ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

আওয়ামী লীগের ভ্রান্তিবিলাস

২০২২ মে ০৬ ১৫:৩৩:৪৩
আওয়ামী লীগের ভ্রান্তিবিলাস

আবীর আহাদ


আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দল। ক্ষমতা ও আর্থিক লাভালাভই এখন তার রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে অর্থ, আত্মীয়তা ও সংকীর্ণ দলীয় বিবেচনা। আর এ প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত-হেজাজত, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকার ও তাদের সন্তানদের আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দলটিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে দাঁড় করানো হয়েছে। আর সবচেয়ে যে শঙ্কাটি বিরাজ করছে, তাহলো, রাজাকারদের সন্তানেরা আওয়ামী লীগে অবস্থান নিয়ে সবার আগে তারা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে নিশানা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকাদের হত্যা করেছিলো, পরাজিত করেছিলো। সেটিকে মাথায় রেখে রাজাকারদের সন্তানেরা তাদের বাবা-দাদাদের হত্যা ও পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। অনেকের বাড়িঘর দখল করেছে। তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। প্রায় প্রতিদিনই সারা দেশে এভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাবিধ অত্যাচার ও নিপীড়ন চলছে।

এখানেই শেষ নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়া রাঘব বোয়ালরা দলের প্রভাবশালী অবস্থানেই শুধু নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় তথা এমপি মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদেও তারা আজ আসীন হয়েছে! আরো আছে অপদার্থ কিছু এমপি-মন্ত্রী! এরা যে কী যোগ্যতায় এসব অবস্থানে আসন লাভ করেছেন তা দেশের কেউ জানেন না। এর পাশাপাশি দলের জন্য অতীতে যারা অবদান রেখেছেন, মুক্তিযোদ্ধা, সৎ, ত্যাগী ও মেধাবী মানুষগুলো ঐসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের কনুইয়ের ধাক্কায় কোথায় হারিয়ে গেছে, সেসবেরও কোনো খোঁজখবর কেউ রাখে না। অপরদিকে দেশের স্বাধীনতা আনায়নকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত, তাদের প্রতি আওয়ামী লীগের নেতা-এমপি-মন্ত্রীরা, এমনকি হাইকমান্ডও কেনো ও কী কারণে তাদেরকে অবজ্ঞা ও অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে। মনে হয় আওয়ামী লীগও আজ মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা দেখে হিংসায় জ্বলে মরছে। তাইতো মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের নামে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন উপজেলা ও জেলা পর্যায়সহ উচ্চতর পর্যায়ের অমুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সেজে গেছেন।

অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও এভাবেই হাজার হাজার রাজাকার-আলবদররা মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়েছিলো! এভাবে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি বাতিল করে এক মহাভুলের জন্ম দিয়েছেন। তারই ফলশ্রুতিতে গোটা প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দুর্নীতিবাজদের হাতে চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্রের স্টিলফ্রেমে আজ আওয়ামী লীগ সরকার বন্দী। এই আমলারাই সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটার মধ্যে সাগরচুরি সংঘটিত করে সরকারের কিছু কিছু ব্যক্তিকে এসব অপকর্মের সাথে সম্পৃক্ত করে যে লুটপাটের হোলিখেলা চালিয়ে যাচ্ছে, তা রোধ করার নৈতিকশক্তি আওয়ামী লীগ হারিয়ে ফেলেছে। দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে যে বিশাল পরিমাণের অর্থ পাচার করা হচ্ছে, এর মধ্যে আমলা ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যাই সবচে বেশি।

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগের এসব অবস্থার দায় ও দায়িত্ব অবশ্যই তার হাইকমান্ডের ওপর বর্তায়। কিন্তু সবকিছু দেখেশুনেবুঝে মনে হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একটি ধারাবাহিক ভ্রান্তিবিলাসের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে যেখান থেকে সে উঠে আসার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কারণ আওয়ামী লীগের হাতে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি বিক্রি, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করার পাঁয়তারা ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপ করে দলটি নিজেই নিজের আদর্শ ও চেতনার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে! নানান ভ্রান্তিবিলাসিতায় সে যেনো আজ আক্রান্ত।

অনেকে যুক্তি দেখান, সৎ ত্যাগী ও মেধাবীদের দিয়ে নাকি দল ও রাষ্ট্র চলে না! একথা তারা কোন নিক্তিতে মেপে বলেন তা আমরা বুঝি না। নিকট অতীত থেকে অদ্যাবধি কি দল ও দেশ পরিচালনা করার কাজে ঐ সৎ ত্যাগী ও মেধাবীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে? হয়নি বললেই চলে। তাহলে দলে ও সরকারে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের প্রাধান্য দিয়ে ঐসব আন্দাজি কথা বলে প্রকৃতপক্ষে কীসের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয় তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না।

মূলত: রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ঐসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের যোগসাজসে ভাগাভাগি করে লুটপাট করাই হলো লক্ষ্য। এই ভাগাভাগির লুটপাটের হোলিখেলায় দেশের মধ্যে তরতরিয়ে তথাকথিত ধনিক শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের সব সম্পদ মুষ্টিমেয় লুটেরাদের হাতে চলে যাচ্ছে। সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে চরমতম বৈষম্য ও আর্থসামাজিক অরাজকতা, যার প্রভাবে সামাজিক সম্প্রীতি, নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে।

সবকিছু পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, যে-দলটির সাথে দেশের সব দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাঙ্খা জড়িত, জড়িত দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন সে-দলটি আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকটি হারিয়ে ক্রমান্বয়ে অজানা এক অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে! ঠিক এ-অবস্থায় দলটির কাঁধে চড়ে বসেছে আরেক অন্ধকারের অপশক্তি, যার রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে দেশকে ধর্মীয় কূপমণ্ডকতার জালে আটকে দেশের বুকে একটি ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে স্বাধীনতাকে হরণ করা। আর সেই অপশক্তিটি হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। তারা সরকারের ঘাড়ে চড়ে দেশের সর্বত্র ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে দেয়ার মতলব নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

অপরদিকে ইসলাম ধর্মের সোল এজেন্সি নিয়ে তারা কে কাফের, কে মুরতাদ, কে মুসলিম, কে মুসলিম নয় কে আস্তিক, কে নাস্তিক ইত্যাদি বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে ধর্মের নামে দেশের বুকে হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে চলেছে। তাদের মতলব না-বুঝে সরকারও তাদেরকে মাথায় তুলে নিচ্ছে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাজাত শিক্ষা ও সংস্কৃতি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার কথা, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধর্মীয় অপচেতনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে।

দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে তথা ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে যেখানে সাধারণ্যের মনোজগতকে বিকশিত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাভিত্তিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন, সেখানে সরবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ইসলাম ধর্মের আবরণে ধর্মান্ধ, রাজাকারি ও জঙ্গিবাদী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার মূল লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে নস্যাত্ করা। এ-বিষয়টি যদি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে আমাদের সান্ত্বনার জায়গাটা আর অবশিষ্ট থাকে না। আর এ-অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা চরম দিকভ্রান্তি বৈ কিছু নয়। এবং এসবই হচ্ছে আওয়ামী লীগের ভ্রান্তিবিলাসী রাজনৈতিক পদক্ষেপের ফলশ্রুতি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক।