ঢাকা, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

কর্ণফুলী ভূমি অফিসে ৭ আউটসোর্সিং কর্মচারী

তিন বছর চাকরি করে বেতনও নেই চাকরিও নেই!

২০২২ এপ্রিল ১০ ১৭:০৬:৫৭
তিন বছর চাকরি করে বেতনও নেই চাকরিও নেই!

জে.জাহেদ, চট্টগ্রাম : রাজস্ব খাতে পদ সৃজন হলেও আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে জনবল সরবরাহ করে জেলা প্রশাসক অফিসের যোগদান আদেশ পেয়ে বেতন-ভাতা ছাড়াই তিন বছর ধরে কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিস ও চার ইউনিয়ন ভূমি অফিসে চাকরি করেছেন ৭ (সাত) কর্মচারী। তাঁরা সরকারি কাজ করেছেন; কিন্তু সরকারি কর্মচারী নয়। সরকার তাঁদের স্থায়ী নিয়োগ দেয় না। আবার সরাসরি বেতনও দেয় না। তাঁরা বেতন পায় সরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে। কিন্তু তাও নেই বিগত তিন বছর ধরে। হঠাৎ অদৃশ্য কারণে চাকরিও গেল।

অথচ তাঁদের স্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অস্থায়ী নিয়োগ দেয়। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দেওয়ায় তাঁদের নিয়োগের বিষয়টি ঝুঁলে রয়েছে বলে দাবি ভুক্তভোগি ৭ কর্মচারীর। এ কারণে বেতন-ভাতা না পেয়ে তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাহলে কী সরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া টাকা আর কর্মচারীকে দেওয়া টাকার পার্থক্যই হলো আউটসোর্সিং কম্পানির মালিকের লাভ। এ কারণেই আউটসোর্সিং কম্পানির নিরন্তর চেষ্টা কর্মচারীদের ঠকানোর। না, অন্য কিছু ঘটেছে এই সাত জনের বেলায়!

ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৭ শে জুন ভূমিমন্ত্রণালয়ের স্মারকমূলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয় (রাজস্ব শাখা) কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিস ও ৪টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস সমূহে (প্রসেস সার্ভার ১টি, অফিস সহায়ক ৫টি ও চেইনম্যান ১টি) আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে দরপত্র আহ্বান করেন।

২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ১৩টি শর্ত সাপেক্ষে ঢাকার ‘বিনিময় সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ কে কার্যাদেশ প্রদান করেন। পরে কার্যাদেশ পেয়ে উল্লেখিত তিন পদে সাত জনবল সরবরাহ করেন বিনিময় সিকিউরিটি।

এতে প্রসেস সার্ভার পদে মোঃ মহসিন। চেইনম্যান পদে মোহাম্মদ সরওয়ার। অফিস সহায়ক পদে মোঃ ইউসুফ। পরবর্তীতে নিয়োগ পেয়ে তিনজনেই তিন বছর উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত ছিলেন। একই সাথে চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহায়ক পদে শাকিল আহমেদ, শিকলবাহা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, জুলধা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে মোহাম্মদ আইয়ুব ও চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে মোঃ দেলোয়ার হোসেন কর্মরত ছিলেন।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের রাজস্ব শাখা সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁরা আউটসোর্সিং কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন। যোগদান করার পর থেকে অদ্যবধি তাঁদের কোন বেতন ভাতা করা হয়নি। একই বছরের অক্টোবরে ৮ মাসের বেতন বিলের চাহিদাপত্র পাঠালেও কতৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি কর্ণফুলী উপজেলার তৎকালিন সহকারি কমিশনার (ভূমি) সুকান্ত সাহা সংযুক্তিসহ ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠালেও বেতনের কোন সুরাহা হয়নি বলে জানা যায়।

অফিস সহকারি মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রীট পিটিশন নং-১৩০২৪/২০২১ ইং মামলায় নির্দেশনা দিয়েছেন আমাদের সমুদয় বেতন ভাতা পরিশোধ করে চাকরি নিয়মিত করণের। যা আমরা গত মাসে ডিসি অফিসে জমা দিয়েছি।’

তৎকালিন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে তাঁদের যোগদানের নির্দেশ প্রদান করে প্রসেস সার্ভার এর (১৯ গ্রেড) মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয় ১৪ হাজার ৭০০ টাকা, অফিস সহায়ক ও চেইনম্যানের এর (২০ গ্রেড) মাসিক বেতন ১৪ হাজার ৪৫০ টাকা। তাছাড়া সরকারি বিধি মোতাবেক প্রত্যেক আউটসোর্সিং কর্মচারী বছরে দুটি করে উৎসব প্রণোদনা, নববর্ষ প্রণোদনা প্রাপ্য হবেন বলে উল্লেখ করলেও তিন বছরে উৎসব ভাতা তো দূরের কথা, মুল বেতনের দেখাও পাননি ওরা ৭ জন।

জানা যায়, বিনিময় সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড এর ৭ (সাত) শর্ত মেনে ৩৬ মাস চাকরি করেও বেতনের দাবিতে ওরা বিভিন্ন অফিসে অফিসে ঘুরছেন। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ৩রা জুন ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির ৯ম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিস ও ৪টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের জন্য রাজস্বখাতে ২৩ টি পদ সৃজন করলেও সম্পূর্ণরুপে তা মঞ্জুরি করা হয়নি।

জানতে চাইলে প্রসেস সার্ভার পদের মোঃ মহসিন ও অফিস সহায়ক মোঃ ইউসুফ বলেন, ‘আমরা আউটসোর্সিংয়ের অধীন থাকতে চাইনি। যেহেতু আমাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স নেই। আমরা অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেছি। সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি পেয়ে তিন বছর ছিলাম। হঠাৎ দেখি কোন কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুত। সাথে তিন বছরের বেতনও পাইনি। মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও আমাদের বেতন ও চাকরি ফেরত চাই।’

ঢাকার ‘বিনিময় সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ এর মুখপাত্র কবির হোসেন এর নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ‘বেতন পরিশোধের বিষয়ে’ মুখ খুলতে নারাজ। দায়সারা ভাবে তিনি জানান, ‘আমরা চিঠি পেয়ে সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষকে একাধিকবার জানিয়েছি। সুরাহা হয়েছে কিনা জানি না।’

অফিস সহায়ক শাকিল আহমেদ বলেন, ‘আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে কম বেতন, চাকরির অনিশ্চয়তা ও চাকরির অন্যান্য প্রতিকূল শর্তের কারণে এ পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা স্বভাবতই সার্বক্ষণিকভাবে অভাব-অনটনের মধ্যে থাকেন। আমরাও তার ব্যতিক্রম না। হঠাৎ কোন কারণ বা অপরাধ ছাড়াই চাকরি চলে যাওয়ায় পুরো বেকায়দায় পড়েছি। বিষয়টি আমরা জেলা প্রশাসকের সুনজর প্রত্যাশা করছি।’

জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহিনা সুলতানা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সহকারি কমিশনার (ভূমি) শিরিন আখতার জানান, ‘বিষয়টি আমি যোগদানের আগের ঘটনা। তাই এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে পারব না। তবে পুরো বিষয়টি খোঁজ নিয়ে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে জানাব।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, ‘আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ দেওয়া হয় পার্টিকুলার একটা সময়ের জন্য। এক বছরের জন্য বা সর্বোচ্চ দু’বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ফার্মের সাথে যখন চুক্তি শেষ হয়ে যায়। তখন তাদের চাকরিও শেষ হয়ে যায়। তাদের বেতন ভাতা ঐ কম্পানী দেয়। কম্পানী তাদের কত মাসের বেতন দিয়েছে। এটা আমরা জানি না। আমরা আমাদের স্টাফদের বলে দিয়েছি তাদের কন্টাক শেষ।’

জেলা রাজস্ব শাখার ওই এডিসি আরোও বলেন, ‘বিষয়টি আমি ও বর্তমান ডিসি স্যার আসার আগেকার ঘটনা। তখন আমরা এসিল্যান্ডদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনারা এদের কিভাবে রেখেছেন। আমরা আসার পর অভিযোগ পেয়েছি এরা অফিসে দালালি করেন। তখন আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম তাদের অফিসে না রাখতে। একটু যৌক্তিক ভাবে ভেবে দেখেন। আপনার একটা লোক বেতন পায় না তিন বছর। তাহলে সে চলে কিভাবে? তাহলে এটা নিশ্চিত সামহাউ সে ভূমি অফিসের কোন না কোন জায়গা থেকে সুবিধা নিচ্ছেন। যেটা লিগ্যাল বা সোজা পথ নয়।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নাজমুল আহসান আরো স্পষ্ট করে বলেন, ‘ওই কম্পানী তাদের বেতন দেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের কাছে খবর আছে ‘বিনিময় সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ ও নানা অনিয়মের সাথে জড়িত। আমরা ইতোমধ্যে নতুন করে টেন্ডার দিয়েছি। ভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। ওরা বাজেট দেবেন। তারপর নিয়োগ দেবো। আগের নিয়মে হবে না। আমরা ভূমি অফিসের কোন অনিয়ম দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবোনা।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন,‘ এ বিষয়ে রাজস্ব শাখাকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ওখানেই যোগাযোগ করতে পারেন। ভূমি অফিসে কোনো ধরনের অনিয়ম দুর্নীতি বরদাশত করা হবে না।’

জানা যায়, আউটসোর্সিং নীতিমালা ২০০৮ সালে প্রথম জারি করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু রুলস অব বিজনেস এবং অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী এ নীতিমালা প্রণয়নের কাজ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের।

(জেজে/এসপি/এপ্রিল ১০, ২০২২)