ঢাকা, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

টোকেনেই চলছে সিএনজি, বছরে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা কাদের পকেটে!

২০২২ আগস্ট ২০ ১৩:২৭:১৭
টোকেনেই চলছে সিএনজি, বছরে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা কাদের পকেটে!

জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম : কর্ণফুলীতে টোকেনেই চলছে সিএনজি ও তিন চাকার নিষিদ্ধ যানবাহন। ফলে, প্রতিনিয়ত সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। জানা যায়, কার্যকর পদক্ষেপের অভাবেই অবাধে চলছে টোকেন বাণিজ্য আর লাখ লাখ টাকার চাঁদা আদায়।

অভিযোগ ওঠেছে, এ বাণিজ্যের সাথে জড়িত রয়েছে ট্রাফিক পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট এলাকার হর্তাকর্তাগণ। রয়েছে কিছু নাম স্বর্বস্ব মালিক সমিতির যোগসাজেস। বেশির ভাগ চালকদের মন্তব্য, এই টাকার একটি অংশ স্থানীয় নেতাদের পকেটেই যাচ্ছে।

যদিও আরাকান মহাসড়কের মইজ্জ্যারটেক মোড় ও শিকলবাহা ক্রসিং গুলোতে মেট্টো ট্রাফিক পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান করলেও টোকেনধারীরা রয়েছে ধরাছোয়ার বাহিরে। কেনোনা নির্দিষ্ট টোকেনের মাধ্যমে সব সড়কেই চলছে অবাধ বিচরণ।

অনুসন্ধান বলছে, সিএনজিতে যাত্রী উঠানামার মুল স্টেশন মইজ্জ্যারটেক। আর এই মইজ্জ্যারটেকেই রয়েছে কিছু সমিতির অস্তিত্ব। রয়েছে মইজ্জ্যারটেক টু কালারপুল লাইন। মইজ্জ্যারটেক টু ব্রিজঘাট এবং মইজ্জ্যারটেক টু আনোয়ারা, বাঁশখালী-বদরখালী লাইন। মইজ্জ্যারটেক মোড়ে মাসিক/ দৈনিক চাঁদা আদায় করেন ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি। এক টোকেনেই আদায় তার ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এই টোকেনেই এক মাসের নিরাপদ যাত্রা। মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার টোকেন। ট্রাফিক পুলিশ জেনেও জানেন না এমন ভাব।

অনুসন্ধানে আরও ওঠে আসে, টোকেন বাণিজ্যের নেতৃত্বে রয়েছে আরো কিছু সংগঠন। তাদের মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম অটো রিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন রেজি নং চট্ট-১৪৪১, কর্ণফুলী থানা অটো রিকশা অটো টেম্পো ও চার ষ্টোক শ্রমিক কল্যাণ বহূমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ (রেজি নং-৮৮৮২), কাঞ্চনা ফুলতলা ডলুব্রীজ অটো রিকশা ও সিএনজি মালিক বহুমূখী সমবায় সমিতি লিঃ (রেজি নং-১০৬১৭), গ্রাম অটো রিকশা অটো টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নং-চট্ট ১৪৪১), ডলুব্রীজ অটো রিকশা সিএনজি মালিক সমবায় সমিতি (রেজি নং ৮০১৫ (১৯৯)), ও অঞ্চল ভিত্তিক কিছু নেতা। তবে নেপথ্যে থেকে কারা এসব সমিতির নেতৃত্বে দিচ্ছেন তাদের ব্যাপারে ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ সাধারণ ড্রাইভারেরা। কারণ সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতা এবং চেয়ারম্যানেরাও এসব বিষয়ে জড়িত।

সিএনজি চালক মোহাম্মদ ফারুক ও হানিফ বলেন, ‘পুলিশ, নেতা ও সাংবাদিক ম্যানেজ করার কথা বলে শ্রমিক সংগঠন গুলো তুলছে এই চাঁদা। মূলত ঘাটে ঘাটে অর্থ লেনদেনের কারণেই মহাসড়কে বন্ধ করা যাচ্ছেনা চাঁদাবাজি ও তিন চাকার যান।

দেখা যায়, মহাসড়কে চলা প্রায় সব সিএনজি অটো রিক্সার সামনের গ্লাসে জল রংয়ের বিশেষ স্টিকার সাঁটানো। যা ২০০ থেকে ৫০০ টাকার বিনিময়ে এই স্টিকার বিক্রি করেন শ্রমিক সংগঠনগুলো। একেক মাসে একেক রংয়ের এসব স্টিকার কোথায় পায় জানতে চাইলে ড্রাইভারেরা বলেন, ট্রাফিক পুলিশেই মূলত এসব স্টিকার সমিতিকে দেন। এই টোকেন থাকা মানে মহাসড়কে চলার বৈধতা। আর কোন বৈধ কাগজপত্র লাগে না তাদের।

ট্রাফিক পুলিশ গাড়ির লাইসেন্স চেক করেন কিনা জানতে চাইলে সিএনজি ড্রাইভার আলমগীর ও মামুন বলেন, ‘সিএনজি চালাচ্ছি ৬ বছর। তবে মহাসড়কে কখনো কাগজ দেখতে চাইনি পুলিশ। তবে প্রতি মাসে মাসে টোকেন আছে কিনা ঠিকেই চেক করেন।’ অন্যদিকে মইজ্জ্যারটেকের সালাম ড্রাইভার বলেন, ‘হাইওয়ে রোডে চলার জন্য টোকেন আছে। এই টোকেন আমরা টাকা দিয়ে প্রতিমাসে নিই। টোকেনের টাকা দেয়া হয় আমাদের সমিতির লোকের কাছে। এরা ট্রাফিক পুলিশ হতে টোকেন এনে তাদের গাড়িতে লাগিয়ে দেয় বলে জানান।’

সিএনজি সমিতির তথ্যমতে, কর্ণফুলীতে ‘চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন’ এর অধীনে ৮শ মতো বেশি সিএনজি ও কর্ণফুলী থানা অটো রিকশা অটো টেম্পো ও চার ষ্টোক শ্রমিক কল্যাণ বহূমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ এর রয়েছে প্রায় দেড় হাজারে উপরে সিএনজি। নিয়মিত হয়তো গাড়ি চলে কয়েক শতাধিক। আর চার স্পটে লাইনম্যান মোঃ জকির, মোহাম্মদ আবু, মোঃ জাহাঙ্গীর প্রতিনিয়ত দৈনিক চাঁদা আদায় করেন। এই সমিতির হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার মতো। মাসে সাড়ে ৪ লাখের উপরে এবং বছরে অর্ধকোটি টাকা শুধু সিএনজি ও অটো রিক্সা থেকেই আদায় করা হচ্ছে। এ টাকা যাচ্ছে কোথায়? এ চাঁদাবাজি রুখবে কে? সেটাই জনগণের প্রশ্ন!

দেখা যায়, পুরাতন ব্রিজঘাটে সিএনজি এসে দাঁড়ালেই ১৫ টাকার রশিদ ধরিয়ে দেন জকির। তাতে লেখা ল্যাইনমান ৫, এক্সিডেন্ট ফান্ড ৩, মৃত্যু ফান্ড ৭ মোট ১৫ টাকা। নিচে সভাপতি-সম্পাদক এর ছাপা স্বাক্ষর। চোখে পড়ার মতো একটি লাইন ও নজর কাড়ে “ধন্যবাদের সহিত গৃহীত হইল”এ যেন রমরমা চাঁদাবাজি"। অপরদিকে মইজ্জ্যারটেক মোড়ে মোঃ ইউসুফ নামে ব্যক্তির কাটা রশিদে দেখা যায়, ল্যাইনমান ৫, এক্সিডেন্ট ফান্ড ৩ ,মৃত্যু ফান্ড ৩, কল্যাণ ফান্ড ৪ মোট ১৫ টাকা।

এছাড়াও আনোয়ারা উপজেলার চাতুরী চৌমুহনী মোড়ে টোকেন এ চাঁদা তুলেন আবু ছালেক ও রাশেদ নামে দুই ব্যক্তি। এরা যে টোকেন দেয় তাতে দেখা যায়, মাসের নাম ও সিরিয়াল লিখা প্রিন্ট করা কাগজ। পাশে কলমে লেখা একেক টোকেনে একেক মুঠোফোন নাম্বার ও ভাই ভাইসহ অনেক সাংকেতিক শব্দ লেখা।

কর্ণফুলী থানা অটো রিকশা অটো টেম্পো ও চার ষ্টোক শ্রমিক কল্যাণ বহূমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ এর সভাপতি মোঃ খোরশেদ আলম বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের সাথে আমাদের কোন লেনদেন বা সম্পর্ক নেই। আমাদের সমিতি থেকে চারজন লাইনম্যান বিভিন্ন পয়েন্টে দৈনিক চাঁদা তুলেন। আমরা কোন থানা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশকে টাকা দেওয়ার প্রশ্নেই আসে না। কারণ আমাদের সমিতির সরকারি রেজিস্ট্রেশন আছে। এছাড়া মইজ্জ্যারটেক মোড়ে যারা সমিতির নামে টাকা তুলেন তারা সব অবৈধ। এরা কমপক্ষে এখানকার ১০০ জনকে মাসিক মাসোহারা দিয়ে চাঁদাবাজি করছেন।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলীর মইজ্জ্যারটেক ট্রাফিক পুলিশ বক্সের ( ট্রাফিক ইনচার্জ) টিআই শেখ ফরহাদ সবৈর্ব অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা কোন টোকেন দেখি না। আমরা দেখি কাগজ। কাগজ ঠিক না থাকলে আমরা জব্দ করি যেকোন যানবাহন। একটু আগেও ১২টি গাড়ি আটক করেছি। আমাদের নামে কারা টাকা তুলে জানিনা। টোকেন দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ কোন বাণিজ্য করে না।’

কর্ণফুলী থানার ওসি মোহাম্মদ দুলাল মাহমুদ জানান, কিছু কিছু সমিতি আছে যারা রশিদ কেটে সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন তা জানি। তাদের আবার সরকারি রেজিস্ট্রেশন রয়েছে বলেও জেনেছি। কিন্তু মাসিক টোকেনে মইজ্জ্যারটেকে কারা চাঁদা আদায় করছেন জানি না। খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী জানান, ‘টোকেন বাণিজ্যের বিষয়ে যাত্রী সাধারণ ও স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে নানা অভিযোগ পাচ্ছি। দ্রুত তা বন্ধে র্কাযকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

(জেজে/এএস/আগস্ট ২০, ২০২২)