ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » অগ্নিকন্যা » বিস্তারিত

অসহায় নারীদের ডাক্তার দিলরুবা ফেরদৌস

২০২২ মার্চ ০৯ ১৮:০৫:০৩
অসহায় নারীদের ডাক্তার দিলরুবা ফেরদৌস

ওহিদুজ্জামান কাজল, মাদারীপুর : হাতে ট্যাকা (টাকা) নাই। কি করমু। প্যাট (পেট) ব্যাথায় বাঁচি না। ম্যালা (অনেক) কষ্ট হয়। দোকান (ফার্মেসী) থাইক্যা ওষুধ আনছি। তা খাইয়্যা কোন লাভ হয় নাই। ব্যাথা কমে নাই। তহন একজন আমারে কইলো, চৌধুরী কিনিক (ক্লিনিক) যাইতে। হেইখানে (সেখানে) একজন ডাক্তার আছেন। ট্যাকা না থাকলেও দেইখবো (দেখবো)। হেই কথা শুইননা (শুনে) ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি অনেক ভালা ডাক্তার। কোন ট্যাকা তো নেন নাই। উল্টা আমারে দিছে। কইছে ওষুধ কিনতে আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে। পাহের (পা) স্যান্ডেল ছিইড়া ছিলো তাই কিনতে কইছে। এমন ডাক্তার আর কই পামু কন। আল্লাহর কাছে দোয়া কইরি তিনি যেন ভালা থাকেন।’ এভাবেই কথাগুলো বললেন মাদারীপুর সদর উপজেলার হাজির হাওলা গ্রামের ৭০ বছরের বেগম নামের একজন নারী।

আরেক নারী স্থানীয় একটি পত্রিকা অফিসের স্টাফ ডালিয়া আক্তার বলেন, জরায়ুতে টিউমার ধরা পরে। মাদারীপুরের একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলি, তখন সেই ডাক্তার পুরো পেট না কেটে ছিদ্র করে টিউমার বের করার জন্য ৮০ হাজার টাকা চান। কিন্তু আমার কাছে এত টাকা নেই। তখন কি আর করবো। অপরেশন না করে ব্যাথা নিয়ে কষ্ট করতে থাকি। এভাবে প্রায় এক বছর কষ্ট হয়। তখন একজনের পরামর্শে ডাক্তার দিলরুবা ফেরদৌসের কাছে যাই। তিনি আমার সব কথা শুনে শুধু অবশ করার জন্য আসা ডাক্তার ফি ও ওটি খরচ নামমাত্র নিয়ে অপারেশন করান। তিনি এভাবে সহযোগিতা না করলে আমি হয়তো অপারেশন করাতেই পারতাম না।

মাদারীপুরে গরীব অসহায়দের বন্ধুখ্যাত ডা. দিলরুবা ফেরদৌসের রোগীদের জন্য এমন ভালোবাসার গল্প রয়েছে অসংখ্য। তিনি দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে মানুষের সেবা দিয়ে আসছেন। বিশেষ করে নারীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও গরীব অসহায়দের আর্থিক সহযোগিতা করে আত্মতৃপ্তি পান প্রচারবিমুখ মাদারীপুরের নারীদের প্রিয় চিকিৎসক দিলরুবা ফেরদৌস।

মাদারীপুর শহরসহ প্রত্যান্ত গ্রামগুলো থেকে চিকিৎসা নিতে আসা নারীরা চিকিৎসক দিলরুবা ফেরদৌসের ব্যবহার ও আন্তরিকতার জন্যও বার বার ছুটে আসেন শহরের শকুনী লেকপাড়ে অবস্থিত একটি বেসরকারী ক্লিনিকে (চৌধুরী ক্লিনিক)।

অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে হাসিমুখে রোগীদের সাথে দীর্ঘ সময় নিয়ে শোনেন তাদের সমস্যার কথা। গরীব রোগীদের বিনামূল্যে দেন চিকিৎসাপত্র। গরীব রোগীদের ওষুধ কেনার জন্য আর্থিক সহযোগিতা দেয়া তার নিয়মে পরিণত হয়েছে। শুধু ওষুধ নয় বিভিন্ন সময় দুঃস্থ মানুষদের নানা ধরণের সহযোগিতা করে থাকেন এই নারী চিকিৎসক। তবে চেয়ে কখনও ফি নিতে দেখা যায়নি। সমর্থ্য অনুযায়ী যে যা দিয়েছে, তাতেই খুশি। এছাড়াও দীর্ঘ ১০ বছর বিনামুল্যের পাশাপাশি সমর্থবানদের কাছ থেকে মাত্র ৫০ টাকা করে ফি নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন।

কথা হয় সেই চিকিৎসক দিলরুবা ফেরদৗসের সাথে। তিনি বলেন, আমার স্বামী মরহুম ডা. এসএম আলীমুর রেজার কাছ থেকেই মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি। তিনি বলতেন একজন চিকিৎসকের উচিত গরীব দুখী মানুষের পাশে থাকা। বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া। তার সেই কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজও গরীব দুখীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া, ওষুধ দেয়ার পাশাপাশি নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতা করে আসছি এবং সারা জীবন এই কাজগুলো করে যাবো। তাই দীর্ঘমেয়াদী আর ধারাবাহিকভাবে এই কাজগুলো করার জন্য আমার স্বামীর নামে একটি সংস্থা খুলতে চাই। সেই সংস্থা হবে গরীব দুখীর আশ্রয়স্থল।

ক্লিনিক, নার্স, রোগী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুর পার্বতীপুরের ইংরেজী শিক্ষক মৃত কফিল উদ্দিন আহম্মেদের মেয়ে ডা. দিলরুবা ফেরদৌস। পাচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। শশুরবাড়ি যশোর শহরে। স্বামীও ছিলেন একজন চিকিৎসক। ২০১৪ সালে স্বামী ডা. এসএম আলীমুর রেজা ব্রেনস্টোক করে মারা যান। এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সপ্তাহের দুদিনই থাকে মাদারীপুর শহরের শকুনী এলাকায় ও ৫ দিন থাকেন ঢাকার গ্রীন রোড এলাকায়।

এমবিবিএস, এমসিপিএস, ডিজিও, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমএস কোর্সের (অবস্ এন্ড গাইনী) থিসিস শেষ করে জরায়ুর ক্যান্সার রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. দিলরুবা ফেরদৌস।

১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মাদারীপুরের মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনের এক সাথে কাজ করেছেন। তাদের দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ঐ সময় মাদারীপুর জেলা ছাড়াও আশে-পাশের জেলাগুলো থেকে রোগী আসতেন। ২০০৫ সালে মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র ঢাকার আয়োজনে সারা বাংলাদেশের মধ্য থেকে জাতীয় পর্যায় শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে পুরস্কার পান মাদারীপুরের এই চিকিৎসক দিলরুবা ফেরদৌস। এছাড়াও ২০০৬ সালে ওজিএসবি-এর গাইনি অব সোসাইটিতে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে সম্মননা পান।

ডা. দিলরুবা ফেরদৌস বলেন, আমার বাড়ি মাদারীপুর না হলেও এই জেলার মানুষদের প্রতি আমার অনেক মায়া, অনেক ভালোবাসা। সেই ৯৯ সাল থেকে ৭ বছর আমি ও আমার স্বামী মিলে একসাথে কাজ করার সুবাদে ভালোবাসা জন্ম হয়। সেই ভালোবাসার টানে প্রায় দুই যুগ ধরে মাদারীপুরে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। বর্তমানে নিজের কাজ ও পড়াশুনাসহ ছেলে মেয়েদের জন্য ঢাকা থাকলেও প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার মাদারীপুরে আসি। এই দুদিন রোগীদের সেবা দিয়ে থাকি। অনেক সময় ভাবি মাদারীপুরে আর যাবো না। কিন্তু অসহায় গরীব রোগীদের দীর্ঘ লাইনের মুখগুলো আমাকে বার বার এখানে টেনে আনে। তাদের ভালবাসার জন্যই আমি এখানে আসি। আজীবন এখানে এসে নারীদের সেবা দিতে চাই।

এ ব্যাপারে মাদারীপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমীর নাট্য বিভাগের শিক্ষক আ.জ.ম কামাল বলেন, আমি দীর্ঘ বছর ধরেই ডা দিলরুবাকে দেখে আসছি। খুবই সাদাসিধে হাসি খুশি একজন মানুষ। অনেক ডাক্তারদের দেখেছি টাকা জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেন। রোগীদের সাথে বাজে ব্যবহার করেন। কিন্তু ডা. দিলরুবাকে কখনও রাগ করতে দেখেনি। কোন রোগীর কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিতে দেখেনি। বরং গরীব অসহায়দের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, ওষুধ দেয়া এমনকি বিনা খরচে মেয়েলী সমস্যায় অপারেশন করতে দেখেছি।

এ ব্যাপারে মাদারীপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি শাহজাহান খান বলেন, আমি নিজেও তার কাছে অনেক গরীব রোগী নিয়ে গেছি। কিন্তু তিনি কোন ফি নেননি। বরং যতটুকু পেয়েছেন উল্টো সহযোগিতা করেছেন।

ডাক্তার দিলরুবা ফেরদৌসের একজন সহযোগী বলেন, সপ্তাহে দুদিন তিনি মাদারীপুরে থাকেন। এই দুদিন একটানা অনেকটাই না ঘুমিয়ে, খাওয়ারও কোন ঠিক নেই শুধু রোগী দেখা, অপারেশনসহ নানা ধরণের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। গরীবদের কাছ থেকে টাকা নেন না। গরীবরা ছাড়া অন্য রোগীরা যা ফি দেন, তাতেই তিনি হাসি মুখে নিয়ে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায় গ্রাম থেকে অনেক রোগী কিংবা রোগীর কোন আত্মীয়-স্বজনের কষ্টের কথা শুনে তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন। অনেকেই আছে মিথ্যা কথা বলেও নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। কেউ এসে কাদলেই কিংবা কেদে কেদে সহযোগিতা চাইলেই তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। আসলে ডাক্তার ম্যাডাম অনেক ভালো, তাই সবাইকে সহজে বিশ্বাস করেন। আর তিনি এইসব সহযোগিতার কথা কাউকে বলতেও চাননা।

ক্লিনিকে আসা সদর উপজেলার খোয়াজপুর গ্রামের ফজিলাতুন নেছা, লক্ষ্মীপুর গ্রামের আয়শা বেগম, বকুলতলা গ্রামের আনোয়ারা বেগম, ঘটকচর গ্রামের শিউলি বেগমসহ একাধিক রোগী বলেন, আমরা আমাদের নানা সমস্যা নিয়ে, বিশেষ করে মেয়েলি সমস্যা, বাচ্চা হওয়া, জরারু এর সমস্যা কিংবা অপারেশনসহ নানা বিষয় নিয়ে এই ডাক্তার দিলরুবা আপার কাছেই আসি। সে কোন দিন চেয়ে টাকা নেয়নি। বলেছি আজ টাকা নেই, তাও সে আমাদের চিকিৎসা দিয়েছে। অনেক সময় রোগীদের যাতায়াতের ভাড়ার টাকাও দিতে দেখেছি।

মাদারীপুর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বাহাদুরপুর গ্রামের হেলেনা বেগম বলেন, আমার ১৮ বছর বয়সের ছেলে মাসুদ বেপারী শারীরিক প্রতিবন্ধী। সে হাটতে পারেনা। তাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা নেয়া খুব কষ্টকর ছিলো। অনেকের কাছে গিয়েছি। কেউ একটা হুইল চেয়ার দেয়নি। কিন্তু ডাক্তার দিলরুবা আপা আমার এই অসহায়ত্বের কথা শোনামাত্রই আমার ছেলেকে একটি হুইল চেয়ার ও নগদ টাকা দিয়েছিলেন। এখনও তিনি আমাদের খোজ খবর নেন। বর্তমান সমাজে এমন ডাক্তার খুজে পাওয়া যায়না। তিনি গরীবের বন্ধু। গরীবের ডাক্তার আপা।

শুধু মাসুদ নন, এমন উদাহরণ আছে অনেক। সবার আড়ালে, কোন বাহবা আশা না করে তিনি শুধু অসহায় মানুষের পাশে থাকতে চান। এমন কথা বললেন উন্নয়ন সংস্থা নকশি কাথার সদস্য ফারজানা আক্তার মুন্নি।

মাদারীপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মাহমুদা আক্তার কণা বলেন, আমার দেখা তিনি একজন সৎ, ভালো ও গরীবের ডাক্তার দিলরুবা ফেরদৌস। তিনি প্রায় সময় গরীবদের বিনামুল্যে দেখেন। আমি অনেক গরীব রোগী পাঠিয়েছি। তিনি টাকা ফি ছাড়াই দেখেছেন। তাকে দেখে অন্য চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ হয়ে এভাবে চিকিৎসা সেবা ও মানবসেবা করা উচিত।

(ওকে/এএস/মার্চ ০৯, ২০২২)