ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » বিনোদন » বিস্তারিত

বাংলাদেশে সম্মাননা পাচ্ছেন ভারতের পার্বতী বাউল

২০২১ অক্টোবর ১২ ১৬:০৬:২২
বাংলাদেশে সম্মাননা পাচ্ছেন ভারতের পার্বতী বাউল

বিনোদন ডেস্ক : কঠিন কথা সহজে বলে ফেলার নাম যদি হয় কবিতা তবে নিখুঁত সত্যকে সুর তালে ছুঁয়ে ফেলার নাম বাউল সাধনা। সহজ শব্দে গভীর দর্শনকে তুলে ধরেন বাউল গানের শিল্পীরা। তাদের গানে মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ। এখানে প্রেম আসে কামনা বাসনার খোলসে প্রাণকে আলোকিত করার মানসে। এ এক বোধ, কঠিন জীবনের সন্ধান। যার নাগাল পেতে করতে হয় সাধনা।

অনেকে তাই বাউল গানের শিল্পীদের সাধক বলেও সম্মানিত করেন। তেমনি একজন পার্বতী দাস বাউল।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই শিল্পীর গান বাংলাদেশেও খুব জনপ্রিয়। তিনি মূলত বাংলা ভাষার বাউল চর্চাকেই নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। তার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা। পেয়েছেন নানা দেশে নানা রকম পুরস্কার ও স্বীকৃতি।

এবার এই শিল্পীকে লালন স্মারক সম্মাননা প্রদান করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। শিল্পী নিজেই বেশ উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে খবরটি জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘সপ্তমীর পবিত্রতার ভিড়ে চমৎকার এই খবরটি শেয়ার করতে পেরে আমি আনন্দিত। বাউল শিল্পে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আমাকে এই সম্মাননা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।’

জাতীয়ভাবে লালন চর্চার লক্ষে প্রতি মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শিল্পকলা একাডেমির বাউলকুঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাধুমেলা’। আসছে ১৬ অক্টোবর সেই সাধুমেলায় এই সম্মাননা তুলে দেয়া হবে পার্বতী বাউলের হাতে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে থাকেন পার্বতী দাস বাউল। তবে তার প্রকৌশলী বাবা আর মা চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। রাউজানের পশ্চিম গুজরার গ্রামের পারিয়ালপাড়ায়। দেশভাগের পর তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। বাবার চাকরির কারণে নানান জায়গায় থাকা হলেও শৈশবের উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে আসাম ও কোচবিহারে।

সত্তরের দশকে পার্বতীর জন্ম। আসামে বাঙালি বিতাড়নের আন্দোলনের সময়ে বাবার হাত ধরে চলে আসেন কোচবিহারে। সেখানেই কেটেছে তার শৈশব। পার্বতীরা এক ভাই, তিন বোন।

বাবা-মা দুজনই সংগীতপ্রিয় মানুষ ছিলেন। পার্বতীর হাতেখড়ি হয় উচ্চাঙ্গসংগীত ও কত্থক নৃত্যে। শৈশবেই। ১৬ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে পড়তে যান। পার্বতী পড়েছেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। পাঠক্রমের অংশ হিসেবে বেরিয়ে পড়েন গ্রামের দিকে। কাজ ছিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাউলদের ছবি আঁকা। খুব আনন্দ দিয়ে আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়াতেন সহপাঠীদের নিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে পার্বতী মনে প্রশ্ন আসে, বাউলেরা এত ভালো মানুষ হয় কী করে? মনে হয়, বাউলেরা কত সহজ, কত গভীর, কত নিরহংকার! এ শুধু গান নয়, একটা দর্শন, ভাব। সেই ভাবের মধ্যেই থাকেন বাউলরা।

একদিন পরিচয় হলো ফুলমালা দাসীর সঙ্গে। তিনি কলাভবনে আসতেন। তার কাছে পার্বতীর আবদার, ‘গান শিখব।’ ফুলমালা নারাজ। আকুতি–মিনতির একপর্যায়ে রাজি হলেন এক শর্তে- ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করতে হবে, পার্বতীকে সঙ্গে থাকতে হবে। তা-ই হলো। ট্রেনে ভিক্ষা করতে করতে পার্বতী গান শিখলেন। কলাভবনের ক্লাস শেষ করে ফুলমালা দাসীর সঙ্গে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরতেন। গান করতেন, ভিক্ষা করতেন। বিশ্বভারতীর সহপাঠীরা এসব ট্রেনেই আসতেন। তাঁদের কাছেও গান শুনিয়ে ভিক্ষা চাইতেন তিনি। বন্ধুরা তো ভেবেই নিল, পার্বতী দাসের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কলাভবনের শিক্ষার্থীর গান গেয়ে ট্রেনে ভিক্ষা- এটা কেউই সহজভাবে নিতে পারেনি। কিন্তু পার্বতী সেটাকেই জীবনের সাধনা করে নিলেন।

’৯৪ সালের দিকের কথা। একদিন সনাতন দাস বাউল এলেন কলাভবনের চাতালে। পৌঁষ মেলায়। তাকে দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছেন পার্বতী। শিষ্য গুরু পেয়ে গেলেন, গুরু শিষ্যকে গ্রহণ করলেন। কলাভবন ছেড়ে পার্বতীর গন্তব্য বাঁকুড়ার সোনামুখী। সনাতন দাসের আশ্রম। প্রায় সাত বছর সনাতন দাস বাউলের সঙ্গে দেশ-দেশান্তরে, আশ্রমে আশ্রমে গান করেন গুরু-শিষ্য। কখনো গুরুর সঙ্গে সুর তুলেছেন, কখনো দিয়েছেন তাল, নেচে-গেয়ে মাতিয়েছেন আসর। একসময় গুরুর পরামর্শে পার্বতী চলে যান কর্ণাটকের হাম্পিতে, এক সাধকের কাছে। সেখান থেকে কেরালায়। এখানে দেখা হলো আধ্যাত্মিক গুরু আবদুস সালামের সঙ্গে। তার কাছে দীক্ষা নেন পার্বতী। ২০০৭ সালে গুরু আবদুস সালাম মারা যান। এর আগে অবশ্য গুরুর নির্দেশে পার্বতী ১৯৯৭ সালে বিয়ে করেন কেরালার রবি গোপাল নায়ারকে।

জটাধারী পার্বতী বাউলের গানের পরিবেশনার আছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। মঞ্চে নেচে নেচে অনুষ্ঠান করেন তিনি। তখন একটা অদ্ভুত আবহ তৈরি হয়। এই পরিবেশনার রহস্য নিয়ে তার ভাষ্য, ‘গুরু সনাতন দাস এভাবেই গান গাইতেন। আমি সেই ধারাই অনুসরণ করি। বাউল নাচের একটা পদ্ধতি আছে। বৈষ্ণব সাধকদের নাচের ধারাটাই সনাতন দাসেরা বহন করেছেন।’

বর্তমানে পার্বতী বাউল বীরভূমে একটি বাউল আশ্রম পরিচালনা করেছেন। ৪০ জনেরও বেশি বাউল সেখানে চর্চা করেন। এছাড়াও বাউল গান সংগ্রহ, সংরক্ষণে নানা রকম উদ্যোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে অত্যন্ত পরিচিত পার্বতী দাস বাউলের।

(ওএস/এসপি/অক্টোবর ১২, ২০২১)