ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বঙ্গবন্ধু হত্যার দুর্বিষহ স্মৃতি

২০২২ আগস্ট ০৮ ১৬:১৯:০৯
বঙ্গবন্ধু হত্যার দুর্বিষহ স্মৃতি

চৌধুরী আবদুল হান্নান


পাকিস্তানের সমর নায়কেরা তাদের হিংস্র সেনাদের বাংলার সবুজ চত্বরে ছেড়ে দিয়েছিল লাগামহীন। ৯ মাস যাবৎ এই দানবেরা ইচ্ছে মতো এ ভূখন্ডে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ হত্যা করলো, মা বোনদেরসীমাহীন অসম্মান করলো, লাঞ্ছিত করলো, বুদ্বিজীবী হত্যা করলো।

বঙ্গবন্ধু একাত্তরের বংশীবাদক, যেন জাদুরবাঁশি বাজালেন তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে। এ অলিখিতভাষণটির অসাধারণ শব্দ বিন্যাস, যুৎসই অর্থবহ উচ্চারণসহ বক্তার তাৎক্ষণিক শারীরিক ভাষারমিশ্রনে যে অনন্যতা দিয়েছিল, তা বিস্ময়কর। বিশ্বের কথিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাকিস্তানি বাহিনী মাথা নতকরে আত্মসমর্পণ করলো বাংলার সূর্য সন্তানদের কাছে ।

‘৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো, বীর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিজয় হলো, বিশ্বে মাথা উঁচু করেজানান দিল একটি নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। সার্থক জনম আমার বিজয় দেখেছি বঙ্গবন্ধুরবাংলাদেশে। রাষ্ট্রের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু তখনও শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর দরজায় ।

এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশে পদার্পণ করে জাতিরউদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণ দিলেন, আনন্দে কাঁদলো বাঙালি। সে কান্না যতটা দেশ স্বাধীন হওয়ার সুখে, তাঁরচেয়ে বেশি বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে। সেদিন বাঙালি জাতি তাঁর প্রতি যে প্রাণঢালা ভালোবাসা দেখিয়েছিল তা পৃথিবীর অন্য কোনো নেতা, রাষ্ট্র নায়ক পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালিরএমন ভালোবাসার কারণেই আগরতলা মামলায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি।

শোকের আবহ নিয়ে বার বার ফিরে আসে আগস্ট। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫ সাল — মাত্র ৫৫ বছরের পার্থিবজীবনের সমগ্র সময়ই একটি মহাকাব্যের ইতিহাস। রাজনীতির কবি শেখ মুজিব এই বাংলাদেশ সৃষ্টিরমহাকাব্যের যে ইতিহাস রচনা করে গেছেন, তা অনন্তকাল ধরে বহতা নদীর মতো বহমান থাকবে ।

জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে উঠা শেখ মুজিবের সারা জীবন কেটে গেছে অন্যায়, অবিচারের প্রতিবাদ করেকরে। পদে পদে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে, অন্যায়-জুলুম দেখলেই তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিকারেনেমে পড়তেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন না কিন্ত যে কীর্তি-দর্শন সৃষ্টি করেগেছেন তা অধ্যয়ন করে, গবেষণা করে যুগে যুগে বুদ্ধিজীবী, পন্ডিত সৃষ্টির বিশাল এক ক্ষেত্র তৈরি হয়েআছে। আমাদের জাতীয় জীবনে মহামানব হিসেবে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু, এসে উপহার দিলেন একটিস্বাধীন দেশ।

দেশবাসীকে পাকিস্তানের অবশ্যম্ভাবী ক্রীতদাসে পরিনত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন, স্বাধীনতাএনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কিন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পূণর্গঠনের সময় পাননি তিনি, তাঁকে সপরিবারে হত্যাকরলো একদল বিপথগামী সেনা সদস্য, বাঙলার কুলাঙ্গার। মর্মন্তুদ হত্যার মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫আগস্ট সূচনা হয়েছিল এক কালো অধ্যয়। ইতিহাসের এ ঘৃণ্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দুর্বিষহ স্মৃতিঅনন্তকাল বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের। দিনটি বঙ্গবন্ধুকে হারানোর অভিষপ্ত দিন, আমাদের আজন্মকান্নার দিন, হৃদয়ে রক্তক্ষরণের দিন। ২১ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও তাদের দোসর স্বাধীনতা বিরোধীরাপাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ শাসন করলো, অপবিত্র করলো । বাঙালি এতো দিন কান্না চেপে রেখেছিল। নির্মলেন্দু গুণের সেই কবিতা অনন্তকাল হৃদয় ছুঁয়ে যাবে —“আজ প্রাণভরে কাঁদে, এসেছে কান্নার দিন, দীর্ঘ দুই দশকের জমানো শোকের ঋণ আজ শেষ করো অনন্ত ক্রন্দনে।”

তিনি ছিলেন নির্ভীক মানুষ, তাঁর ক্ষমাশীলতা ও উদারতার কোনো তুলনা হয় না। গণমানুষের এমননিরঙ্কুশ সমর্থন তিনি লাভ করেছিলেন যা পৃথিবীতে বিরল । তাঁর মধ্যে ছিল বহুমাত্রিক দর্শন কিন্ত ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল তাঁ জীবন দর্শনের একটি অন্যতম দিক। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন ।

মাহাত্মা গান্ধী নেই কিন্ত তাঁর মানবতা বোধ, অহিংস নীতি এখনও আলো দিয়ে যাচ্ছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর কর্ম-আদর্শ আমাদের বর্তমান এবং আগামীর দিক নির্দেশনা, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাযা কখনও নির্বাপিত হবে না।

আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে ঘোর ধর্মান্ধতার যুগে প্রকাশ্যে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ গ্রহণ করেসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল কিন্ত আজও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরও উচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে আশ্রয় করে এগিয়ে যেতে হবে।

আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাধা করার দায়িত্ব এসে পড়েছে তাঁরই জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার ওপর। নেলসন মান্ডেলা একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন শেখ হাসিনা সম্পর্কে মন্তব্যকরেছিলেন — ”আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখিনি কিন্ত তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সাহস, মেধা, প্রজ্ঞার মধ্যে সেই মহানায়কের পরিচয় পেয়েছি।”

আমরা আশাবাদী শেখ হাসিনার হাতে সফলভাবে মুজিব-আদর্শে এগিয়ে যাবে দেশ । ইতিহাসের প্রবাদ পুরুষ, স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতিজানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।