ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » শিল্প-সাহিত্য » বিস্তারিত

স্মৃতির আয়নায় শামসুর রাহমান

২০২১ আগস্ট ১৭ ১৪:৩৩:২২
স্মৃতির আয়নায় শামসুর রাহমান

বদরুল হায়দার



‘মুছে গেলো দৃশ্যাবলী চারিদিকে, অনন্তর একা
আমি আর অকূল শূন্যতা’
কবি শামসুর রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতায় উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিনয় ও প্রেমে তিনি ছিলেন নতজানু। আলোকিত প্রিয় মানুষের মধ্যমণি। দেশবরেণ্য কবি শ্রেষ্ঠ কৃতীর শীর্ষে অবস্থান করেছেন আমৃত্যু। বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমানের কবিতা অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও নিজস্ব আসনে দৃঢ়। যিনি কৌশলী নির্মাতার মতো সমগ্র সৃষ্টিশীলতাকে অর্জন করেছেন। এ অর্জনে তারুণ্যের সাহচার্য ছিল প্রিয়। আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে পাঠ্যবই, দৈনিক কাগজ সাময়িকী বুলেটিনে শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ও সম্পৃক্ততা শুরু হয়। কাব্যজীবনে তারুণ্য আর অনুসন্ধানী কাব্য পাঠক ও লেখক বলেই তাকে দেখার পর মনে হয়েছে তিনি কবি ও বিনয়ী মানুষ। পরিচয় করমর্দনে আমাকে বিনয় ভাব স্পর্শ করে। যেভাবে তিনি কবিতায় সরল বুননে নতুন ও চিরন্তন করে গেঁথে দেন জীবনের ছায়া প্রচ্ছায়াকে। শব্দে সংবেদনশীলতা ও প্রতীকী অবিভাজ্যতাকে এক করে স্বাচ্ছন্দ্যে আন্তরিকভাবে প্রকাশ করেন মানুষের সুষমাকে। কবিতায় বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্যকে রূপায়ণ করেছেন। প্রতিবাদ বিক্ষোভ আর সাহসী সংগ্রামে তার কবিতা গণজাগরণের ভাষাকে কবিতায় সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে তার কবিতা যুদ্ধ ও বিজয়ে জাগিয়ে তুলেছে বীর বাঙালিকে।

শামসুর রাহমান প্রিয় কবি ও মানুষ। অজান্তে আমিও সেই দলে। তার বিস্তৃত কাব্যজীবনের ভেতর নিজেকে অনুষঙ্গ করে পুনঃস্মরণেই তাকে ফিরে দেখা। কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে সচরাচর সখ্য ছিল না। ঢাকার কাব্যজীবনে তাকে ঘিরে কবিতা উৎসব, কবিতার আসরে বিশেষ করে ৯০ দশকে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলা একাডেমির নানা অনুষ্ঠানে ও আড্ডায় অংশ নিয়েছি বহুকাল ধরে।

১৯৯৩ সালের এক দুপুরে আমি কবিবন্ধু প্রয়াত কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, আসাদুল্লাহ শেখরসহ শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখা করতে দৈনিক বাংলা ভবনে সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে যাই। চৈত্রের ক্ষুধা আর তপ্ত দুপুরে আমরা দরজা ঠেলে বিচিত্রা অফিসে ঢুকে পড়ি। তিনি বিনয়ের সঙ্গে আমাদের বললেন আপনারা বসুন। স্থির হন। আমরা বসে গেলাম। তিনি সবিনয় বললেন_ আপনারা কী খাবেন। কবি আমাদের অভয় দিলেন। ক্ষুধা ও ক্লান্তিজুড়ে আমরা তিনজন বিধ্বস্ত। আপনারা জিরিয়ে তারপর যাবেন। সেদিন কবি শামসুর রাহমানকে ঘিরে বিচিত্রা অফিসে কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, আহমদ ছফা, খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ছফা ভাইতো বিনয়ে জড়সড় শামসুর রাহমানের সম্মানে। রাহমান ভাই কবি ও কবিতার প্রতি দরদি মানুষ। তেমনি দরদি কবিও ছিলেন ভক্ত পাঠককুলে।

কবি শামসুর রাহমানের কবিতার প্রধান ধারা হচ্ছে_ দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, হতাশাকে সহজ ও সুদূরপ্রসারী করে বর্ণনায় মূর্ত করে তোলেন। শব্দ নির্মাণ ও প্রয়োগ সংহত এবং মিতব্যয়ী কবিতাশিল্পী। মানুষের ভাঙাগড়া শূন্যতাও বিষণ্নতার পরিপূর্ণ রূপকে অভাবনীয়ভাবে কবিতায় প্রকাশের ফলে তার কবিতা পাঠকপ্রিয় হয়েছে শুরু থেকে। ৫০ দশকের সমকালীন কবিবন্ধু সুহৃদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি কবিতাকে সহজবোধগম্য করার প্রয়াস নিয়েছেন প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে। তার ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের শুরুতে তিনি সমকালীনদের থেকে আলাদা ভাষার সন্ধান করেছেন। নিজ বাসভূমে, বন্দি শিবির থেকে, বিধ্বস্ত নীলিমা, ফিরিয়ে দাও ঘাতক কাঁটা, উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ_ বাংলা কবিতার দীর্ঘকালীন সময়ের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশমান অবয়ব পাওয়া যায় তার কবিতায়_

‘লোকে বলে বিজ্ঞজন সহস্র চক্ষু, অথচ প্রিয়তমা,
কি আশ্চর্য, কিছুতেই তারা দেখতে পায় না
আমার কবিতায় অর্পিত তোমার চুলের ছায়া
নিশ্বাসের সুগন্ধি তাপ, আর আমার হৃৎস্পন্দন’

৫০ দশক থেকে বাংলা কবিতায় বৈচিত্র্য ও শৈল্পিক ফসল তাকে গৌরবময় করে রেখেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনবদ্য কবিতাগুলো কোটি মানুষের কাছে চির ভাস্বর হয়ে আছে। নিজগুণে সামাজিক মর্যাদাকে কবিদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থটি বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার নানা প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ভয়াবহতা তার কবিতায় প্রকাশ ঘটে_

‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?’

কবি হলেও রাষ্ট্র-সমাজ সময়ের দায়বদ্ধতাকে তিনি গ্রহণ করেছেন একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে। ঢাকার কাব্যজগতের সনামধন্য বরেণ্য কবি হিসেবে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ সম্মান অর্জন করেছেন। কী রাষ্ট্র, কী বি-রাষ্ট্র, কবিতা আড্ডা, কবির জন্মদিন, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, প্রকাশনা উৎসব, বইমেলা, বৈশাখী মেলা সবক্ষেত্রে শামসুর রাহমান ছিলেন প্রধান আকর্ষণ। শামসুর রাহমান থাকলেই তরুণ কবিদের আড্ডা জমে সম্মান ও পরিচিতি বাড়ে। কারণ শামসুর রাহমানের উপস্থিতিতে কবিতা পাঠ করার সৌভাগ্য অনেকের হয়নি। তিনি কবিতা নিয়ে কথা বলতেন। নিজের কবিতা শোনাতেন। কবি হিসেবে তিনি মনে করতেন_ যদি আমি সত্যিকারের কবি হতে পারি, এটাই আমার জন্য একটা বড় পাওয়া এবং সেটি অনাদিকাল কিংবা আগামীকাল যখন আমি থাকব না তখন যদি আমাকে কবি হিসেবে স্মরণ করা হয় তাহলেই আমার জন্য যথেষ্ট।

‘চতুষ্পাশ্র্বে অবিরল যাচ্ছে বয়ে লাভাস্রোত কম্পমান ভূমি
প্রলয়ে হইনি পলাতক
নিজস্ব ভূভাগে একরোখা
এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এ ধরনের অহংকার’

৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে শামসুর রাহমান হয়ে ওঠেন সময়ের আলোচিত কবি মানুষ। তার কবিতা ও ব্যক্তিত্ব মিশে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কবিদের প্রেরণার বটবৃক্ষ। তার কবিতা জীবনমুখী একই সঙ্গে হৃদয়স্পর্শী।

তিনি কবিতায় মর্মকথার ধ্বনিকে সংহত ভাষাশৈলী দিয়ে সময়কে অতিক্রম করেন। যুগের মর্মবাণীকে গ্রহণ করেন অন্তর প্রকৃতির পক্ষে অনুকূল শব্দাবলির আরাধনায় প্রতিমা নির্মাণ করেছেন। বিষাদ, বিতৃষ্ণা, শূন্যতা, মৃত্যু, শব, করোটি, কঙ্কাল কবরের বহুমুখীন বৈচিত্র্যতাকে কবিতায় স্থাপন করেন সচেতনভাবে। অন্যদিকে তিনি ছিলেন জগৎ সংসারের প্রতি বিশ্বাসী। বস্তুত সভ্যতার সঙ্কট থেকে তিনি উত্তরণে ভাবনায় নিজেকে নিয়ে গেছেন। নিরলঙ্কার ও নিরাভরণ বাকশক্তির পরিণত মানসিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন কাব্যের শৈলীতে।

‘বাজে নীলিমার স্তর, আকাশের আকুল সাহারা
চষে চষে কী বেল জুঁই
প্রত্যহ ফোঁটাতে চাই বুঝি না কিছুই। নীলিমায়
প্রপেলর গুঞ্জনে মৃত্যুকে ভুলে থাকি প্রহরে প্রহরে।
না_ আমি কখনও আর নীচে নামবো না’

শামসুর রাহমান একাধারে কবি ও শিল্পিত মানুষ। জীবিতকালে এ মহতী কবির পদচারণায় ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চল হয়েছে ধন্য। ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প থেকে আমার ‘সময় বিক্রির গল্প’ কাব্যগ্রন্থটি বের হয়। কবি ও কথাশিল্পী প্রত্যয় জসীমের উদ্যোগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের ব্যানারে ঢাকার মতিঝিল সুগন্ধা রেস্তোরাঁয় বইটি প্রকাশনা উৎসবে কবি শামসুর রাহমান ছিলেন প্রধান অতিথি, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ছিলেন সভাপতি। প্রায় শতাধিক কবির উপস্থিতিতে প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সন্ধ্যার মুহূর্ত ছিল আনন্দঘন। প্রত্যয় জসীম ও অরাত্রিকা রোজীর উপস্থাপনায় সুগন্ধা রেস্তোরাঁ কবিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। কবি শামসুর রাহমান তো মধ্যমণি। তাকে ঘিরেই প্রকাশনা উৎসব প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন_ ‘কবি বদরুল হায়দারের কিছু কবিতা পড়েছি। বদরুল হায়দার কবি। বদরুল হায়দারের কবিতা জনপ্রিয় হোক এটা আমি চাই না_ তার কবিতা অমরত্ব লাভ করুক এটাই আমি আসা করি। তবে একটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করি। আমার সময় বিক্রির গল্প কাব্যগ্রন্থে কবি ও আধিপত্য শিরোনামের কবিতায় দুই অংশে আমি লিখেছি_ ‘কবি প্রতারক নয় বলে কবিতাও সত্য হয়’।’ কবি শামসুর রাহমান বলেন, প্রতারক হলেও কবি হতে পারেন। যদি তিনি কবি হন। কবিতার প্রতি গভীর বিশ্বাস ও মমতা তাকে সার্বক্ষণিক কবি হতে সাহস জুগিয়েছে। দেশবরেণ্য কবি কৃতীর অধিকারী হলেও তিনি ছিলেন কবিদের প্রিয় মানুষ। অগ্রজ কবির স্নেহ আশির্বাদ নিয়েই সেদিন আমার কবিতা ভুবনে পদচারণা চর্চা অনুশীলন আরো আশাময় করে তোলে।

‘আমার দিনকে দিয়েছ কাব্যের বর্ণচ্ছটা
রাত্রিকে রেখেছো ভরে গানের স্ফুলিঙ্গে সপ্তরথী
কুৎসিতের ব্যুহ ভেদ করবার মন্ত্র আজীবন
পেয়েছি তোমার কাছে’

আধুনিক কবিতার মুক্ত গদ্যধর্মী বিশ্বকবিতার অনুধাবন রয়েছে তার কবিতার হৃদপি-ে। ব্যক্তি জীবনে তিনি যতটুকু নম্রভদ্র নতজানু বিনয়ী তেমনি কবিতায় প্রেম, দ্রোহের অভ্যন্তরে সত্যকে প্রকাশ করেন কৌশলী প্রতীকীভাবে। অবিনাশী সুস্পষ্ট চেহারায় তার কবিতার মর্মমূলে রয়েছে নাগরিকতা ও মানবিকতা। দেশ চেতনা, আত্মসঙ্কট অস্তিত্বের ধ্যানী অনুধানে তিনি স্বাতন্ত্র্য সত্তায় নিজেকে জাগ্রত রেখেছেন আমৃত্যু। আত্মপ্রসঙ্গের বাইরে তিনি হয়ে ওঠেন সমষ্টির ভাবনায় মানুষের কবি। প্রকৃতি, প্রেম এবং দৈনন্দিনতায় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন রোমান্টিক ও বাস্তবতার নিরিখে। ব্যক্তি ও ব্যষ্টির দ্বন্দ্বকে জয় করেছেন_ গভীরতম জীবনবোধে।

‘করোটিতে জ্যোৎস্না দেখে ক্ষুধার্ত ইঁদুর কী আশ্বাসে
চমকে ওঠে কিছুতে বোঝে না ফণিমনসার ফুল’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শব্দাবলির সহজবোধ্যতার প্রচেষ্টা রয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতায়। সহজভাবে সমগ্রতাকে সব পাঠকের পাঠ উপযোগী করে প্রকাশে তিনি সার্থকতা লাভ করেছেন। জন, জীবন, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব-আনন্দে সব শ্রেণির মানুষই তাকে কবি হিসেবে সাদরে গ্রহণ করতেন। তার কবিত্ব সম্পর্কে জানতেন, দু’একটি কবিতার লাইন পাঠ করে শোনাতেন অবলীলায়। অল্প শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও প্রকৃত পাঠকের দৃষ্টিতে শামসুর রাহমান কবি। তার কবিতা পড়া বা সংগ্রহ করা দরকার অনুভব করতেন। এতটুকু পাওয়া একজন কবির জন্য সৌভাগ্য। তিনি সম্মানিত হয়েছেন রাষ্ট্রীয়ভাবে। কবি সমগ্রজীবনের নিমগ্নতা তাকে করেছে মানুষের প্রিয় কবি। আজন্ম নগরবাসী হলেও তার কবিতায় গ্রামীণজীবনের স্বপ্ন বাস্তবতা অনেকটা অস্পষ্ট। অন্যদিকে নগরজীবনের দ্বন্দ্ব, নৈরাজ্য, অসঙ্গতি প্রেম, বিরহ সবকিছু ধারণ করেছেন তিনি কাব্যভাষা নির্মাণে।

‘জীবন মানেই
তালে তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলা, নিশান ওড়ানো
জীবন মানেই
অন্যায়ের প্রতিবাদ শূন্যে মুঠি তোলা’

একজন কবির সমগ্রজীবনের নিমগ্নতা তাকে করেছে প্রিয় মানুষের প্রিয় মুখ। সুপার স্টার, মিনিস্টার, রাষ্ট্রপ্রধান, শিক্ষক, যুবক, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক তাকে কবি হিসেবে সম্মান করতেন এবং সতীর্থ ভাবতেন। শুনেছি সময় পেলে ষাটের দশকে বিউটি বোর্ডিং পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা মোড়, নিউ মার্কেটে বই সংগ্রহের জন্য যেতেন। প্রকৃতঅর্থে তিনি ছিলেন সময়ের সঙ্গী। তিনি শূন্যতা, নাগরিক বোধ ও রাজনীতিকে সুন্দরভাবে ধারণ করেছেন_ কাব্যচেতনায়।

‘আবেগের পালতোলা নৌকার গলুইয়ে রাত জেগে
কাগজের শুভ্রতায় নক্ষত্রপুঞ্জ আনি
শূন্য ছেনে।’
শূন্য, মৃত্যু ও রহস্যময়তায় পূর্বসূরীদের অমোঘ সত্যের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে তিনি নিজস্বতাকে সচেতনভাবে অর্থবহ করে প্রকাশের উদ্যোগী হয়েছেন।

কবি প্রেমিক ও মানুষ সত্তায় প্রেমের প্রতি আকুতি; নির্লোভ আত্মসংবরণ, মিলনের আকাঙ্ক্ষা যথার্থতা পেয়েছে বোধের গভীরতম উপলব্ধিতে। তার ইতিবাচক জীবনমুখিতা বহুলাংশে মানবিক প্রেম প্রকৃতির স্বভাবজাত উপলব্ধি থেকে। যেখানে মানুষের মূল্যবোধ, নগরজীবনের প্রেম, গ্লানি ও পরিবর্তনের বাইরে তিনি আশাতীত প্রেরণার আত্মকথন কবিতায় বলতে চেয়েছেন। জীবিতকালে পাঠক, লেখক, সমালোচক, সম্পাদকদের কাছে বরেণ্য কবি হিসেবে নন্দিত ছিলেন। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার শামসুর রাহমানকে নিয়ে সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা করেন। এছাড়া কবি হুমায়ুন আজাদের নিঃসঙ্গ শেরপা, মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা শামসুর রাহমান সংখ্যা, মৃত্যুর আগে ও পরে প্রত্যয় জসীমের সম্পাদনায় শামসুর রাহমানকে নিয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। অন্য আলোয় শামসুর রাহমান ও শামসুর রাহমান স্মারক গ্রন্থদ্বয়_ উল্লেখযোগ্য।

আশির দশকে বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসতেন। যখন আজিজ সুপার মার্কেটে আসতেন তাকে সবাই বরণ করে নিতেন। আমি বৈশাখী প্রকাশনার দরজায় অপেক্ষা করতাম তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে। যখনই বৈশাখীর সামনে আসতেন হাসিমুখে বিনয়ীভাবে করমর্দন করতেন। ৮৫ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে কবিতা উৎসবে শামসুর রাহমানের সানি্নধ্য ও সাহচার্যে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। কবিতার মানুষ হিসেবে আমরা রাহমান ভাইকে গর্বের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েছি। শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট, ছবিরহাট, চারুকলা, টিএসসি, বাংলা একাডেমি, একুশে বইমেলা সবখানেই তার উপস্থিতি ও মধুর বাক্যবাণ সবাইকে মুগ্ধ করেছে।

শামসুর রাহমানের কবিতা যেভাবে সময়ের গতি অতিক্রম করে অনন্ত সম্ভাবনায় ভবিষ্যতের দিকে গতিশীল তেমনি আবেগের পরিভ্রমণে তিনি সর্বত্রই ছিলেন সরব ও সজাগ। কবিতার বাইরে শিশুসাহিত্য, ছড়া, গল্প, উপন্যাস ও স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখেছেন। স্মৃতির শহর গ্রন্থে নাগরিক জীবনের জীবিকার সব শব্দ উপমা প্রতীক, মিথ ঐতিহ্য ইতিহাস তিনি আত্মিকভাবে গ্রহণ করেছেন। যুগ যন্ত্রণার সত্য মূলের সন্ধান করতে গিয়ে আন্তরিক আশাবাদ ব্যক্ত করেন_ আমি চাই এ দেশের মানুষ সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক। শিশুরা ভালো করে বেড়ে উঠতে পারে। তাদের প্রতি যেন কোনো নির্যাতন না হয়।

‘আমাদের সন্তানেরা দুলছে মৃদু ছন্দে
অসংখ্য লাশের যম-তাড়ানিয়া উৎকট দুর্গন্ধে’

তিনি সর্বক্ষেত্রেই কবি হিসেবে মানবিকতাকে লালন করেছেন অন্তরে। সত্য সুন্দর মানুষের কাতারে শামসুর রাহমান যেভাবে দেশবরেণ্য খ্যাতির শিখরে তেমনি পাঠক হৃদয়ে প্রিয় মানুষ। বাংলা কবিতার জীবনীশক্তি ও রক্ত কণিকার সঙ্গে সম্পৃক্ততা তার সৃষ্টিশীলতায় ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচর্যায় বাংলা কবিতা হয়ে উঠেছে শিল্পসম্মত ও সুস্পষ্ট। স্বাধীনতা উত্তর ও পরবর্তীকালে তার অসামান্য কাব্য নিপুণতা ও দক্ষতা জ্যোতিষ্ক করে রেখেছে বিগত দশককে জীবনের নানা উক্তিতে তিনি ভালোবেসে ছিলেন গণমানুষের জনজীবন জীবন সংগ্রামের জয় ও ব্যর্থতাকে। তিনি বিশ্বাস ও লালন করতেন_ লেখাটাই আমার জীবন। কবির মধ্যে এক ধরনের সত্য নিষ্ঠতা থাকে, সে যদি কবি হয় সত্য বলবেই। যতই উপেক্ষা করুক_ সত্য তার সত্তা থেকে বেরিয়ে আসবেই। সেই সত্য লুকানো থাকে ভাব ভাষা চিত্রকল্পে।

‘সূর্যের চুল্লীতে আমি বহুদিন সেঁকেছি আত্মাকে
উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ওহে, তবু দেখি এখানে সেখানে
থেকে যায় স্যাঁত স্যাঁতে ভাব’

শামসুর রাহমানের কবিতায় নগরায়ণ হাসি-কান্না-আনন্দ-দুঃখ, ক্ষোভ-নিরাশা-গ্লানির বৈপরীত্য পেরিয়ে, তার কবিতায় সত্য সুন্দর, সন্ধানের আকাঙ্ক্ষা লক্ষণীয়। নাগরিক জাঁতাকলে বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরের স্বপ্ন বাস্তবতা অবলোকন করেছেন কাছ থেকে। রীতি-নীতি শাসন-শোষণ-বঞ্চনার অনুভব তাকে নাগরিক জীবনের প্রতিভূ করেছে।

‘কোনো একদিন গাঢ় উল্লাসে ছিঁড়ে খাবে টুটি
হয়তো হিংস্র নেকড়ের পাল…
হয়তো কখনো আমার ঠা-া মৃতদেহ ফের খুঁজে পাবে কেউ
শহরের কোনো এক নর্দমাতেই…’

ব্যক্তি মানুষের বাইরে শামসুর রাহমান সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে নানা ভূমিকা রেখেছেন। স্বৈরশাসনের অবসান, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তার ভূমিকা ছিল কবিতায় ও রাজপথে। বহুমাত্রিকতায় থেকেও তিনি সার্বক্ষণিক কবি। একাধারে পেশাগত ও সামাজিক বৈরিতার বিপক্ষে আমরণ লড়াইয়ের মধ্যমণি। বরেণ্য কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস_ শামসুর রাহমানকে ঢাকা শহরের কবি মনে করতেন। তার কবিতায় ঢাকা শহরের উত্তেজনা, সংকল্প, উত্থান ও ক্লান্তি এমনভাবে টুটে এসেছে যে ইলিয়াস মনে করেন এ শহরের সঙ্গে তিনি হেঁটে চলেছেন ছায়ার মতো।

অন্যভাবে শম্ভু মিত্রের মতে, বর্তমান যুগের হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদ এবং সব অতিক্রম করে আশার সুর শামসুর রাহমানের কবিতায় যেমনভাবে বেজেছে, উভয় বাংলার খুব কম কবির কাব্যকীর্তিতে তেমনটি দেখা যায়।

‘যেন মৃত্যুর অকস্মাৎ এ শহরে সবক’টি ঘরে
দিয়েছে বাড়িয়ে হাত, শহরের প্রত্যেকটি ঘড়ি
হয়েছে বিকল আর শোক পালনের মতো কটি
এখন কোথাও নেই, ভয়ানক নৈঃশব্দের ঝড়ে
শহর ময়ূর বুকে একটি কাঁকড়া শুধু তড়িঘড়ি
যাচ্ছে ঠেলে ঠেলে ক্রমাগত শূন্যতার দিকে’

শামসুর রাহমানের বিশেষত্ব হলো_ তিনি সব ঘটনাকে কবিতা করে তুলতেন। সংবেদনশীল কবিসত্তা, জীবনাসক্তি ও আধুনিক কবিতার কলাকৌশল সম্পর্কে সচেতন থাকায় তিনি অর্জন করেন_ বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবির শিরোপা। তিনি পূর্বসূরী ও উত্তরসূরী অধিকাংশ কবির সঙ্গে ব্যক্তিগত বা রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টপাধ্যায়, এলিয়ট থেকে লাওয়েল, বোদলেয়ার থেকে নেরুদা, বরার্ট ফস্ট সব কবির রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন নিবিড়ভাবে। অনেকের কবিতাও বাংলায় রূপান্তর করেন সফলভাবে।

মৃত্যুর কিছুকাল আগে ২০০৭ একুশের বইমেলায় স্বপ্নপুরী প্রকাশনা থেকে আমি ও সৈয়দ রূপক রশীদের তত্ত্বাবধানে সৈয়দ এনায়েত আলীর সঞ্চয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বইটি মোড়ক উন্মোচন হয় শামসুর রাহমানের শ্যামলীর বাসায়। বইমেলার সর্বশেষ বইটি মোড়ক উন্মোচনে আমি, সৈয়দ এনায়েত আলী (অনিক) ও এনায়েত দাউদী শ্যামলীর বাসায় গিয়ে বইটি মোড়ক উন্মোচনের ঘোষণা পাঠ লিখে নিই। ২০ মিনিট সময় ধরে ভিডিওচিত্র ধারণ করেন সৈয়দ এনায়েত আলী। বইটির ওপর শামসুর রাহমানের ঘোষণা বাণীটি আমি বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে পাঠ করি_ বইটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করি। এ ধরনের বিরল সৌভাগ্য হয়েছে একজন কবি ও প্রকাশক হিসেবে। তারুণ্যই ছিল তার প্রাণ। চিরতরুণের মতো সুন্দর স্টাইলে আজীবন তারুণ্যকে বহন করেছেন। তরুণ কবিদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তরুণ কবিদের মঙ্গল কামনা করি। তাদের প্রতি আমার একটা অনুরোধ, তারা যেন ভ-ামি বা কূপম-ূকতাকে প্রশ্রয় না দেন। একজন ভালো কবি হওয়ার পাশাপাশি একজন ভালো মানুষ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।’

মানুষের জন্য কবির মঙ্গল চিন্তার স্পর্শকাতর মন স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতায়। তিনি তার দর্শন ও কাব্যবিশ্বাসকে দৃঢ়তার সঙ্গে সংরক্ষিত করেছেন। ফলে বাংলাদেশের কবিতায় যে মধ্যযুগীয় কাব্য বিশ্বাসের প্রভাব বলয় থেকে বাংলাদেশের কবিতা মুক্ত স্বাধীন ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর জীবনমুখী তার স্পর্ধাকে সম্ভাবনাপূর্ণ করেছেন। শুধু বাংলা কবিতাকে তিনি সমৃদ্ধি করেননি, ভাষাশৈলীকে নিজের মতো প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

‘আমাদের ক্ষত সরে গেলে
কোন একদিন বিনম্র বিকেলে
তোমাদের কাছে যাবো হে আমার সবচেয়ে আপন গোলাপ
করবো না কথার খেলাপ’