ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » পাশে দাঁড়াই » বিস্তারিত

১৩ বছর বয়স থেকে ১২ বছর জেল খাটা সেই নজরুল এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে!

২০২১ ডিসেম্বর ৩০ ১৭:৫৩:৩২
১৩ বছর বয়স থেকে ১২ বছর জেল খাটা সেই নজরুল এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে!

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ১৩ বছর বয়স থেকে পায়ে সাড়ে সাত কেজি ওজনের ডান্ডাবেড়ি পরা শিশু নজরুল টানা ১২ বছর ১৮ দিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছিলেন। ১২টি মামলা ঘাড়ে নিয়ে এই যন্ত্রনার সমাপ্তি হয় যখন, তখন তার বয়স ২৫ বছর। জীবনের নানা ধাপ পেরিয়ে সেই নজরুল এখন জটিল রোগে শয্যাশায়ী। তার আকুতি আমি এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছি। আমাকে রক্ষা করুন।

নজরুল ইসলাম বেসরকারি এবি ব্যাংকের একজন পিওন। এখনও কর্মরত সাতক্ষীরা শাখা অফিসে। শারীরিক কারণে তিনি আর অফিস করতে পারছেন না। এখন লড়াই করছেন মৃত্যুর সাথে।

১৯৮০ সালের কথা। শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের ট্যাংরাখালি গ্রামের আরশাদ আলী গাজীর ছেলে নজরুল ইসলাম। ১৩ বছর বয়সে দারিদ্রের কষাঘাতে কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হতে হয় তাকে। এরপর খুলনার খালিশপুর থানার কাশিপুর এলাকার আহমদ আলীর বাড়িতে আশ্রয় হয় নজরুলের। পেটেভাতে কাজকর্ম করে তার দিন চলছিল কোনমতে। নজরুল তার দরিদ্র বাবা মায়ের প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করতে না পারার যন্ত্রনায় শরনাপন্ন হন খুলনার কয়রা উপজেলার বেতকাশি গ্রামের আব্দুল মোতালেবের। মোতালেব তাকে একটি রিকশা কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই রিকশা তার বাড়িতে আনতে গেলে মোতালেবের বাড়িতে যেয়ে তিনি জানতে পারেন আগের রাতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। অত্যন্ত হতাশ হয়ে নজরুল ওই বাড়ি থেকে ফিরতেই রাস্তায় পুলিশের মুখোমুখি হয়। পুলিশ তাকে জেরা করে, কেন তুই এই বাড়িতে এসেছিস। মোতালেব তো পাক্কা চোর। তুইও চোর নিশ্চয়ই।

এমনটি বলেই তাকে আটক করে পুলিশ। নজরুলের কোন আকুতি মিনতি সেদিন শোনেনি পুলিশ। এরপর তার ওপর অস্বাভাবিক নির্যাতন চালানো হয়। তার হাতে আঙুল, হাঁটুর মালা এমনকি পায়ের হাড়, হাতের কনুইতে নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন ফুটে ওঠে। এমন অবস্থায় তার ঘাড়ে ওঠে গ্যাং কেসের ১২টি ডাকাতি মামলা। ১৩ বছর বয়স থেকেই এই ১২টি মামলায় নজরুল ইসলাম খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, বরিশাল সহ বিভিন্ন স্থানের কারাগারের সেলে আটক ছিলেন। এরই মধ্যে একটি ডাকাতি মামলায় তার ৭ বছর কারাদন্ড হয়। নজরুলের এই সব মামলাই ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। এ ব্যাপারে তার এক নিকট আত্মীয়কে দোষী করে বলেন, তিনিই প্রভাব খাটিয়ে তাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করিয়েছে।

জেল জীবনের এক পর্যায়ে ১৯৯২ সালে বিষয়টি নজরে আসে সংবাদকর্মীদের। দৈনিক ইত্তেফাকের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি প্রয়াত এ্যাডভোকেট হাসান আওরঙ্গী ‘বিনা অপরাধে ১৩ বছরের নজরুল ইসলাম ১২ মামলায় জেল খাটছেন’ শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চে একজন আইনজীবী সুয়োমটো চান। হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ মোজম্মেল হক ও বিচারপতি মাহফুজুর রহমান. সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার সহ বেশ কয়েকজনের কাছে তাকে আটকাদেশের কারন দর্শানো এবং একইসঙ্গে কেন তাকে মুক্তি দেওয়া হবে না তার জবাব চান। এর পরই নজরুল ইসলাম জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন ১৯৯২ সালের ১৫ ডিসেম্বর। ১৯৮০ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে মুক্তির দিন পর্যন্ত টানা ৪৩৮০ দিন অর্থাৎ ১২ বছর ১৮ দিন জেল খেটে ক্লান্ত হয়ে নজরুল ফিরে আসেন। আদালত সরকারকে তার ক্ষতিপূরন দেওয়া এবং একইসঙ্গে তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও তা প্রতিপালিত হয়নি। এসময় তার পাশে এসে দাঁড়ায় আরব বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারা তাকে পিওনের চাকরিতে নিয়োগ করে। সেই নজরুল এখন শয্যাশায়ী। তার শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ পুরোপুরি চেতনাহীন হয়ে গেছে। একইসাথে দুই হাত এবং নির্যাতনের স্থানগুলিতে প্রচন্ড প্রদাহের সৃষ্টি হয়েছে।

নজরুলের পরিবারে স্ত্রী মনিরা পারভিন এবং কলেজ পড়ুয়া মেয়ে সহ দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে। কর্মস্থলে না যেতে পারায় এবং ওষুধপত্র কিনতে গিয়ে তিনি এখন অর্থশূন্য হয়ে পড়েছেন। ওষুধপত্র খাওয়ার পাশাপাশি তাকে সকাল বিকাল থেরাপি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মত অর্থনৈতিক সক্ষমতাও নেই। এমন অবস্থায় তিনি কতদিন টিকে থাকতে পারবেন তা বলা কঠিন।

নজরুল প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেছেন, আমার কোন দোষ ছিল না। অথচ আমার ঘাড়ে এত মামলা দিয়ে আমাকে ১২টি বছর জেলে আটকে রেখে জীবনের বেড়ে ওঠার সময় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এবি ব্যাংকের করুনায় আমি টিকে থাকতে পারলেও এখন সে পথও রুদ্ধ হতে চলেছে। আমি কোন ক্ষতিপূরন পাইনি। এমনকি কোন সরকারি সহায়তাও পাইনি। আমি বিনয়ের সাথে আপনার করুনা প্রার্থনা করছি। আমাকে জীবনে রক্ষা করুন।

(আরকে/এসপি/ডিসেম্বর ৩০, ২০২১)