ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

চিলিতে বাম বিজয় : বাংলাদেশে বামপন্থীদের করণীয়

২০২১ ডিসেম্বর ২৮ ১৭:৩০:০৯
চিলিতে বাম বিজয় : বাংলাদেশে বামপন্থীদের করণীয়

রণেশ মৈত্র


দক্ষিণ আমেরিকার আলোচিত একটি দেশের বিপ্লবী জনসাধারণ সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী করলেন সে দেশের বামপন্থী যুবক গ্যারিয়েল বোরিককে। বোরিকের বয়স ৩৫ বছর মাত্র। তিন দশক আগে ক্ষমতা দখলকারী বোরিস পিনোশের শ্বৈরাচারী শাসন তাঁর ও তার উত্তরসূরীরা ত্রিশটি বছর ধরে চালিয়েছে ঐ দেশে। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এতদিন পরে সে দেশের মানুষ এই শুভ পরিবর্তন আনলেন সমাজ-অর্থনীতি প্রভৃতিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে দিন বদলের প্রত্যাশা নিয়ে।

১৭৯০ সালে উঁচু মানের সংস্কৃতির ধারক মার্কসীয় আদর্শে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী জননেতা স্যালভেদর আলেন্দে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হন পপুলার ইউনিটির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে। কমিউনিষ্ট পার্টি, সোশ্যালিষ্ট পার্টি সহ কতিপয় বামপন্থী দল সম্মিলিত হয়ে পপুলার ইউনিটি নামে একটি মোর্চা গঠন করে তার মাধ্যমে নির্বাচন কার্য্য পরিচালনা করেন।

নানা জনমুখী কার্য্যক্রমের দ্বারা আলেন্দে তাঁর ও পপুলার ইউনিটির জনপ্রিয়তা কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও রাতারাতি বড়লোক হওয়ার প্রত্যাশী অংমের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ওৎ পেতে থাকা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সময় নষ্ট না করে ১৯৭৩ সালে তার মদদে চিলিতে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে স্যালভেদর আলেন্দের ইেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করে। সেই থেকে এ যাবত স্বৈরাচারী ও তাদের উত্তরসূরীদের দ্বারা চিলি শাসিত হয়। ২০২১ এর শেষে এসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রবল বাম আন্দোলনের পটভূমিতে দক্ষিণপন্থী প্রার্থীকে বিপুলভাবে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করলেন। দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলে রচিত হলো নতুন ইতিহাস-হয়তো বা ওই গোটা অঞ্চল জুড়েই প্রগতি প্রতিক্রিয়ার লড়াই তীব্রতর হবে এবং প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলি দুর্বল হবে।

চিলির মানুষ বহুদিন পর ভোটে পরাজিত করলেন বোরিকের প্রতিদ্বন্দ্বী কট্টর দক্ষিণপন্থী জোসি এস্তোনিও কার্লকে।
ভোটের পর বিগত রোববার ঘোষিত ফলাফলে জানা যায় , ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন বোরিক-আর ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তাঁর দক্ষিণপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী। নির্বাচনী ইতিহাসে দুটি রেকর্ড স্থাপিত হলো। এক. চিলির সর্বকণিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন তিনি। দুই. বিশ্বের দ্বিতীয় কণিষ্ঠতম প্রেসিডেন্টও হলে তিনি। এখন পর্য্যন্ত ৩০ বছরের কম বয়সী প্রেসিডেন্ট হওয়ার রেকর্ড রয়েছে স্যান ম্যাবিনেরার জিয়াকমো নিমনচিনির। তিনি নির্বাচিত হন ২৭ বছর বয়সে।

বোরিকের জয়ে তার ভক্ত সমর্থকেরা উল্লাসে মেতে ওঠে। চিলির রাজধানী সাষ্টিয়াপোতে লাখো মানুষ বিজয় মিছিললে অংশ নেয়। এ সময় সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বোরিক বলেন, চিলিতে নতুন দিনের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। কতিপয় সুবিধাভোগীর অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে দেওয়া হবে। সমাজে জেঁকে বসা বৈষম্য দূর করতে লড়াই চালু থাকবে।
ভোটের ফল ঘোষণার দেড় ঘন্টার মধ্যে বোরিককে স্বাগত জানিয়েছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনিয়েরা। তাঁর সঙ্গে ফোনালাপে বোরিক বলেন, চিলির সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে যথেষ্ট চোষ্ট করবো।

১৯৯০ সালে চিলিতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসার পর এবারের নির্বাচনেই মেরুকরণ ছিল সবচেয়ে বেশী। তাদের নির্বাচন বামপন্থী ও ডানপন্থীর লড়াই হিসেবে পরিচিতি পায়। নির্বাচনী প্রচারের সময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ছিল।

কমিউনিষ্ট পার্টিকে নিয়ে বোরিকের নেতৃত্বে বাম জোট নির্বাচনে নামে। তিনি দশক আগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক স্বৈরাশাসক জেনারেল পিনোশের পক্ষে নির্বাচনী প্রচাকালে কথা বলায় কাস্তও ব্যাপকভাবে নিন্দ্বিত হন। চিলিতে চিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের ২০১৯ সালে কয়েকমাস ধরে বিক্ষোভ হয়েছে। এর প্রেক্ষিতেই প্রথমবারের মত ভোট হলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। এই ফলাফলের কারণে সে দেশের সে দেশের সংবিধানে প্রগতিমুখীন সংস্কারের সুবিধা হয়েছে। গরীবি হটাও নীতি সংবিধানে জায়গা করে নেবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

প্রেসকুইন্টোস নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কেনেথ বাংকার চিলির এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচকে শীতল যুদ্ধের বৃত্তে আটকে থাকা কমিউনিজম বনাম ফ্যাসিবাদের মধ্যে যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এটি বাম বনাম ডান বিভাজনের চিত্র।

নভেম্বরের মাঝামাঝি প্রথম রাউ- প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হয়। প্রার্থী ছিলেন সাত জন। সেখানে এগিয়ে থাকা দুই প্রার্থীর মধ্যে গত রোববার ভোট হয়। ৫৫ বছর বয়সী কাস্তের বিরুদ্ধে বোরিকের এই নির্বাচনে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যে সব দাবী নিয়ে চিলির মানুষ বেশী উচ্চকিত তার মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ, অবসরকালীন আংশিক ভাতা প্রভৃতি। উল্লেখ্য যে চিলির শিক্ষিতের হার শতকরা ৯০ শতাংশেরও বেশী। স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে তাদের উন্নতি লক্ষ্যনীয়। খনিজ সম্পদেরও সমৃদ্ধ দেশটি। তবে বিশাল লম্বা ও অল্প প্রস্থ সম্পন্ন দেশটির নানা অঞ্চলে নানা বিপরীতমুখী আবহাওয়া বিদ্যমান। এটি আবার পর্য্যটন শিল্প বিকাশের সহায়ক বলে বিবেচিত।

তাই সম্পদের প্রাচুর্য্য না থাকুক, অভাব নেই। কিন্তু যে শোষনের মাত্রাধিক্যের জন্য চিলির মানুষ এই ঐতিহাসিক বিজয় যেখানকার কমিউনিষ্ট ও বামপন্থীদেরকে তিনটি দশক পরে এনে দিলো-সেই প্রত্যাশা, অন্তত: দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের, পূরণ করতেই। কাজটি একদিকে কঠিন অপরদিকে তার কোন শেষও নেই। দারিদ্র্য মেটানো গেলেই তাই চাহিদা শেষ হবে না। জীবনেক সুন্দরতর কতরতে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল অর্জন ক্রমান্বয়ে পূরণের দায়িত্ব নিতে হবে। নিশ্চয়ই নতুন ক্ষমতাসীনরা সে দিকে খেয়াল রাখবেন।

অতীতের ধনিক শ্রেণীর সম্পদ জাতীয়করণ আকস্মিকভাবে করলে সম্ভবত: মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ত্বরান্বিত হবে। ভাবনায় এগুলো সবই রেখে যেমন ধীরে-তেমনই দ্রুততার সাথে অগ্রসর হবেন চিলির বামপন্থীরা এমন বিশ্বাস রাখতেই চাই।

চিলির দুই বিখ্যাত নোবেলজয়ী পাবলো নেরুদা কমিউনিজমে বিশ্বাসী থেকে ও সারা বিশ্বের মনজয় করেছিলেন একজন উদ্দীপনার কবি হিসেবে। নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন। চিলিতে আরও একজন গ্যাব্রেলা মিষ্ট্রু নোবেল জয় করেছিলেন। এটা চিলির সাংস্কৃতিক উচ্চমানের উৎকৃষ্ট একটি প্রমাণ। এই উচ্চমান উচ্চতর হতে থাকুক-চিলির সভ্যতার উচ্চতম বিকাশ সারা বি শ্ব-সভ্যতার উচ্চতম বিকাশ সারা বিশ্ব-সভ্যতার উচ্চতর বিকাশ ঘটাতে অগ্রসর হোক। নিকটেই আছে কিউবা-তার সহযোগিতাও নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে-সেখান থেকে অনেক অভিজ্ঞতাও পাওয়া যাবে অবশ্যই।

চিলির নির্বাচন বিশ্বের দরবারে যে নতুন দিকের সূচনা করলো তার পরিপূর্ণ সাফল্য বহু দূরদেশ বাংলাদেশ থেকে কামনা করি। জনসংখ্যা চিলির মাত্র দুই কোটি মত। সকলকে অভিনন্দন জানাই। এবার চোখটা ফেরাই নিজ মাতৃভূমির দিকে। কোন আশাবাদের চিহ্ন এখন পর্য্যন্ত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরাও এগুচ্ছিলাম কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড মনি সিং জোরের সাথ্যে ১৯৭২ এর দিকে আশা প্রকাশ করেছিলেন ভিয়েতনামের পরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবটি শান্তিপূর্ণ পথেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে কিন্তু তা হয় নি। কারণ বামশক্তিগুলি এখনও সঠিক পর্য্যালোচনা করেছেন বলে শুনি নি। তবে আমার মতে ১৯৭৫ এর পরে বাংলাদেশের বামপন্থী সংগঠনগুলি ও তাদের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে প্রধানত:

(১) ৭৫ পরবতী সামরিক শাসকদের নিষ্ঠুর নির্য্যাতন;

(২) ১৯৯৩ তে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্য্যয় জনিত হতাসা;

(৩) ঐ হতাশা থেকে দলীয় কাঠামোর মধ্যে রাজণৈতিক মতদ্বৈধতা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস এমন কি, বিরোধীদেরকে “বিলোপবাদী”, সমাজতন্ত্রের দুশমন বলে প্রচার করা;

(৪) আকমিউষ্টি বৃহৎ সমাজতন্ত্রী দলাটি ১৯৭৩ নির্বাচনে ব্দিতীয় বৃহত্তম এবং সর্বাধিক সম্ভাবনাময় দলটি মূল নেতৃত্বের অহংবাদে আক্রান্ত হয়ে দলটির আর্দশনিষ্ঠ অংশ দফায় দফায় দলত্রাগ করায় আদর্শে অবিচল থাকলেও সংগঠনটি কয়েকটুকরায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভেদ আদর্শিক মতানৈক্যজাত না হওয়ায় দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগে বৃহত্তর অংশটি বারবার নিলেও তা এখনও সফল হয় নি।

(৫) যাদেরকে বিলোপবাদী বলে আখ্যায়িত করা হলো তাঁরাও নানা দলে চলে গিয়ে আজ দৃষ্টির বাইরে চলে গেছেন। কিছু অংশ নানা দলে যোগ দিয়ে নিজেদের রাজণৈতিক অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন।

(৬) আরও কিছু বাম দল সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে না পারছেন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে। না পারছেন নিজ নিজ সংগঠন গড়ে তুলতে। তবে সমাজতন্ত্রই লক্ষ্য, একথা এখনও তাঁরা বলে চলেছেন।

এইবার দেশের পরিস্থিতিটার দিকে চোখ ফেরানো যাক।

এক. অসংখ্য কোটিপতির সৃষ্টি হেেছ দেশের ৯৯% সম্পদ তাদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এই কোটিপতিরা দেশের জন্য সংখ্যার ১ ভাগও নন।

দুই. ৯৯% মানুষ ঐ সম্পদের ১ভাগ মাত্র পাচ্ছেন।

তিন. দারিদ্র্য বেকারত্ব ক্রমবর্ধমান এবং জনসংখ্যার তাঁরা কমপক্ষে ৮০ ভাগ।

চার.সাম্প্রদয়িকতা ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাঁচ. নারী-নির্য্যাতন অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে;

ছয়. দুর্নীতি সীমাহীন পর্য্যায়ে পৌঁছেছে। তেমনই বেড়েছে অর্থ পাচার ও দলীয় প্রীতি।

সাত. নির্বাচন ব্যবস্থা পরিপূর্ণ অর্থেই গণতন্ত্র পরিপন্থী ও ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন হয়ে পড়েছে।

তাই একথা জোর দিয়ে বলা যায়ঃ কমিউনিষ্ট ও বামপন্থীরা দ্রুত কার্য্যকর ঐক্য গড়ে তুলে ঐব্যবদ্ধ গণ আন্দোলন বিজয় অর্জন পর্য্যন্ত অবিরাম চালানো গেলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়া অথবা শক্তিশালী বিরোধী দলে পরিণত হয়ে জনতার স্বার্থ নিয়ে মুখরিত আলোচনার পরিস্থিতি সৃষ্টি সম্ভব। সকল স্তরের মানুষকে হতাশামুক্ত করার আর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।