালারা ছিল তাদের প্রতি খড়্গহস্ত । এদের মধ্যে মস্কোপন্থী দলগুলো আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে তাদের কাজ চালাতো । তবে পিকিংপন্থী দলগুলো পাকিস্তানের শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে যতো না গলাবাজি করতো, তারচেয়ে বেশি গলাবাজি করতো আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে । তারা আওয়ামী লীগকে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের আনুসারি বলেও গালাগাল দিতো । মূলত: ন্যাপ-ভাসানী ও কতিপয় চৈনিকপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের সাথে তাদের মুরব্বী চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্র ধরে তারা বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার মধ্যেই বেশি সময় ব্যয় করতো । রাতের বেলা গ্রাম্য ধনিকদের গলা-কাটা আর দিনের বেলা আওয়ামী লীগের গোষ্ঠী উদ্ধার করাই ছিলো এদের মূল লক্ষ্য । এসব কর্মকান্ড পরিচালনা করার বিনিময়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তানের শাসকদের নিকট থেকে অঢেল অর্থকড়ি লাভ করতো ।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের শেষদিকে বেশ অগ্রসর হয় । এ-স্তরে পাকিস্তান সেতুবন্ধ হিশেবে কাজ করে । এ-সুযোগে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমাজতন্ত্রকে হিংসা-বিদ্বেষ, রক্তপাত, হানাহানি, ধর্মবিরোধী নাস্তিকতাবাদের দর্শন হিশেবে চিত্রিত ও চিহ্নিত করাল লক্ষ্যে ঐসব চৈনিকপন্থী সর্বহারা-সমাজতন্ত্রীদের দিয়ে ঐসব কার্যক্রম সুচারুরূপে করতে সক্ষম হয় । মূলত: এরা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের অর্থ খেয়ে সমাজতন্ত্রের নামাবলী আওড়ে প্রকারান্তরে সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার কার্যক্রমে লিপ্ত হওয়াসহ সমাজতন্ত্রকেই কৌশলে গণবিরোধী মতবাদ হিশেবে চিহ্নিত করে । এদেরকে তাই বঙ্গবন্ধু 'পেন্টাগনপন্থী সমাজতন্ত্রী' বলে আখ্যায়িত করতেন । এরা যে মূলত: মার্কিন সেবাদাস তার প্রমাণ এরা রেখেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে । কারণ মার্কিন ও চীন উভয়েই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ছিল । ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও এসব তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা-কর্মীরা সংগত:কারণে কখনোই সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করেনি । ঐ তথাকথিত সমাজতন্ত্রী ও ইসলামপন্থীদের কার্যকলাপ তাই জনবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রমেই প্রতিভাত হয়েছে । মূলত: পিকিংপন্থী ও ইসলামপন্থীরা এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করেছে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে । এরা উভয়েই আসলে প্রতিক্রিয়াশীল । এই দুই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র কেবল সমাজতন্ত্রকে নস্যাত্ করার লক্ষ্যে ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের নাম ব্যবহার করেছে । এই দুই চক্র ইসলামপন্থী ও চৈনিকপন্থী এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও প্রগতির শত্রু; এরা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের পেইড এজেন্ট ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথে পাকিস্তান আমলের উঠতি ধনিক পুঁজিবাদীচক্র ও অন্যান্য কায়েমী স্বার্থান্বেষিরা আনিবার্য কারণেই বহুদিনের লালিত কামনাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্য আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে । এ সুযোগ আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের মোড়লরা পূর্ণভাবে গ্রহণ করে উঠতি ধনিকশ্রেণীর পেছনে এসে দাঁড়ায় । বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যে পরাজয়ের গ্লানি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী শক্তির কপালে লেপ্টে দিয়েছে, সেই কালিমা মোচন ও পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে এবার তারা এদেশীয় উঠতি ধনিকশ্রেণী ও অন্যান্য সুবিধবাদকচক্রের মাধ্যমে তাদের কালো থাবা বিস্তারিত করে । কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসব ধনিক-সুবিধাবাদীদের লালসা গুড়িয়ে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আর্থবৈষয়িক কর্মসূচি গ্রহণ করলেন । উঠতি ধনিকশ্রেণী অবশ্য বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বিশিষ্ট অনুসারীদের পুঁজিবাদ পরিহার করার বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিলেন । প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : এক সাগর রক্তে কেনা বাংলাদেশকে পুঁজিবাদের রক্তচুষা বাঁদুড়দের হাতে তুলে দিতে পারি না ।' তিনি শাসনতান্ত্রিক তথা রাষ্ট্রীয় মৌলিক আদর্শ থেকে পুঁজিবাদকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়ে সমাজতান্ত্রিক পথের দিকনির্দেশ প্রদান করেছিলেন ।

উঠতি ধনিকশ্রেণী প্রমাদ গণলো । মুজিবের দর্শন-কর্মসূচির মধ্যে তারা তাদের মৃত্যুবাণ দেখতে পেলো । ফলে তারা তাদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা নিয়ে মুজিব সরকারকে হেয় ও উৎখাতের লক্ষ্যে অতি পুরানো চালটি চাললো । তারা স্বাধীনতাবিরোধী পলাতক মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজাম, পিডিপি, ভাসানী ন্যাপ, চৈনিকপন্থী সর্বহারা-সমাজতান্ত্রিক পার্টি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, হতাশাগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনিক দালাল আমলা, উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তাসহ সমাজের দাগী ডাকাত-গুণ্ডা, মোল্লা-মাওলানা, টাউট রাজনীতিক, ব্যবসায়ী প্রভৃতি শ্রেণীর সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলে । বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচিকে বানচাল করার লক্ষ্যে এবার তারা নেপথ্যে মদদ দিয়ে কিছু হতাশাগ্রস্ত নামীদামী মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে গঠন করলো প্রথম বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ । এদের লক্ষ্যই নাকি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র । তারপর শুরু হলো জ্বালাও-পোড়াও, ব্যাঙ্ক লুট, কলকারখানায় অগ্নিসংযোগ, হত্যা-গুম প্রভৃতি নাশকতামূলক কার্যকলাপ । জনগণকে এভাবেই তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের চেহারা দেখালো ।

সমাজতান্ত্রিক আদর্শের এ চেহারা দেখে সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলো । সেই ঢেউ গিয়ে পড়লো বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির ওপর । সারা দেশে যেন ঢেউ জাগালো, থামাও সমাজতন্ত্র ! এভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্য আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও এদেশীয় উঠতি পুঁজিবাদীচক্র বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করলো ! তাদের চক্রান্তমূলক কারসাজিতে দেশের প্রতিটি স্তরে অবিশ্বাস হানাহানি রেষারেষি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে থাকে । জাতীয় ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হলো । চারদিকে শুরু হলো সীমাহীন স্বেচ্ছচারিতা, দুর্নীতি, চাটারদলের চাটাচাটি, চোরাকারবারি, ফটকাবাজারি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, হাইজ্যাকিং, নৈরাজ্য আর নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির হলাহল । আর এসব কার্যকলাপের পশ্চাতে যাবতীয় ঘুঁটি চালাতে থাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, চীনসহ পরাজিত শক্তি ও এদেশীয় উঠতি ধনিক ও পুঁজিবাদীচক্র । (চলবে------)

লেখক : বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বহু গ্রন্থের লেখক ও গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।