ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত

বীর মুক্তিযোদ্ধার অনাকাঙ্খিত প্রয়াণ ও কিছু স্মৃতি কথা

২০২১ ডিসেম্বর ২৯ ১৫:৫১:১৪
বীর মুক্তিযোদ্ধার অনাকাঙ্খিত প্রয়াণ ও কিছু স্মৃতি কথা

উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক : ১৯৪৯ সালে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা বিধৌত চরপাড়া (পাঠানপাড়া) গ্রামে জন্মেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান প্রামাণিক। তিনি মথুরাপাড়া বিকে উচ্চ বিদ্যালয় এবং জোরগাছা উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই “আঠারো বছর বয়স” অদম্য সাহসের মতোই।

হাফিজুর রহমান বুঝে উঠা থেকেই স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। পরিবারের কাউকে না বলেই ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে গড়ে তোলেন একজন দক্ষ সৈনিক হিসেবে। দীর্ঘ সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ৭১ সালের মার্চে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসেন। ছেলেকে পেয়ে তারা আত্মহারা।

তখন পাকিস্তানি হায়েনাদের আক্রমণ, নির্যাতনে দেশ জাতি নির্বাক। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যোগদানকৃত বাংলার সৈনিকেরা ও জনসাধারণ একযোগে চাইছে “মুক্তি”। গ্রামে-গ্রামে, এলাকায় খোঁজ চলছিল সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালীদের। এদিকে হাফিজুর রহমান এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে বাদাম টানানো নৌকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রওনা দেন।

নৌপথে বাহাদুরবাদ ঘাটে গেলে হানাদাররা তাদের পিছু ধাওয়া করলে তাঁরা চরে আশ্রয় নেন। পরে ভারতের মানিকের চরের কাছে গেলে ডিউটিরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিচয় নেন। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিধায় হাফিজুর রহমানকে রৌমারী পাঠানো হয়। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সেছেন তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ করেন কিছুদিন।

সুবেদার করম আলী, আলী আহম্মদ ও তাঁর এলাকার বড় ভাই মহসিনসহ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের নাটারকান্দিতে যাওয়ার নির্দেশ আসে। যাওয়ার পথে পাকিস্তানিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা পাশের কাশবনে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করেন। আবার ছুটে চলেন রৌমারী, তেলচালা অবশেষে মহেন্দ্রগঞ্জ ১১ নং সেক্টর। সেখানে মেজর তাহের ও ক্যাপ্টেন মান্নান তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাঠাতে চাইলে তাঁরা না গিয়ে পেট্রোলিং ডিউটি বেঁছে নেয়। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত আর্মি-পুলিশ খুঁজে খুঁজে একত্রিত হতে থাকেন। এভাবে ৩৫ জন মিলে কোম্পানী গঠন করা হয়।

এদিকে হাফিজুরের বাড়িতে চলতে থাকে সন্তানের জন্য কাঁন্নাকাটি। সবাই ভেবেছিল তিনি হয়তো আর বেঁচে নেই। কিংবা হানাদার বাহিনী মেরেই ফেলেছে। মা সৃষ্টিকর্তার নিকট মানত করেন। যদি তার প্রিয় ছেলেকে ফিরে পান তবে এলাকার দুস্থ, অসহায়দের খাওয়াবেন।

কমান্ডারের নির্দেশে ৩৫ জনের কোম্পানি নিয়ে সবুজের চর রক্ষায় রওনা দেন। একদিকে হানাদার, অন্যদিকে এলাকাবাসীর ভয়-ভীতি আর অসহযোগীতা। কেননা এখানে ২/৩ বার বাড়ি ঘর পুড়িয়ে ফেলেছে এবং অত্যাচার করেছে। এজন্য এলাকাবাসী তাদের সমর্থনে ছিল না। সুবেদার জলিল, আলী আহমদসহ কয়েকজন যোদ্ধা মিলে গ্রামের সবাইকে ডাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাদেরকে দা, কুঠার, কোদাল ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে পেরে একদিন পাকিস্তানিরা তিনটি লঞ্চ নিয়ে নদীপথে তাদের দিকে আসতে দেখে। খুব ভাল কোন অস্ত্র তাদের ছিল না। তবুও তারা শক্ত অবস্থান নেন। পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যান। উদ্দেশ্য মাফিক গুলি বর্ষণ। প্রচুর গোলাবর্ষণে একটি লঞ্চ নদীতে ডুবে যায় এবং বাকি দুইটি ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এ ঘটনায় মুক্তি বাহিনীরা এলাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেন। তাদের সাহসীকতা দেখে খুশি হয়ে সবাই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। গ্রাম থেকে চাল তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে কথা শুনে নাটারকান্দির চরের শেখ সাদি নামে এক পরহেজগার মুরুব্বি বলেন, “তোমরা আমার সোনার ছেলে, আমার বাড়িতে থাকো। এরপর টানা ১৮ দিন ঐ বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিলেন। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা হাফিুজর রহামানের বড় ছেলে আবু নাসার উদ্দিন তাঁর পিতার মুখে স্মুতি কথাগুলো একাধিকবার শুনেছেন।

বড় কন্যা শাহানাজ পারভীন জানান তাঁর পিতা যুদ্ধের একসময় কর্মকর্তাদের আদেশে মুক্তাগাছায় চলে আসেন। সেখানে তাকে জঙ্গল পেরিয়ে, ক্রলিং করে এগোতে হয়েছে বেশ কিছু পথ। দলহারা হয়ে লুকিয়ে পড়েছিলেন কবরের গর্তে। গাছের পাতা দিয়ে আবৃত করে ঘাপটি মেরেছিলেন কবরে। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তাকে সেদিন বাঁচিয়েছেন।

হাফিুজরের বোন ফিরোজার মুখে শোনা যায়, স্বাধীনের পর বাড়ি ফেরার খবর পেয়ে আশে পাশের এলাকাবাসী সবাই তাকে দেখতে আসেন। মায়ের মানত মোতাবেক পরেরদিন বাড়ির পালের সবচেয়ে বড় গরু জবাই করে মিলাদ-তবারকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে দীর্ঘদিন কর্মরত থেকে ১৯৯০ সালের ১৯ শে সেপ্টেম্বরে অবসর গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক সংবিধান পদক, জয় পদক, রণতারকা পদক, মুক্তিতারকা পদক, সমর পদক ও জ্যেষ্ঠতা পদক অর্জন করেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার মুক্তিবার্তা লালবই নং-৩০৬০৪০২৫৯, বেসামরিক গেজেট নং- ৬৬৭ এবং সেনা গেজেট নং-১৫১০২।

এ বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট (অবঃ) হাফিজুর রহমান জীবনযাপনে ছিলেন অতিসাধারণ। মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। অর্জন করেছেন ভালবাসা আন্তরিকতা। গ্রামকে ভালোবেসে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি নিজ বাড়িতেই থেকেছেন।

চলতি বছরের গত ২৩ আগষ্ট করোনার টীকা নেওয়ার জন্য হাফিজুর রহমান বাড়ি থেকে পরিবারসহ সারিয়াকান্দির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একজন বীর সৈনিকের দৈহিক মৃত্যু হয়। তার সহযোদ্ধারা জানান মুক্তির সংগ্রামের একজন যোদ্ধা হিসেবে তিনি ইতিহাসে রয়ে যাবেন চিরকাল।

মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা স্মরণীয় করে রাখতে সারিয়াকান্দি উপজেলার ঠাটি হইতে ছাইহাটার রাস্তা রক্তে রঞ্জিত সড়কটি প্রয়াত হাফিজুর রহমানের নামে নামকরণ করার দাবি করেছেন এলাকাবাসী এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধরা। যাতে নতুন প্রজন্ম তার অবদান সম্পর্কে অবগত হতে পারে।

(এসএম/এসপি/ডিসেম্বর ২৯, ২০২১)