ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » আনন্দ বেলা » বিস্তারিত

ঘরপালানো এক শিশুর কাহিনী

২০২১ ডিসেম্বর ১৭ ১৩:৩৮:৩৩
ঘরপালানো এক শিশুর কাহিনী

রুমান হাফিজ


গ্রামের বাড়িতে আসলে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। কোথাও না কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। শহুরে বন্দিজীবন থেকে বের হওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য। তবু একটু সুযোগ পেলেই আমি ছুটে আসি গ্রামের বাড়িতে, যেখানে আমার ভালোলাগার সব উপকরণ আছে।

সুবিশাল মাঠ, নদী, খাল-বিল, গাছগাছালি কিংবা কাদামাখা মেঠোপথ আরোও কতো কি! সেদিন বিকেলবেলা বাড়ির পাশেই একটা মুদিদোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। মুদি দোকানি আজিজ মামা আর আমরা চারজন মতি, সুমন ও মুয়াজ ছাড়া আর কেউ ছিল না তখন।

আমাদের আড্ডা চলছে এমন সময় এসে উপস্থিত হলেন এনাম চাচা। পুরো নাম শফিকুল হক এনাম হলেও এনাম নামেই পরিচিত সবার কাছে। এলাকাজুড়ে এনাম চাচার অন্য একটা পরিচয় রয়েছে, তা হলো তিনি একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। চাচা আমাদের পাশে বসলেন। আমরা তখন চাচার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, আচ্ছা চাচা যখন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাহলে তো চাচার কাছ থেকে যুদ্ধকালীন তথ্য জানা যাবে।

আমি চাচার কাছে জানতে চাইলাম- আচ্ছা চাচা, আপনি তো সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তখনকার কোনো ঘটনা যদি বলতেন।

-অসুবিধে নেই, নিশ্চয় বলবো ভাতিজা।

চাচা তখন বলতে শুরু করলেন-

পাকবাহিনী আমাদের নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল পঁচিশে মার্চের কালো রাতে। অসংখ্য মানুষকে সেদিন তারা হত্যা করেছিল নারকীয় কায়দায়। তখন সারাদেশব্যপী প্রতিবাদের ঝড় শুরু হলো। স্বাধীনতার ডাক পড়ে গেলো, সবাই যে যার মতো করে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিলো। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, খুব একটা বড় না হলেও তখনকার পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে পারতাম। আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা দেশের চলমান অবস্থা নিয়ে বেশ কথাবার্তা বলতেন। আমাদেরকে দেশের জন্য সব সময় জাগ্রত থাকতে বলতেন।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্কুল-কলেজ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমার সঙ্গে যারা পড়তো তাদের অনেকেই মুক্তিসেনার খাতায় নাম লিখিয়ে ট্রেনিং-এ চলে যায়। আমি তখনো যেতে পারিনি। তার কারণ হলো আমাকে পরিবার থেকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না বয়সে ছোট বলে। কিন্তু আমার আর ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। রেডিওতে নিয়মিত সংবাদ শুনতাম। পাকসেনাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিসেনার লড়াইয়ের খবর প্রচারিত হতো। লোকমুখে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা কথাবার্তা শুনে আমি সুযোগ খুঁজছিলাম কীভাবে যাবো।

একদিন রাতে ঘরের বারান্দায় বসে রেডিওতে খবর শুনছিলাম। এমন সময় কিছুদূর থেকে হঠাৎ করে কার যেন গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি রেডিও রেখে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম, তিন-চারজন মানুষ আমাদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছিল। পথিমধ্যে আমাকে দেখে তারা আমাকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করে। আমি তখন বাড়ি দেখিয়ে বললাম, এই যে আমার বাড়ি। তাদের কাছে আমি পরিচয় জানতে চাইলাম। তারা প্রথমে বলতে না চাইলেও আমার পীড়াপীড়িতে একজন বলল, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা’।

ওরা মুক্তিযোদ্ধা শুনে আমার তর সইছিল না। আমি তাদের সঙ্গে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আমার কথা শুনে উনারা একজন আরেকজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। হয়তোবা এতো ছোট ছিলাম যে উনারা আমার কথা শুনে কী বলবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে সেদিন আমাকে না নিয়ে আশ্বাস দিলেন কয়েকদিন পর নিয়ে যাবেন। আমি তাদের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রতিদিন রাতে ঠিক এই সময়টাতে আমি তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু তাদের সঙ্গে আর যাওয়া হয়নি। তার আগে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে মুক্তিসেনাদের ক্যাম্পে চলে আসি। প্রথমে আমরা দুজনকে দেখে উনারা কী করবেন দ্বিধায় পড়েন। আমাদের ভীষণ ইচ্ছে দেখে সঙ্গে রাখবেন বলে আশ্বস্ত করলেন।

ক্যাম্পে মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং দেখতাম, উনারা বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করতে যেতেন তাও শুনতাম, কীভাবে পাকসেনাদের সঙ্গে লড়াই করতেন। একদম কাছে থেকে তখন মুক্তিযুদ্ধ দেখতে পেরেছিলাম। মনে মনে ভাবতাম যদি আমাদেরও যুদ্ধ করতে নিতেন এবং ট্রেনিং দেওয়াতেন! তবে এই চাওয়া বেশিদিন অপূর্ণ থাকেনি। আমাদের ক্যাম্পের প্রধান একদিন আমাদের দুজনকে নিয়ে বসলেন এবং কিছু কাজ বলে দিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো- নিয়মিত রেডিওতে খবর শোনা, তবে এ কাজ করতে হবে একদম আড়ালে গিয়ে, তারপর নিজেদের ক্যাম্পে সতর্কতাবস্থায় থাকা, পাকসেনাদের ক্যাম্পে ছদ্মবেশে চোখ রাখা এবং তাদের চলাফেরার দিকে খেয়াল রাখা। আমরা আমাদের উপর আরোপিত কাজ করে যেতে লাগলাম।

একদিন একা আমি পাকবাহিনীর একটা ক্যাম্প দেখে আসার জন্য গেলাম। ছোট বলে ওরা আমাদের উপর তেমন নজর দিতো না। দেখা শেষ করে ফিরবো এমন সময় এক পাকসেনার সামনে পড়ে যাই। আমাকে জিজ্ঞেস করে, এখানে কী করি। আমি উত্তরে হাত দেখিয়ে বললাম, ‘দোকানে গিয়েছিলাম খরচ আনতে। কিন্তু দোকান বন্ধ পাই।’ সেদিনের মতো বেঁচে যাই।

এর কিছুদিন পর আমি আবার পাকসেনাদের ক্যাম্পে যাই, দূর থেকে ওদের আলাপ পুরোপুরি শোনা যাচ্ছিল না। আমি আরেকটু কাছে গিয়ে আড়ি পাতলাম। ওরা সবাই মিলে আলাপ করছিলো কীভাবে বাঙালিদের শেষ করে দেবে, কীভাবে হত্যা করবে, কোথায় কীভাবে অপারেশন চলছে ইত্যাদি। আলাপের একপর্যায় শুনতে পেলাম ওদের একজন বলছে আগামীকাল তো সুনাপুর ক্যাম্পে আমাদের অপারেশন। সুনাপুর বলতে যে ক্যাম্পটায় আমি ও আমাদের মুক্তিসেনারা অস্থায়ী বাস করছি।

সুনাপুর অপারেশন করতে আসছে শুনে আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো, নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে আসি। আমাদের ক্যাম্প-প্রধানের কাছে খবরটা পৌঁছে দেই। উনি সবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন, কীভাবে ওদের অপারেশন প্রতিহত করা যায়। সবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা খুব দ্রুত ক্যাম্প ত্যাগ করি।

ওদের অপারেশন প্রতিহত করতে আমাদের প্রস্তুতি চলতে লাগলো। এদিকে আমি ও আমার বন্ধু পাকসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে তাদের অবস্থা দেখে আসি। রাত তিনটা। চারদিকে নিস্তব্ধতা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। দূর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। হঠাৎ করেই গুলির আওয়াজ এসে কানে বাজে। বুঝতে আর বাকি নেই ওরা এসে গেছে আক্রমণ চালাতে। আমরা আমাদের কৌশলী অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করছি। ওরা আক্রমণ করেই যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের থেকে কোনো রকম পাল্টা আক্রমণ না পেয়ে মনে মনে বেশ খুশি হয় পাকসেনারা।

ক্যাম্পের একদম কাছে এসে আক্রমণ চালাতে থাকে, তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আস্তে আস্তে ওদের গুলির আওয়াজ কমতে থাকে। আমরা তাদের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করে এগিয়ে আসি। যখন আর কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো না, ঠিক তখনি শুরু হয় আমাদের পক্ষ থেকে পাকসেনাদের লক্ষ্য করে আক্রমণ। আকস্মিক আক্রমণে ওরা দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। পেছন দিক থেকে আমাদের আক্রমণে ওরা একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়ে।

কিছু সময়ের মধ্যে পাকসেনাদের সবগুলোকে খতম করে দিতে সক্ষম হই। সেদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন পাকসেনা আমাদের হাতে মৃত্যুবরণ করে। সেদিনের কৌশলী যুদ্ধ আজও আমার মনে পড়ে, তখন গর্বে বুকটা ভরে উঠে।