ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত

মুক্তিযোদ্ধার মুখে যুদ্ধ কথা

২০২২ ফেব্রুয়ারি ২০ ১৫:০৩:৪৯
মুক্তিযোদ্ধার মুখে যুদ্ধ কথা

আমি মো. ময়দান আলী। আমি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের চরমোহনপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করি ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল। আমার বাবা জয়নাল আবেদীন একজন কৃষক ছিলেন। মা সার্মত বানু ছিলেন গৃহিনী। দুই ভাই-দুই বোনের মধ্যে আমি বড়। আমি মোহনপুর হাইস্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম ১৯৭১ সালে। পড়াশোনার সময়ই আমি যুদ্ধে যোগ দেই।

আমাদের দেশের মধ্যে পাকিস্তানি মিলিটারি বিভিন্নভাবে প্রবেশ করতে থাকে। আমাদের মোহনপুরও মিলিটারি আসতো। কারণ হলো আমাদের মোহনপুরে ট্রেনের যোগাযোগটা ভালো ছিল। পাক আর্মি মোহনপুর ইস্টিশনে নেমে মোহনপুরের আশেপাশের মানুষদের বিভিন্নভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন করতো। হিন্দুদের ওপর বিশেষ করে বেশি অত্যাচার চালাতো। মুসলিমদেরও বাদ দিত না যারা জয় বাংলা বলতো। বাড়ি-ঘরও পুড়িয়ে দিত।

গ্রাম থেকে নারীদের ধরে নিয়ে এসে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন চালাতো। একদিন যে নারীকে নির্যাতন করতো, অন্যদিন তাকে করতো না, নতুন এক নারীকে আবার নির্যাতন করতো। এভাবে মিলিটারিরা নির্যাতন করতেই থাকে মা বোনদের উপরে। মা-বোনদের ওপর নির্যাতন ও সাধারণ মানুষদের উপরেও নির্মম অত্যাচার দেখে আমরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি যে, আমাদের যুদ্ধ করা ছাড়া কোন উপায় নাই। এদিকে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় জন্য প্রস্তুত থাকো।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা আরো উদ্বুদ্ধ হই। আমরা যুদ্ধতে যোগ দিতে চলে যাই সিরাজঞ্জের ব্রক্ষগাছাতে। সেখানে গিয়ে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরে যোগ দেই। যুদ্ধতে যারা যোগ দেই তারা সবাই প্রায়ই ছাত্র ছিলাম। ছাত্ররাতো অস্ত্র চালাতে জানতো না। কিন্তু এই দিকে মিলিটারিরা পাবনা দখল করে সিরাজঞ্জের দিকে গাড়ি নিয়ে আক্রমণ করতে আসতে থাকে। এতে সিরাজগঞ্জ মহকুমার জেলা প্রশাসক এই অবস্থা দেখে অস্ত্রগার খুলে দেয় এবং সিরাজগঞ্জের কলেজের ছাত্রদের যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানান।

অস্ত্রগার থেকে মহিষের গাড়ির মাধ্যমে অস্ত্রগুলো সোজা নিয়ে আসা হয় কালিয়াহরিপুরের একটি বাগানে। আমাদের অস্ত্র সরবরাহ হয়ে যায়। একটি গ্রুপের মাধ্যমে দরকার এখন ট্রেনিং। তারপর পলাশডাঙ্গা যুব শিবির নামে একটি গ্রুপ করার হয়। এই গ্রুপের পরিচালক ছিলেন আব্দুল লতিফ মির্জা আর কমান্ডার ছিলেন আব্দুল সালাম। আমরা ধীরে ধীরে ট্রেনিং নিতে থাকি। ট্রেনিং শেষ করে একটা সময় আমরা পাকা শিকারি হয়ে যাই।

প্রশিক্ষণ শেষ করে আমরা চলনবিল এলাকায় অবস্থান করি। সেই সময় আমাদের ১১টা নৌকা ছিল। আমরা ধীরে ধীরে ছোট ছোট অপারেশন চালাতে থাকি আর আমরা অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকি। আমাদের এইভাবে গ্রুপটা বড় হতে থাকে। আমরা প্লাটিনা থেকে কোম্পানি, কোম্পানি থেকে ব্যাটালিয়ান কোম্পানি হয়ে যাই। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোরে আব্দুল লতিফ মির্জার পরিচালনায় পলাশডাঙ্গা যুব শিবির বিশাল একটি গ্রুপ হয়ে যায়। আমরা প্রতাপ থেকে চলনবিলের মাঝে যাবো, এতে আমরা নৌকায় রওনা হই সেখানে যাবার জন্য। আমাদের একটাই পথ ছিল নওগাঁ দিয়ে যাওয়ার, তা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। কারণ হল আমাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফিলছে মিলিটারিরা।

চলনবিলে যেতেই নৌকা ভিড়াই আমরা নওগাঁর হাটখোলায়। সেদিন ছিল ১০ নভেম্বর। আমরা জানতাম না যে, নওগাঁতে মিলিটারি আছে। আমাদের বড় একটি যুদ্ধ হয় মাজার নওগাঁতে। আমাদের গ্রুপে একটা ইমাম ছিল আমাদের কেউ মারা গেলে তাঁকে জানাযা করানোর জন্য। ইমাম সাহেব ফজরের নামায পড়ার জন্য নওগাঁ মাজার মসজিদে যান আযানের বেশ কিছু সময় আগেই। মাজারের ভেতরে প্রবেশ করতেই মিলিটারিরা হলফ করে।

মিলিটারিরা বলে, ‘বল তুই কে হে?’ ইমাম বলেন, ‘আমি ইমাম হে।’ ইমামের উপস্থিত বুদ্ধিও ছিল বটে। ইমাম বলেন, ‘এই মসজিদে আমি আযান দেই। আমি আযান দিবো, তাই চলে আইছি আযানের আগেই। আরো আগে আসি আমি মসজিদে।’ ‘ঠিক হে, ঠিক হে, ইমাম সাহেব।’ ইমাম চলে যান মসজিদে। ইমাম সাহেব চিন্তা করেন যে, ‘আল্লাহ, এখান থেকে বের হই কি করে। না বেরিয়ে তো উপায় নেই। না বের হলে আমাদের লোকজন জানবে না তো মিলিটারি আমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলছে। সকালবেলা গিয়ে ফায়ার করে আমাদের শেষ করে ফেলবে।’

তখন ইমাম চিন্তা করে বুদ্ধি বের করেন, বদনা নিয়ে বের হয়ে বাইরে চলে আসতে থাকে। সেই সময় মিলিটারিরা বলেন, হে ইমাম, তুই একবার যাতে গা, আবার আসতে হে, তোর মতলফ কী হে?’ তিনি বলেন, ‘না, হুজুর পায়খানা-প্রস্রাব করবো। মাজার শরীফে পায়খানা- প্রস্রাব করতে নেই্। তাই বাইরে গিয়ে পায়খানা প্রস্রাব করবো।’ তারপরে মিলিটারিরা বলে, ‘ঠিক হে, তারাতারি যা।’ ওখান থেকে বের হয়েই দৌড় দিয়ে এসে চিৎকার দিয়ে উঠে ইমাম। তখনও আযান দেয়নি, হয়তো তিন চার মিনিট বাকি আছে। সেই সময় আমরা সবাই জানতে পারলাম যে, চতুর্দিক থেকেই আমাদের ঘিরে ফেলছে মিলিটারি। এখন আমাদের যুদ্ধ ছাড়া কোন উপায় নাই। তাই যুদ্ধ আমাদের এখানেই করতে হবে। জানার সাথে সাথে আমরা গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে কোদাল নিয়ে বাংকার করে ফেলি। ১১ নভেম্বর ফজরের আযানের পরে যুদ্ধ শুরু হয় ।

মিলিটারিরাই প্রথম ফায়ার করে। তারপর আমরা গুলি করতে থাকি। কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে ফায়ার করতে থাকি। কারণ আমাদের গুলির সংখ্যা কম ছিল, যা ছিল তাই নিয়ে আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। তা আমাদের আগেই বলা হয়েছে। সকাল ১০টার পরে আমরা তুমুল আকারে ফায়ার করবো। যাতে করে এর মধ্যে পাকিস্তানি মিলিটারিদের গুলির সংখ্যা কমে যায়। মিলিটারিদের গুলি কমে যাওয়ার পরে আমাদের শুরু হবে ফায়ার।

মাঝে মাঝে গ্রেনেড চার্চ করি যাতে করে মিলিটারিরা এগিয়ে আসতে না পারে। সকাল ১০টা বাজার সাথে সাথে অর্ডার এসে যায়। ব্যাটলিয়ান কমান্ডার অরুন বাবু বাঁশি দেয়ার সাথে সাথে আমাদের এসেলার গ্রুপের সাইট থেকে ফায়ার শুরু হয়ে যায়, সবাই তুমুল আকারে যুদ্ধ করতে থাকি। দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। ১২টা কি ১টার সময় আমরা জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে উঠি। আর চারদিক থেকে আমরা মিলিটারিদেরকে ধরতে থাকি আর মারতে থাকি। এদিকে গ্রামের লোকজনও এগিয়ে আসে জয় বাংলা বলার পরেই। মিলিটারি পালাতে থাকলে গ্রামের লোকজনও দৌড়ায়ে গিয়ে ধরতে থাকে আর মারতে থাকে। গ্রামের লোকজন প্রায় ৭-৮ জন মিলিটারিকে মেরে ফেলে। এই যুদ্ধে অনেক মিলিটারি মারা যায়। আমাদের কেউ মারা যায় না আল্লাহ রহমতে। কিন্তু হাতে-পায়ে গুলিবদ্ধ হয়ে আহত হন অনেকেই। আমরা দু’জন মিলিটারি অফিসারকে জীবিত ধরি। কিন্তু তাদেরকে ধরে আমরা আরেক ঝামেলায় পড়ি।

আমাদের জেলহাজত নাই, ওদের রাখবো কোথায়। পরে নৌকার ডয়রায় রাখি। কিন্তু ওদের নিয়ে খুব ভয় লাগে। ওরা অফিসার মানুষ সব কিছু জানে। বিশাল বিশাল লম্বা মানুষ, তাদের নিয়ে কি আর শুয়ে থাকা যায়। পরে উপর মহলে জানানো হলো। আমরা জীবত দু’জন মিলিটারি অফিসারকেকে ধরেছি। এদের কী করবো, পরে আমাদের কাছেই রাখতে বলা হয়। কিন্তু কেউই রাখতে চায় না। সবাই বলে রাখার উপায় নেই।

এই রকম চলতে থাকে। পরে উপর মহলকে বললাম, এদেরকে রেখে আমরা কী করবো। আমাদের অর্ডার দেন না কেন, মেরে ফেলি। পরে আমাদের অর্ডার দেওয়া হয় মারার জন্য। আমরা শীতলাই রাজবাড়ী নিয়ে গিয়ে কানের কাছে রাইফেল ঠ্যাকায়ে গুলি করে মেরে ফেলি।

নওগাঁতে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারি ওয়ার্লেসের মাধ্যমে উপর মহল পাক আর্মিদের সাথে যোগাযোগ করে ছিল। তারা বলেন, আমাদের মুক্তিবাহিনী ঘিরে ফেলছে নওগাঁতে তারাতারি সৈন্য দরকার। কিছু সৈন্য ঠিক বিমানের মাধ্যমে তারাতারি চলে আসে। তা মাজার নওগাঁতে না এসে জেলা নওগাঁতে চলে যায়। ওদের ভুলের জন্য আমাদের যুদ্ধটা সহজ হয়েছিল। এদিকে নওগাঁর যুদ্ধের সময় আমাদের পলাশডাঙ্গা যুব শিবির গ্রুপের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। আমাদের চারদিকে মিলিটারিরা ঘিরেও ফেলছে। কী করা যায়! পরে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে লতিফ মির্জা আমাদের কিছুদিন আড়াল হয়ে থাকতে বলেন।

তিনি আরো বলেন, গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারলে আমরা সবাই আবার দলবদ্ধ হবো। তারপর আমরা কিছু দিনের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। লতিফ মির্জার সাথে অনেকে ভারতে চলে যায়। আর কিছু থেকে যায়। এরপরে আমরা কয়েকজন মিলে আরেকটি গ্রুপ করে ফেলি। আমাদের গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন আব্দুল হামিদ (বড়)। আমরা উধুনিয়া গিয়ে ক্যাম্প করি। ক্যাম্পে আমরা দিনে থাকি কিন্তু রাতে থাকি না । কারণ যেকোন সময় মিলিটারিরা আমাদের হামলা করতে পারে।

আমরা ছোট ছোট অপারেশন চালিয়ে যেতে থাকি। দহকুলা ব্রিজ, দিলপয়সা ব্রিজ, কৈডাঙ্গা ব্রিজ এই রকম বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করে বিভিন্ন জায়গা দখল করতে থাকি। আমরা মোহনপুর দখল করি। তারপর উল্লাপাড়া, সর্বশেষ সিরাজগঞ্জও আমরা দখল করে ফেলি। এইভাবেই আমাদের দেশ শত্রু মুক্ত হতে থাকে। আমি যুদ্ধের সময় থ্রিনটথ্রি অস্ত্র ব্যবহার করি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠে প্রবাসী সরকারের অর্থমস্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. এ. মনসুর আলীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করি।

উল্লেখ্য, যুদ্ধ শেষে ময়দান আলী ফিরে যান স্কুলে। ১৯৭২ সালে এসএসসি পাস করেন। তারপর শেফালী খাতুনকে বিয়ে করেন। পুত্র : সোহেল রানা, রুবেল হোসেন ও কন্যা : মুর্শিদা খাতুন ও খুশি পারভীন। তাঁর বর্তমান পেশা ব্যবসা। বর্তমান ঠিকানা চরমোহনপুর, উপজেলা : উল্লাপাড়া, জেলা : সিরাজগঞ্জ।

অনুলিখন : ইমরান হোসাইন।