ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত

প্রতি মুহূর্ত মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে চলে একটি শরণার্থী পরিবার 

২০২২ এপ্রিল ০৭ ১৭:১৯:১৬
প্রতি মুহূর্ত মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে চলে একটি শরণার্থী পরিবার 

দেবেশ চন্দ্র সান্যাল


সিরাজগঞ্জ জেলার (স্বাধীনতা পূর্ব- পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ) শাহজাদপুর উপজেলার হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নাধীন রতন কান্দি গ্রামের “দ্বিজেন্দ্র নীলিমা” পরিবারটি একটি শরণার্থী পরিবার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্য বর্বরো চিত “অপারেশন সার্চ লাইট ” শুরু করে বাঙালিদের উপর মুুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। সারা দেশে পাকিস্তানি সৈন্য নির্বিচারে বাঙালি হত্যা, অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কার্যক্রম শুরু করে। তখন এই পরিবারের সদস্য ছিল ৮ জন।

২৩ জুলাই’ ৭১ পরিবারের তৃতীয় সন্তান দেবেশ চন্দ্র সান্যাল মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যায়। দেবেশ চন্দ্র সান্যালের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সংবাদ থানা সদর ও পার্শ্ববর্তী রাজকার ক্যাম্প পোরজনা ও অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। শাহজাদপুর রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকারেরা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল এর বাড়িতে আসে। তারা বাড়ির সবাইকে শাসিয়ে দিয়ে বলে “৭ দিনের মধ্যে দেবেশ কে হাজির করে দিতে হবে। অন্যথায় পরিবারের সবাইকে সারিবদ্ধ করে গুলি করে হত্যা করা হবে । বাড়ি ঘর লুটতরাজ করা হবে ও পুড়িয়ে দেওয়া হবে।” রাজাকারদের আলটিমেটামে দিশে হারা হয়ে পড়লো “দ্বিজেন্দ্র- নীলিমা” পরিবার। বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল ছিল রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রদান শিক্ষক। দেশে মুক্তি যুদ্ধের কারনে স্কুল বন্ধ করা হয়।

১৪ মে ৭১ জেলার ডেমরা পাকিস্তানি সৈন্যরা গন হত্যা করেছে। নির্বিচারে এই গ্রামের সাত শতাধিক হিন্দু মুসলমান নারী পুরুষকে গণ হত্যা করেছে। ডেমরা গণ হত্যায় এই পরিবারের ৫ জন নিকট আত্মীয় গণ হত্যার শিকার হয়েছে। করঞ্জা গণ হত্যা হয়েছে। এই পরিবারের ১ জন নিকট আত্মীয় গণ হত্যার শিকার হয়েছে। পুঠিয়া গ্রামের প্রখ্যাত শিক্ষকু হিতেন্দ্র চন্দকে কৈজুরী রাজাকার ক্যাম্পের পরিচালক ব্যারিষ্টার মো: কোরবান আলীর নির্দেশে তাঁর ভাই মো: ছগির উদ্দিন অন্যান্যদের সাথে নিয়ে রাতে ধরে বাড়ির কাছে নির্যাতন করে গুলি কার হত্যা করেছে । পোরজনা রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার মো: আতাউর রহমান আতা অন্যান্যদের সাথে নিয়ে পোরজনা গ্রামের ধনাঢ্য মনীন্দ্র নাথ ঘোষকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করেছে।

শাহাজাদপুর সাহা পাড়ার এক হিন্দু যুবতী কে জোর করে ধর্মান্তরিত করিয়ে এক রাজাকার নিকাহ করেছে। রতন কান্দি গ্রামের হাট থেকে প্রকাশ্যে ধরে নিয়ে ভৈরব পাড়া গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র সরকার কে রাজাকারেরা চোখ বেঁধে নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করেছে । তাঁর লাশ ফেলে রেখেছিল বাড়ি থেকে ৩ কি: মি: দূরে দরগার চড়ে। ২৫ এপ্রিল’৭১ পাকিস্তানি সৈনিকরা গণ হত্যা করেছেন উল্লাপাড়া থানার চড়িয়া গ্রামে। নির্বিচারে ১২৯ জন হিন্দু মুসলমান নারী পুরুষকে গনহত্যা করেছে। এই সকল জ্বালাও পোড়াও, নির্যাতন, গণহত্যার সংবাদে নিরাপত্তা হীনতায় বাড়িঘর সব ফেলে গোপনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে “দ্বিজেন্দ্র- নীলিমা” পরিবার ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাত্রা পাথে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল মৃত্যু ঝুকিপূর্ণ। কারণ রাস্তায় রাস্তায় পাকি হানাদার ও রাজাকারদের ক্যাম্প। ভারতের যাওয়ার পথ চলা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ। জায়গায় জায়গায় রাজাকারেরা সশস্ত্র পাড়া দেয়। ধরা পড়লে নির্যাতন করে সবাইকে হত্যা করবে ।

সেপ্টেম্বার’৭১ এর মাঝা মাঝি সময়ে বিভিন্ন ঝুুঁকি পূর্ণ এলাকা অতিক্রম করে খেয়ে না খেয়ে ভারতের আসামের মানিকার চর গিয়ে পৌছায়। আশ্রয় নেন মানিকারচর শরণার্থী ক্যাম্পে। কয়েক দিন মানিকারচর পরিবারের বড় ছেলে দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল ও মেজো ছেলে সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল সহ সবাই ক্যাম্পে অবস্থান করেন। তারপর বড় ছেলে ও মেজো ছেলে শরণার্থীদের মাঝে রেশন চাল, ডাল ও খড়ি বিতরণে সহযোগিতা করেন। বাবা-মা প্রায় পাগল হয়ে গিয়ে ছিলেন। একটি কিশোর ছেলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আধুনিক অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত সবচেয়ে নিষ্ঠুর পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যের বিরুদ্ধে য্দ্ধু করবে এ কথা চিন্তা ও করা যায় না। নিশ্চিত সে মারা যাবে। এই ভেবে বাবা-মা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিদিন বাবা-মা মানিকাচর নদীর ঘাটে আসতেন। আর মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা দেখলে নাম ধরে ধরে ডাকতেন।“দেবেশ এসেছিস কি না”। আবার সন্ধ্যায় শরণার্থী ক্যাম্পে ফিরে যেতেন।

১৬ ডিসেম্বার’৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ভারত থেকে নিজ দেশে ফিরো আসেন “দ্বিজেন্দ্র- নীলিমা ” পরিবার । মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আসে মেজো ছেলে সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল ও সেজো ছেলে দেবেশচন্দ্র সান্যাল। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে বস বাস । কিছু দিন শরণার্থী পরিবারকে পুণর্বাসন করার জন্য সরকার থেকে বিনা মূল্যে চাল, গম সরবরাহ করে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, উল্লাপাড়া।