ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত

দুঃসাহসী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকটি ভয়াবহ যুদ্ধের কথা

২০২২ মার্চ ৩০ ১৫:২৭:৫৬
দুঃসাহসী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকটি ভয়াবহ যুদ্ধের কথা

চন্দনা সান্যাল


“আমাদের বাংলাদেশের জন্মের আগে এই ভূখ-ের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয় পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের দুটি অংশ ছিল। আমাদের অংশের নাম পূর্ব পাকিস্তান আর আমাদের ভূখ- থেকে হাজার মাইলের অধিক দূরে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি বিহারি মুসলমানরা এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তারা বিভিন্নভাবে আমাদেরকে বঞ্চিত করত। ১৯৫২-এ তারা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে গিয়ে সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেক বাঙালি জীবন দিয়েছে। এরপর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাংলার মানুষ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে। সে বিজয়ী সরকারকে পাক সরকার ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। পরে ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার মাধ্যমে আইয়ুবকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে।

আইয়ুবের পর পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে খুনি জেনারেল ইয়াহিয়া। তিনি ক্ষমতায় এসে বাঙালিদের আন্দোলনের মুখে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ভোটারগণ বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে। সেই সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের ২৮৮টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়। তখন জাতীয় পরিষদের মোট আসন সংখ্যা ছিল মনোনীত সংরক্ষিত ১৩টি মহিলা আসনসহ ৩১৩টি। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল ৭টি মহিলা আসনসহ ১৬৯টি। এই ১৬৯টির মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনের অধিকারী হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি ৪টি মহিলা আসনসহ ৮৮টি আসনের অধিকারী হয়। অন্য সব দল মিলে পায় বাকি ৫৮টি আসন। এই সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলাম ও মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগের বিপক্ষে নির্বাচন করে। এ দেশের মানুষ জানতে পারে, জামায়াতে ইসলাম মাওলানা মওদুদীবাদী ও পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল। সে কারণে জামায়াতে ইসলামীর একজন প্রার্থীও নির্বাচিত হতে পারেনি।

গণতন্ত্রের নিয়মানুসারে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ায় তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দায়িত্ব ছিল সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগকে আহ্বান জানানো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দিতে রাজি ছিল না। এই কুখ্যাত সামরিক শাসক ষড়যন্ত্র শুরু করল। ১৭ জানুয়ারি পাখি শিকারের কথা বলে ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও অন্যান্য জেনারেলদের নিয়ে লারকানায় ভুট্টোর বাসায় একত্রিত হয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করে। তাই ইয়াহিয়া খান টালবাহানা করে সময় কাটাতে লাগল। আর বাঙালিদের হত্যা করে হলেও সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের ষড়যন্ত্র করতে থাকল। ৩ জানুয়ারি, ১৯৭১ রোববার রমনা রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতার ডান পার্শ্বে ১৫১ জন আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্য (এম.এন.এ) এবং বাম পার্শ্বে ২৬৮ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এম.পি.এ)কে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড় করাইয়া নিজে শপথ বাক্য পাঠ করান।

১১ জানুয়ারি ইয়াহিয়া ঢাকায় আগমন করে জাতির পিতার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া মিথ্যা আশ্বাস দিল ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতাকে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত করা হয়। ১ মার্চ সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান দুপুর ১২টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ৩ মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে।

অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা শুনে জাতির পিতা ৩ মার্চকে জাতীয় শোক দিবস পালনের ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধু ঢাকা এবং সারাদেশে ৫ দিনের জন্য হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। তার মুখের একটি কথায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে যায়। অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য পাক হানাদাররা কারফিউ দেয়। ছাত্র-জনতা সেই কারফিউ ভেঙে পথে নেমে আসে। চারদিকে মিছিল-স্লোগান আর বিক্ষোভ। সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। তারপরেও কেউ থেমে রইল না। দলে দলে সবাই পথে নেমে আসে।

১ মার্চ জাতির পিতার অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ২ মার্চ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংসদের আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সব সদস্য শেখ মুজিবকে যে কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্ণ অধিকার দেয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পশ্চিম ফটকে প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ডাকসু নেতা আ.স.ম আব্দুর রব।

৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নির্বাচিত করা হলো। এ সভায় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রের সঙ্গে মিল রেখে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শাহজাদপুরেও খন্ড খন্ড মিছিল হলো। বিকাল ৩টায় রবীন্দ্র কাচারি বাড়িসংলগ্ন ঐতিহাসিক বকুল তলায় এম.পি.এ আব্দুর রহমানের সভাপতিত্বে সভা হয়।

৭ মার্চ তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯ মিনিট বাঙালিকে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করতে ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, ‘... তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, .... আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি .... আমরা পানিতে মারবো। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জাতির পিতা ৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কুর্মিটোলায় অবস্থিত সুসজ্জিত বিমান বাহিনী মুহূর্তেই তাকেসহ লক্ষ লক্ষ জনতাকে বোমার আঘাতে নিশ্চিহ্ন করে দিত। উপস্থিত মানুষের ঢল থেকে বারবার উচ্চারিত হলো জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, “আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব”।

৯ মার্চ ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং সামরিক প্রশাসক করে পাঠাল। এইদিন রবীন্দ্র কাচারি বাড়ির ঐতিহাসিক বকুল তলায় জাতীয় পরিষদ সদস্য, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সৈয়দ হোসেন মনছুরের সভাপতিত্বে সভা হয়। সভায় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব আব্দুর রহমান, মো. হাসিবুর রহমান স্বপন, শাহিদুজ্জামান হেলাল, কোরবান আলী, বাকী মির্জা, আব্দুল গফুর সরবত, বিনোদ বিহারি জেয়াদ্দার, বিনয় কুমার পাল প্রমুখদের নিয়ে বিভিন্ন সাব কমিটি করা হয়।

১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান নিজে ঢাকায় এসে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার কথা বলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, বিনয় কমার পাল প্রহসনমূলক আলোচনা করতে থাকে। এর মাঝে প্রত্যেক দিন বিমানে করে ঢাকায় সৈন্য আনতে থাকে এবং যুদ্ধ জাহাজে করে অস্ত্র চট্টগ্রামের বন্দরে নোঙর করে। ২১ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয়ী পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাদের দেশে এসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগ দিল।

২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। পাকিস্তান দিবসে জাতির জনকের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে “আমার সোনার বাংলা গানের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বিকেল পৌনে ৬টায় আলোচনা শেষ না করেই ভুট্টোকে রেখে বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত পূর্ব পাকিস্তানের নবনিযুক্ত গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানকে বাঙালি নিধনের নির্দেশ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। টিক্কা খান ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে বাঙালি হত্যা শুরু করে।

পাক হানাদাররা নির্বিচারে বাঙালি হত্যা শুরু করে বাঙালি জাতির ওপর মহান মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দিল। জাতির পিতা ইতিহাসের জঘন্যতম বাঙালি নিধন সার্চলাইটের ভয়াবহতা দেখে পাকিস্তানিদের হানাদার আখ্যা দিয়ে রাত ১২.২০ মি. এ বাসায় উপস্থিত সবার সম্মুখে আনুষ্ঠানিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও শেষ বার্তা, ১২টায় বর্বর পাকবাহিনী ঢাকা পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিতে হামলা চালায়। লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহিদ হয়েছে। যুদ্ধ চলছে।

“আমি শেখ মুজিবুর রহমান এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাকামী দেশসমূহের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করছি।” এই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি আপনারা যে যেখানে আছেন এবং আপনাদের যার কাছে যা আছে তাই নিয়েই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যতদিন পর্যন্ত শেষ পাকিস্তানি সৈন্য বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত না হয় এবং যতদিন পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয় না আসে ততদিন আপনারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন” জয় বাংলা।

তিনি প্রথম চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম.এ হান্নানের ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব জহুর আহাম্মেদ চৌধুরীকে টেলিফোনে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বললেন। তারপর নিজে বলে দিয়ে বাসায় উপস্থিত আওয়ামী লীগ কর্মীদের দিয়ে একটি টেলিগ্রাম বার্তা লেখালেন। ই.পি.আর হেডকোয়ার্টার-এর ওয়্যারলেস অপারেটরকে ফোন করে টেলিগ্রাম বার্তা লিখে নিতে বললেন। জাতির পিতার স্বাধীনতার বার্তাটি ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র পাঠানো হলো। পরে জানা গেছে শুধুমাত্র এই টেলিগ্রাম বার্তাটি পাঠাতে গিয়েই ওয়্যারলেস অপারেটর শহিদ হন। ই.পি.আর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমেও স্বাধীনতা ঘোষণার কথা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম জানানো হলো। ২৫ মার্চ রাত ১টায় সিরাজগঞ্জের এস.ডি.ও এ. কে সামস্ উদ্দিন জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা পেয়ে ট্রেজারির সব অস্ত্র এম. এন. এ মোতাহার হোসেন তালুকদার, আব্দুল লতিফ মির্জা ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামীদের হাতে দিয়ে দেন।

২৬ মার্চ সকাল ৮.০০টায় শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চিত্তরঞ্জন বাবু এম.পি.এ আব্দুর রহমানের বাসায় এসে জাতির পিতা কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রামের কপি সবাইকে দেখালেন। এম.পি.এ জনাব মো. আব্দুর রহমান ইংরেজিতে পাওয়া ঐ টেলিগ্রাম বঙ্গানুবাদ করে লিফলেট তৈরি করে শাহজাদপুরের সর্বত্র বিলির ব্যবস্থা করেন। মানুষের মুখে মুখে জাতির পিতার আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার ও ২৬ মার্চের শেষ বার্তার কথা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ পেয়ে ইয়াহিয়া খান করাচি বেতার কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে পাকিস্তানি মেজর জাফরের নেতৃত্বে এক প্লাটুন পাক হানাদার কমান্ডো বাহিনী জাতির পিতার ধানমন্ডিস্থ ৩২ নাম্বারের বাড়ি ঘিরে ফেলে মাইক দিয়ে বারবার জাতির পিতাকে বের হয়ে আসার অনুরোধ করছিল। বের না হলে কামান দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বাড়িঘর উড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকিও দিচ্ছিল। তখনও জাতির পিতার বাড়িতে আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতাকর্মী ছিল। রাত ১.৩০ মিনিটে পাক হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। পাকহানাদাররা জাতির পিতাকে বন্দি করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়।

জাতির পিতাকে যাতে হত্যা করতে না পারে সেজন্য কৌশল হিসেবে ভারতীয় বেতার কেন্দ্র আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হলো জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। ভারতীয় বেতারে প্রচারিত সংবাদের পাল্টা সংবাদ হিসেবে রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচার করা হলো শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয় নাই বন্দি করা হয়েছে এবং নিরাপদ অবস্থায় পাকিস্তানি আর্মিদের নিরাপদ হেফাজতে আছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণাটি চাচ্ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতাকারী ভারত সরকার। পাকিস্তানি আর্মিদের নিরাপদ হেফাজতে আছে ঘোষণার পর আর পাকিস্তানি হানাদাররা বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করতে পারবে না।

২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম.এ হান্নান। তাকে সহযোগিতা করেন প্রকৌশলী আমিনুর রহমান ও রাখাল বণিক। আগ্রাবাদে বাঙালি নিয়ন্ত্রিত বেতার কেন্দ্রটি নিরাপদ নয় ভেবে ২৬ মার্চ বিকেলে আওয়ামী লীগ নেতা বেলাল মোহাম্মদ, রেডিও ইঞ্জিনিয়ার নাসিরউদ্দিন ও অন্যদের দিয়ে বেতার ট্রান্সমিটারটি কালুর ঘাটে স্থানান্তর করা হয়। বেতার কেন্দ্রটির নামকরণ করা হয় বিপ্লবী বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র। সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে ২য় অধিবেশন শুরু হয়। ২য় অধিবেশনে এম.এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা দ্বিতীয়বার পাঠ করেন। অধ্যক্ষ আবুল কাশেম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করে শোনান।

পটিয়া থেকে মেজর জিয়াকে নিয়ে আসেন বেলাল মোহাম্মদ, আব্দুল্লাহ আল-ফারুক, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও অন্যরা। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি জ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার হিসেবে ১০ কি. ওয়াট মধ্যম তরঙ্গ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কালুরঘাট থেকে জাতির পিতার পক্ষে ঘোষণাটি পাঠ করলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণার পর সারা বাংলায় শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে ছিল না সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুরের বীর সন্তানরা। এই বীর সন্তানদের মধ্যে ছিলেন শাহজাদপুরের রতনকান্দি গ্রামের দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীতার ঘোষণা শোনার পর পাকহানাদারদের পরাজিত করে দেশ স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেন এবং নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন।

৩০ এপ্রিল ’৭১ বাঘাবাড়ী ঘাটের দক্ষিণ পাড় এসে পাক হানাদার বাহিনী এক বিকট শব্দের শক্তিশালী মর্টার সেল ছাড়ল। এই মর্টার সেলের ভয়ংকর আওয়াজে গোটা এলাকার মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মর্টার সেলের গুলিটি বাঘাবাড়ি ঘাট থেকে ৬ কি. মি. দূরে গিয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এ দেশের বাঙালি হত্যা, লুণ্ঠন ও বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন চালানোর জন্য এ দেশীয় দোসর খুঁজতে থাকল। জামায়াতে ইসলামী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমীর গোলাম আযম ও অন্যান্যরা টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করে। তার অঙ্গীকার অনুসারে জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী দল পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ সেনাবাহিনীর পক্ষে সরকারে যোগ দিয়ে রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও শান্তি কমিটি গঠন করে। এসব সন্ত্রাসী বাহিনী এলাকায় চালায় হত্যা, ধর্ষণসহ নানা প্রকার নিপীড়ন-নির্যাতন।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে রাজাকারেরা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল-এর বাড়ি আসে। ৭ দিনের মধ্যে দেবেশকে হাজির করে না দিতে পারলে বাড়ির সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হবে ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হবে। দিশেহারা হয়ে তার বাবা-মা, দাদারা ও পরিবারের অন্যান্য সবাই তাদের বসতবাড়ি গ্রামের মো. হোসেন আলীর জিম্মায় রেখে ভারতে চলে যায়। জামায়াতে ইসলামের নির্দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা সবাইকে বুঝাতে থাকে ভারত পাকিস্তানকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করে এ দেশের হিন্দুদের দিয়ে গোলমাল বাঁধিয়েছে। হিন্দুরা ইসলামের দুশমন, এ দেশের শত্রু, ভারতের অনুচর তাদের বাড়িঘর, মালামাল সবাই লুট করে নিয়ে তাদেরকে নির্যাতন করে হত্যা করুন।’

জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর নির্দেশ পেয়ে রাজাকাররা শাহজাদপুরের প্রাণ গোপাল সাহা, গৌর কু-ু ও অন্যান্য হিন্দু দোকানের সব মালামাল প্রকাশ্যে দিবালোকে লুট করে আনল। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান তাদের গ্রামে আসলেন। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক শাহজাদপুর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেনসহ উচ্চপদস্থ কর্মচারী আমাদের গ্রামের সহ-অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন।

২৫ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকায় জঘন্যতম নারকীয় ঘটনা দেখে প্রত্যক্ষদর্শীরা ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরে আসে। তাদের মুখ থেকে নারকীয় হত্যার কথা শুনে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন দুঃসাহসী বীর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যাল।

দেবেশ সান্যাল সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক এ.কে. শামস্ উদ্দিন, আব্দুল লতিফ মির্জা ও অন্যদের বাঘাবাড়িঘাট, প্রতিরোধ যুদ্ধে সহযোগিতা করেন। দেবেশ সান্যাল তখন রতনকান্দি আদর্শ নি¤œমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বাংলাদেশের অনেক এলাকা তখন পাক হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর জামায়াতে ইসলাম ও মুসলিম লীগসহ অন্যান্য ইসলামি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের দখলে চলে যায়। পাক হানাদাররা হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর পোড়ানো, লুটতরাজ, হত্যা ও নির্যাতনসহ জঘন্যতম মানবতাবিরোধী কাজ শুরু করল। যে-কোনো পুরুষকে দেখলে পাক হানাদাররা বলত কাপড় তোল, চার কালেমা বাতাও। মালাউন কাহা হ্যায়, মুক্তি কাহা হ্যায়।

দেবেশ সান্যাল ২৩ জুলাই ১৯৭১ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুর রহমানের সঙ্গে ভারতে যান মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য। প্রথমত বয়সের স্বল্পতার কারণে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কর্তৃপক্ষ তাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়াতে রাজি হলেন না। উপায় না পেয়ে মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছেড়ে তিনি তার পিসে মহাশয় বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যের বাড়ি মালদা জেলার ওল্ড মালদাতে চলে যান। ভারতের সরকার তখন বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য বাস-ট্রেন ফ্রি করে দিয়েছে। বাসের কন্ডাক্টর বা ট্রেনের টিটি টিকিট চাইতে এলে জয় বাংলা বললেই আর টিকিট বা ভাড়া চাইত না। পিসে মহাশয়ের বাড়িতে তিনদিন থাকেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে এসে আত্মীয় বাড়িতে বা শরণার্থী ক্যাম্পে বসে বসে খাওয়াতে মন সায় দিল না। সিদ্ধান্ত নেন বাড়িতে ফিরে এসে প্রশিক্ষণহীন অবস্থাতেই অন্যদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করব। কামারপাড়া ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার মধ্যে প্রবেশ করেন। তার পরনে ছিল পিসে মহাশয়ের দেওয়া ভারতীয় কাপড়ের ইংলিশ প্যান্ট ও শার্ট। এক বৃদ্ধা মহিলা তাকে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া দেখে এগিয়ে এলেন। বিভিন্ন কথাবার্তা শুনলেন। তারপর বললেন “বাবা, তুমি ভারতে ফিরে যাও, ঐ সামনে বাংলাদেশের পাঁচবিবি থানার পাক হানাদার মিলিটারি ও রাজাকার ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। তোমার পরনে এই ভারতীয় কাপড় দেখলেই ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।” মা বয়সি মহিলার কথায় দিশেহারা হয়ে বসে বসে কিছুক্ষণ চিন্তা করেন। আর কোনো পথ না থাকায় পুনরায় ভারত সীমান্ত পার হয়ে কামারপাড়া মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে যান। মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ যুব শিবিরে এসে শাহজাদপুরের রবীন্দ্রনাথ বাগচী ও রতন কুমার দাসের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তারা তাকে নিয়ে কামারপাড়া মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আবু সাইদের কাছে নিয়ে গেলেন।

তিনি তাকে বিশেষ বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করলেন। তাদের প্রথমে প্রশিক্ষণ হলো কামারপাড়া রিক্রুটিং ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণে ফলোইং করিয়ে প্রথমেই জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা .... গাওয়া হতো। তারপর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রণসংগীত “চল চল চল,” গাওয়া হতো। তারপর জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালি অস্ত্রধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, শেখ মুজিবের অস্ত্র ধর প্রভৃতি স্লোগান দিয়ে সবাইকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করা হতো।

তাদের কামারপাড়া রিক্রুটিং ক্যাম্প থেকে মালঞ্চ ও কুড়মাইল স্থানান্তর করা হলো। তারপর পতিরাম যুব ট্রেনিং শিবিরে নিয়ে ট্রেনিং দেওয়ানো হলো। হায়ার ট্রেনিং হলো শিলিগুড়ি জেলার পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত পানিঘাটা নামক ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, গ্রেনেড, এল.এম.জি, স্টেনগান ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ হলো। প্রশিক্ষক শিখসেনা ডি.এস.ভিলন জানালেন তার এফ.এফ নং ৪৭৪২। পানিঘাটা ট্রেনিং সেন্টারে তাদের পূর্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের স্লেটে এফ.এফ নং লিখে বুকের ওপর রেখে ছবি তোলা হয়েছে। ক্রমাগত কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে তাদের ব্যাচের এফ.এফ নং লিখে ছবি তোলা হলো না।

প্রশিক্ষণ শেষে ৭নং সেক্টরের অস্ত্র সরবরাহ প্রধান অফিস তরঙ্গপুর এনে তাদের একটি গ্রুপ করা হলো। তাদেরকে ৭নং সেক্টর এলাকায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দিলেন। রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া এবং দিনাজপুর জেলার কিছু অংশ ছিল ৭নং সেক্টর এলাকা। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান এবং সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী। দেবেশ সান্যালদের গ্রুপ কমান্ডার নিযুক্ত হলেন বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের এম.এ মান্নান। তাদের গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ জন। তারা তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ট্রেন পথে আসাম প্রদেশের ধুপরি ও গৌহাটি হয়ে মানকার চর ভারতীয় সীমান্তে আসে। মানকার চর রাত থেকে পরদিন বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল রংপুর জেলার রৌমারী আসে। রৌমারী থেকে কমান্ডার সিরাজগঞ্জের চরে আসার নৌকা রিজার্ভ করে নিলেন। তারা নৌকাযোগে বাহাদুরাবাদ ঘাটের সম্মুখ দিয়ে ৪ দিনে বেলকুচির এম.এন.এ আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়ির সম্মুখে যমুনার চরে পৌঁছান।

পরে নদী পার হয়ে এসে যমুনা নদীর পাড় ঘেঁষা জঙ্গলে আজ এখানে কাল সেখানে বিভিন্ন গ্রামে থাকতেন। প্রতিদিন সকালে গ্রুপ করে করে রেকি করার জন্য বের হন। আর মোমিন তালুকদারের ভাই রশিদ তালুকদারের প্রস্তুত রাখা খাদ্য নিয়ে শেল্টারে ফিরে। আজ এ শেল্টার, কাল সে শেল্টারে থেকে বিভিন্ন থানা ও রাজাকার ক্যাম্পে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ করেন। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ছিল রণাঙ্গনে প্রধান সাহসী হওয়া ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার ধ্বনি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল বিভিন্ন সম্মুখ, গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি যেসব সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে স্মরণীয় হলো :

বেলকুচি থানা আক্রমণ : ২৪ অক্টোবর কমান্ডার স্যার এবং আরো ৩ জন বেলকুচি থানা রেকি করলেন। সিদ্ধান্ত হলো তাদের দলের ১৭ জন থানা এবং অন্য ২১ জন মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমণ করবে।

পরিকল্পনা অনুসারে বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যাল ও রতনসহ ২৭ জন কমান্ডার মো. আব্দুল মান্নান স্যারের কমান্ড অধীন হয়ে থানার পশ্চিম পার্শ্বে আক্রমণ করল। মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমণে নেতৃত্ব দেবেন তাদের দলের রবীন্দ্র নাথ বাগচী। পরিকল্পনা অনুসারে রাত ৩টায় তারা একযোগে বেলকুচি থানা ও আব্দুল মতিনের বাড়ি অ্যাম্বুশ করে। ক্রলিং করে তাদের দল থানার সম্মুখস্থ সেন্ট্রির সামনে যায়। কমান্ডার স্যার কমান্ড করলেন, তারা গুলি ছুড়ল, গুলি খেয়ে সেন্ট্রি ঢলে পড়ল। ২ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে তারা বিজয়ী হয়ে থানার মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঢুকে দেখে ৩ জন রাজাকারকে গুলি চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়ে থানার পুলিশ মিলিশিয়া ও অন্যরা যমুনা নদীতে অবস্থিত স্পিড বোট ও লঞ্চে পালিয়ে গেছে। ৩ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসে দেবেশ সান্যালরা। মতিন সাহেবের বাড়িতে আক্রমণ করে মতিন সাহেবকে ধরা যায়নি। তিনি পালিয়ে গেছেন। বিজয়ী হয়ে তারা দুই দল একত্রিত হয়ে বিজয় উল্লাস করে। সকাল আটটা পর্যন্ত বিজয় উল্লাস করে কমান্ডার স্যারের তামাই গ্রামের বাড়িতে শেল্টার নেন। এই যুদ্ধে ১ জন পাকি মিলিশিয়া ও ৩ জন রাজাকার মারা গিয়েছিল।

কালিয়া হরিপুর অপারেশন : ৪ নভেম্বর ১৯৭১ বীর মুক্তিযোদ্ধারা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন ব্রিজ পাহারারত রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন করে। তাদের এই যুদ্ধের গাইডার ছিলেন সিরাজগঞ্জ সদরের এম.এন.এ জনাব মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা ঝাউল গ্রামের মো. আব্দুল হামিদ তালুকদার। রাত নয়টায় সমেশপুর থেকে হাঁটা পথে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নেয় রেললাইনের পূর্বদিকে। ঐ রাতে তাদের পাসওয়ার্ড ছিল জবা ও গোলাপ। সিদ্ধান্ত ছিল যুদ্ধ করতে গিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে সবাই একত্রিত হব তামাই গ্রামের তাদের কমান্ডার স্যার জনাব মো. আব্দুল মান্নানের বাড়িতে। দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যাল ক্রলিং করে রেললাইনে মাইন পুঁতে রেখে এসে তারটি কমান্ডার স্যারের হাতে দেন। রাত নয়টা পঁচিশ মিনিটে একদল আর্মি ও রাজাকার টহল দিতে গেলে তাদের পায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাইনের তার লেগে বিদ্যুৎ সংযোগ অবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাকি হানাদাররা টর্চলাইট মেরে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে আর বারবার বকাবকি করতে থাকে। পাকি আর্মি ও রাজাকারদের সংখ্যাধিক্য থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার স্যার গুলি করতে নিষেধ করলেন। মুক্তিযোদ্ধারা ক্রলিং করে পিছিয়ে এসে নিরাপদ আশ্রয়ে একত্রিত হয়ে কল্যাণপুর চলে আসে। পরদিন সিরাজগঞ্জ সদর থেকে শতাধিক আর্মি এসে কালিয়া হরিপুর স্টেশনসংলগ্ন ৩টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়।

৩. কল্যাণপুর যুদ্ধ : সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলাধীন বেলকুচি সদরের ৭ কি. মি. দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত কল্যাণপুর গ্রাম। ৫ নভেম্বর ’৭১ রাত একটায় কালিয়া হরিপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটি দুই গ্রুপে বিভক্ত করে কমান্ডার স্যার এক গ্রুপ নিয়ে যমুনা নদীতে থাকা নৌকায় চলে গেলেন। আর ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ বাগচীর কমান্ডাধীনে পায়ে হাঁটা পথে রওনা হয়ে ভোর ৫টায় এসে পৌঁছে কল্যাণপুর গ্রামে। তারা এক বাড়িতে অবস্থান নেয়। সকালে রাইফেলে ফুলতুরী মেরে মাঠে প্রকাশ্যে পিটি প্যারেড করে। পিটি প্যারেড শেষ করে তারা পর্যায়ক্রমে সকালের জলখাবার খেতে থাকে। পর্যায়ক্রমে সেন্ট্রি রাখা হয়।

সকাল ১০.৩০ মি. সেন্ট্রি রতন কুমার দাস ও মো. নজরুল ইসলাম এসে বলল পাকি হানাদার আসছে। কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগচীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কল্যাণপুর রাস্তার দক্ষিণ পার্শ্বে বাঁশঝোপের মধ্যে পজিশন নেয়। দুজন মুখ বাঁধা স্বাধীনতাবিরোধী পাকি দালাল পথ দেখিয়ে বওড়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে কল্যাণপুর নিয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকারদের ফলো করে কল্যাণপুর মাদ্রাসার কাছের রাস্তার পার্শ্বে বাঁশঝোপের মধ্যে পজিশন নেয়। পাকি হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছাকাছি আসতেই কমান্ডারের কমান্ড পেয়ে ফায়ার শুরু করে। পাকি হানাদাররা লাফ দিয়ে রাস্তার উত্তর পার্শ্বে পজিশন নিল। গোলাগুলির সংবাদ পেয়ে কল্যাণপুর বিল এলাকা, ধুলের চর ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য গ্রামে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলো তাদের দিকে মার্চ করল। তারা তাদের অবস্থান থেকে পাশ ওয়ার্ডভিত্তিক গুলি ছুড়ে নিশ্চিত করল। তারা আরো সাহসী হয়ে সম্মুখ যুদ্ধ করতে থাকে। ঘণ্টাব্যাপী সম্মুখ যুদ্ধ চলল। পাকি হানাদাররা কভারিং ফায়ার করতে করতে বওড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কামারপাড়া হয়ে বেলকুচি থানায় গিয়ে আশ্রয় নিল। উক্ত যুদ্ধে একজন রাজাকার ও একজন পাকি হানাদার গুলিবিদ্ধ হয়েছিল।

৪. ধীতপুর যুদ্ধ : দেবেশ সান্যাল সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক গ্রামে সংগঠিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাকি হানাদাররা নৌকায় পার হয়ে মালিপাড়া এসে পায়ে হেঁটে কৈজুরী ওয়াপদা বাঁধ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপসহ শাহজাদপুর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সব মুক্তিযোদ্ধা দল একত্রিত হয়ে তাদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটা ছিল ২৫ নভেম্বর ’৭১। মুক্তিযোদ্ধারা কৈজুরী থেকে তাদের পিছু ধাওয়া করে। পাকি হানাদাররা সংখ্যায় ছিল ৩০/৩৫ জন। ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওরা পজিশন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালানো শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারাও পজিশন নিল।

মুক্তিযোদ্ধা দলের অবস্থান হলো ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিম পার্শ্বে। দুই ঘণ্টার মতো সম্মুখ যুদ্ধ হলো। এর মধ্যে সূর্য অস্তমিত হলো। অন্ধকারে গুলি চালালে পাকি হানাদারদের গায়ে না লেগে সাধারণ গ্রামবাসীদের গায়ে লাগতে পারে ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝে দুই একটা আকাশমুখী গুলি ছুড়তে থাকে। পাকি হানাদারদের পক্ষ থেকেও দুই-একটা গুলি আসছিল। এভাবে সারা রাত পজিশন অবস্থানে থাকল মুক্তিযোদ্ধারা। ভোর হলে ক্রলিং করে দুঃসাহসিকভাবে ধীতপুর সারের গুদামের কাছে যায়। ওরা ধীতপুরের সার গুদামে অবস্থিত ডিসপেনসারিতে শেল্টার নিয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যালের হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল তার বাম পাশে কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগচী ও ডান পাশে সমরেন্দ্রনাথ সান্যালসহ ১৭ জন সহযোদ্ধা। তাদের গ্রুপের পেছনে পেছনে আরও পাঁচ-সাতটি গ্রুপের পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। পাকিহানাদার শেল্টারে গিয়ে দেখে দুজন রাজাকার গুলি চালাচ্ছে।

কমান্ডার তাদেরকে সারেন্ডার করার কমান্ড করলেন। তারা উপায় না পেয়ে সারেন্ডার করল। এই রাজাকার দুজনের নাম ছিল লতিফ ও কালাম। ওদের কাছ থেকে জানা যায় ওদেরকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে পাকি হানাদাররা রাত ১টার পর বেড়া খেয়াঘাট পার হয়ে বেড়া নগরবাড়ি হয়ে পালিয়ে গেছে। এই যুদ্ধে আমির হোসেনের গ্রুপের বৃশালিখা গ্রামের মো. আব্দুল খালেক শহিদ হয়েছিলেন। দুইজন সাধারণ মানুষ মারা গিয়েছিল। এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যাল বিভিন্ন সম্মুখ, গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ পাক হানাদার মুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ, মাহমুদা কোলা গ্রামের মো. আব্দুল হামিদের রেকিতে ঝাঐল ব্রিজের রাজাকারদের ধরে আনা, কালিয়া হরিপুর যুদ্ধ, কল্যাণপুর যুদ্ধ ও ২৫ নভেম্বর শাহজাদপুরের ধীতপুর যুদ্ধসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিজয়ী হয়ে ৯ ডিসেম্বর ভোরে রণাঙ্গনের সাথিদের নিয়ে বিজয়ীর বেশে আকাশমুখী থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি করতে করতে ও জাতীয় পতাকা দিয়ে উড়াতে উড়াতে নিজ গ্রামে চলে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল।

দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যালের গ্রামে ফেরার সংবাদ পেয়ে একনজর দেখার জন্য দলে দলে লোকজন ও স্কুল সাথিরা আসে। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। বাঘাবাড়িঘাট পাক হানাদারদের দখলে। রতনকান্দি আদর্শ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্রনাথ সান্যাল ও অন্যান্য শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে জাতীয় সংগীত গেয়ে দৃপ্তকণ্ঠে শাহজাদপুর পূর্বাঞ্চলকে হানাদার মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেন।

৮ জানুয়ারি, ’৭২ পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন ও নয়াদিল্লিতে সংবর্ধনা নিয়ে ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ বাংলাদেশে আসেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতাবিরোধীদের একদিনের মধ্যে হাতে বিচার করতে চাইল। কিন্তু মহৎপ্রাণ জাতির পিতা পরে দেখা যাবে বলে সবাইকে শান্ত করলেন। তিনি বাংলাদেশে এসে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে এ দেশ ছেড়ে চলে যাবার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার আদেশ করলেন। ১২ মার্চ, ১৯৭২-এর ভেতর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে চলে যায়।

জাতির পিতার আদেশ অনুসারে দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যাল তাদের গ্রুপের অন্যদের সঙ্গে ২৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ সাল রোজ রবিবার সিরাজগঞ্জের ইব্রাহিম বিহারির বাসায় সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর সম্মুখে লে. সাইফুল্ল্যার কাছে অস্ত্র জমা দেন। সরকারি উদ্যোগে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মিলিশিয়া ক্যাম্প করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মসংস্থানে সহযোগিতা করার জন্য মিলিশিয়াতে ভর্তি হওয়ার আহ্বান জানানো হলো। এ সময় দেবেশ সান্যালের বাবা-মা তাকে লেখাপড়া করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাই তিনি আর মিলিশিয়া ক্যাম্পে ভর্তি হননি। বাড়ি চলে আসেন।

১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তাকে সংবাদ দেওয়া হলো অস্ত্র জমা দেওয়ার রশিদ ফেরত নিয়ে তাকে মহান মুক্তিবাহিনীর সেনাবাহিনী মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট নং ১২৯১৫৮, একটি সাদা কম্বল ও বকেয়া রেশনিং অ্যাল্যাউন্স এবং পকেট ভাতা হিসেবে ১১০ টাকা দেওয়া হলো। দেবেশ সান্যাল মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করে রতনকান্দি আদর্শ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসে প্রধান শিক্ষক বাবু দেবেন্দ্রনাথ সান্যাল এর কাছ থেকে অষ্টম শ্রেণির অটোপাশের সার্টিফিকেট নিয়ে শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন।

স্বাধীনতার পর লেখাপড়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। এ প্রত্যাশা নিয়ে তিনি গঠন করেন কয়েকটি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংসদ, মুক্তিযুদ্ধচর্চা কেন্দ্র ও ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থের গণপাঠাগার। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সর্বসাধারণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রচার করেন তিনি। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অনেকেই তার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। এলাকায় গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বিশাল এক জনগোষ্ঠী। কিন্তু এসব কর্মকা- বাধাপ্রাপ্ত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।

এ সময় থেকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে খুনি মোস্তাক সরকারের সহযোগিতায়। তারা মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর চালায় নানা প্রকার নিপীড়ন-নির্যাতন। যার জন্য এলাকায় অবস্থান করাই কঠিন হয়ে পড়ে অনেকের। ফলে দীর্ঘ পাঁচ বছর আত্মগোপন অবস্থায় থাকতে হয় দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যালকে। পরে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায় আওয়ামী লীগসহ তার সহযোগী সংগঠনগুলো। ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনরায় শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্জাগরণের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মকা-। সবার সহযোগিতায় ও আশ্বাসে প্রেরণা পেয়ে নতুন উদ্দীপনায় বাস্তবায়ন করতে থাকে বিভিন্ন পরিকল্পনা। এর মধ্যে জাতীয় বিজয় দিবস উদ্্যাপন, মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থ বিতরণ, মুক্তিযুদ্ধের ওপর পাঠচক্রের আয়োজনসহ আরো অন্যান্য কর্মসূচি।

২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর রতনকান্দী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে আসে। বিদ্যালয়ের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র হিসেবে সংবর্ধনা দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যালকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগরণের অংশ হিসেবে স্কুলে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকমণ্ডলী ও এলাকার বিশিষ্ট জনদের মধ্যে প্রদর্শিত হয় পাক হানাদারদের নৃশংসতার (১৯৪৭-১৯৭১) তথ্যচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগরণমূলক বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য চয়ন ইসলামের বরাবর। তারা দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যালের আবেদনে সাড়া দেন।

একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। তিনি আশা করেন সব মুক্তিযোদ্ধা এভাবে কাজ করে যাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য। তাহলে লাখো শহিদের রক্তে ও বাঙালি জাতির সকল নারী-পুরুষের ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ সোনার বাংলাদেশ হবে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ।