ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

পৃথিবীটা কি সত্যই বাসযোগ্য নয়!

২০২২ সেপ্টেম্বর ১০ ১৭:২৮:৫১
পৃথিবীটা কি সত্যই বাসযোগ্য নয়!

চৌধুরী আবদুল হান্নান


কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর “ছাড়পত্র” কবিতায় বলেছেন — “এ বিশ্বকে এ শিশুর জন্য বাসযোগ্যকরে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃড় অঙ্গীকার ।”

আমারা বুঝতে পারি, ক্ষুধা, অনাহার, অন্যায়-অবিচার দেখে দেখে পৃথিবীটাকে তার কাছে বাসযোগ্যমনে হয়নি ।

আশপাশের অনাহার-ক্লিষ্ট মানব সন্তানের মর্মন্তুদ হাহাকার দেখে লিখলেন— “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ।”

পৃথিবীর বৈরী পরিবেশ, প্রতিকূল অবস্হা তাকে বাঁচতে দেয়নি , মাত্র ২১ বছর বয়সে কবি পৃথিবী থেকেবিদায় নিলেন ।

আবার অন্য এক কবি বলেছিলেন—“জন্ম মানেই আজন্ম মৃত্যুদন্ড বয়ে বেড়ানো।”

এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন—“দীর্ঘজীবন মানে দীর্ঘ অভিষাপ।”

মার্কিন কথা সাহিত্যিকে মার্ক টোয়েন মানুষের আচার-ব্যবহারে তিক্ত হয়ে বলেছিলেন—“আমি যতইমানুষ চিনছি ততই কুকুরকে ভালোবাসছি।”

বহু রোমান্টিক কবিতার রচয়িতা বিখ্যাত ইংরেজ কবি থমাস শ্যাটারটন(১৭৫২-১৭৭০) মাত্র ১৭ বছরবয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন এই ভেবে যে—“আমার মতো কোমল হৃদয়ের মানুষের জন্য এই পৃথিবীযোগ্য নয়।”

গত ১৬ আগষ্ট চুরির অপবাদ সইতে না পেরে কাফরুলের এক মন্দিরের সেবায়েত ৬৫ বছর বয়সী পরীক্ষিত দাস মন্দিরের ভেতরেই আত্মহত্যা করলেন । পরিনত বয়সে এসেও জীবনের কঠিন বাস্তবতামোকাবিলা করতে পারে না, জীবন অবসানের মধ্যেই সমাধান খুঁজে । গণমাধ্যমে প্রতিদিন এমনআত্মহত্যার খবর আসে, দেশে বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে ।

নানা অপ্রপ্তি এবং মানসিক চাপ থেকে হতাশা, বিষণ্ণতা তৈরি হয় এবং বিষণ্ণতার তীব্রতা মানুষকেআত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয় । যারা দুর্বল, অধিক আবেগ প্রবণ, তারা জীবনের কঠিন বাস্তবতা সহজে মেনে নিতে পারে না।

জীবন মানে যুদ্ধ , প্রতিনিয়ত যুদ্ধ । যার শক্তি আছে সে জয়ী হয়, বেঁচে থাকে।

বিখ্যাত ইংরেজ জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের গবেষণা থেকে জানা যায় প্রাণী জগতে অনবরত প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়াই করে প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে কীভাবে প্রাণী বেঁচে থাকে, যারা এ প্রতিযোগিতায় হেরে যায়, তাদের ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটে।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে বিগত ২৫০ বছরে পৃথিবী থেকে প্রায় ৫৭১ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং২১৭ প্রজাতির প্রাণী (পশু , পাখি ও সরীসৃপ) বিলুপ্ত হয়েছে।

প্রাণী জগতে মানুষই সবচেয়ে বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণী, প্রতিকূলতার সাথে অভিযোজন ক্ষমতাও তাঁর বেশিঅথচ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায়।

জন্মের পর সন্তান যেমন বাবা-মার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকে, বৃদ্ধ বয়সে তারাই আবার সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়, সৃষ্টির অখন্ডনীয় বিধান ।

সন্তান আপনাকে কি দেবে তা নির্ভর করে আপনি তাকে কি শিক্ষা দিয়েছেন। সে যদি দেখে আপনিআপনার বাবা-মাকে অযত্ন-অবহেলা করেছেন, তা হলে সেও এমন আচরণ আপনাকে ফিরিয়ে দেবে, কর্মফল ।

তরুণ বয়সে অতি আবেগ, ক্ষোভে তাৎক্ষণিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে কিন্ত প্রবীণরা হিসাব নিকাশ করেস্বজনদের উদ্দেশ্যে চিরকুট লিখে ঠান্ডা মাথায় আত্মহত্যা করতে দেখা যায় ।

সকল ধর্মেই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলা হয়েছে কিন্ত আত্মহত্যা থামছে না।

আমার জীবন আমার কিন্ত জীবন শেষ করে দেওয়ার অধিকার ব্যক্তির নেই , আইনেও নেই। অনেক দেশে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে রাষ্ট্রের কাছে স্বেচ্ছা মরণের আবেদন করতে দেখা যায় ।

আত্মহত্যার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে পরামর্শমূলক কথা বলবেন মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসক কিন্ত একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বলি, মানসিক বিষণ্ণতা বা আত্মহত্যা রোধে রাষ্ট্র নয় পরিবারের ভূমিকাই মূখ্য ।

পরিবারের সদস্যদের সহমর্মিতাই রাখতে পারে আত্মহনন প্রতিরোধে বড় ভূমিকা।

বিশিষ্ট মনোশিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা.মোহিত কামাল বলেন — “বিষণ্ণতার শতভাগ চিকিৎসা আছে ।এটিপ্রতিরোধে সামাজিক উদ্যোগ নিতে হবে । চিকিৎসক-কাউন্সিলরের কাছে নেওয়ার উদ্যোগ পাশেরমানুষকেই নিতে হবে।”

জীবন তো একটাই যেখানে আনন্দ-বেদনা দুই-ই আছে ।অপ্রাপ্তির বেদনা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ, ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করলে একদিন আনন্দ-বার্তা আসবেই, যেমন রাতের আঁধার মিলিয়ে যায় দিনের আলোয় ।

প্রকৃতির দিকে তাকালে আমরা কি দেখি ? সৃষ্টির সৌন্দর্য চোখ জুড়ায় ! বাগানে ফুল ফোটে, পাখিরা গানগায়, সূর্য ওঠে, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ধরা আলোকিত হয়, কিছু থেমে নেই। তবে কেন, সময়ের আগেই জীবন থেমে যাবে?

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী বাংক ।