ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

দ্যুতিময় কোহিনূর হীরার অলৌকিকতা!

২০২২ সেপ্টেম্বর ১৮ ১৫:৪৪:৪৩
দ্যুতিময় কোহিনূর হীরার অলৌকিকতা!

চৌধুরী আবদুল হান্নান


ব্রিটেনের সদ্য প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি বিশ্বের লাখো মানুষ শ্রদ্ধা-ভালোবাসবা জানিয়েছেন, পৃথিবীর স্মরণকালের ইতিহাসে একজন রাষ্ট্রনায়ক জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের এমন ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন — এমন নজির নেই ।

রানির নামের সাথে জড়িয়ে আছে আর একটি নাম — বিশ্ববিখ্যাত , মহামূল্যবান এবং ঐতিহ্যের ধারককোহিনূর হীরা।ব্রিটিশরা কোহিনূর হীরা প্রকৃত মালিককে অর্থাৎ ভারতকে ফেরত দিলে তা হবে মহত্বের উদাহরণ। বর্তমানে যুক্তরাজ্য স্বেচ্ছায় ফেরত না দিলে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে কোহিনূর ভারতে আনা সম্ভবনয়। কোহিনূর ভারতকে ফিরিয়ে দেওয়া তাদের লজ্জার বিষয় না ভেবে, তাদের পূর্ব পুরুষের উপনিবেশ গুলোতে যে লুট, শোষণ চালিয়েছে তার কিছুটা প্রতীকী অনুশোচনা প্রকাশ পাবে বলে ভাবা যায় এবং কমনওয়েল্থভূক্ত ৫০ টির অধিক রাষ্ট্রের ২২০ কোটি লোকের ওপর বসবাস , তারাও আত্মপ্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবে ।

ব্রিটিশ শাসিত উপনিবেশগুলোতে তারা কেবল শাসন-শোষণেই করেনি, সভ্যতার আলোও ছড়িয়েছে। শত বছরের কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করে দেশগুলোকে আধুনিক সভ্যতার পথে এগিয়ে দিয়েছে। ব্রিটিশদের সময়-জ্ঞান, বিচার ব্যবস্থাসহ অনেক কিছুই তৎকালীন সময়ে অনুকরণীয় ছিল। সভ্যতা, ভদ্রতা ব্রিটিশরা শিখিয়েছে। স্যরি, থ্যাংক ইউ, এক্সকিউজ মি ভদ্রতা সূচক এ শব্দগুলো তো ব্রিটিশদের কাছ থেকেই পাওয়া।

১৫৪০ সালে শের শাহের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাবর-পুত্র হুমায়ূন রাজ্যহারা হয়েছিলেন কিন্ত কোহিনূর হারাননি। হুমায়ূন অন্যান্য সম্রাটের মতো নিষ্ঠুর ছিলেন না, আবেগ প্রবণ ও মানবিক ছিলেন। বাসর রাতে তিনি তাঁর প্রিয়তমা পত্নী হামিদা বানুকে বিখ্যাত কোহিনূর হীরাটি উপহার দিয়েছিলেন।

শত্রু সৈন্যদের চক্ষু এড়াতে তিনি কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে পারশ্য-সম্রাট শাহ তামাস্প এর আশ্রয়ে আছেন। হুমায়ূনের সম্মানে রাজকীয় ভোজ সভার আয়োজন করা হয়েছে, সম্রাটের ভোজ সভায় উপহার বিনিময়ের রীতি আছে। পারশ্য সম্রাট তাঁর জাকজমক দেখিয়ে হুমায়ূনকে অভিভূত করতে চাইছেন। দীনহীন হুমায়ূনকে বললেন — আপনার তো উপহার দেওয়ার ক্ষমতা নেই, আপনার কাছ তরফ থেকে শুভেচ্ছা পেলেই চলবে। উপস্থিত আমিরদের ঠোঁটে হুমায়ূনের প্রতি বিদ্রুপের হাসি। কিন্ত ঘটনা ঘটলো অন্যরকম, অপ্রত্যাশিত। হুমায়ূন বললেন — আমার পক্ষ থেকে মহামান্য সম্রাটের জন্য সামান্য উপহার, এ উপহার গ্রহণ করলে আমরা আনন্দিত হবো। হুমায়ূন রুমালে ঢাকা কোহিনূর হীরা এগিয়ে দিলেন। সম্রাট রুমাল খুলে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন, কয়েক মুহূর্ত তাঁর মুখে কোনো কথা ফুটলো না। কোহিনূরের ওপর আলো পড়ছে, মনে হচ্ছে সবুজ রেশমি রুমালের মাঝ থেকে দ্যুতি-প্রভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। রাজ সভার পরিবেশ হঠাৎ বদলে গেল।

পারশ্য সম্রাটের বিশাল বাহিনী ব্যবহার করে মোঘল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করে হুমায়ূন ১৫৫৫ সালের ২৫ জুলাই পুনরায় দিল্লীর সিংহাসনে বসেছিলেন। হুমায়ূনের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে কোহিনূর হীরার অলৌকিক প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ হুমায়ূনের নিকট থেকে কোহিনূর হীরা উপহার পাওয়ারপরই পারশ্য সম্রাট তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও বেশ মজার।

দ্বাদশ শতাব্দিতে কোহিনূর হীরাটি কাকাতিয়া রাজ বংশের সময় ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের মাটির নিচেরএকটি খনি থেকে পাওয়া যায়। তারপর যুগে যুগে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে, হীরাটিরও হাত বদল হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে হীরাটি হিন্দু, পার্সি, মোঘল, তুর্কি, আফগান, শিখদের দখলে ছিল এবং বর্তমানে ব্রিটিশদের রাজ পরিবারের অলঙ্কার ভান্ডারে রয়েছে।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ দখল করে নিলে কোহিনূর তাদের দখলে চলে যায়।

ব্রিটিশরা কোহিনূর লুট করেনি, উপহার হিসেবে পেয়েছে — এ সব কথা হাস্যকর। বিজিতদের সম্পদ লুটকরা বিজয়ীদের একটি আনন্দ উৎসব। দীর্ঘদিন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের রক্ত শোষণ করে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। ইংল্যান্ডের একজন বড়রাজনীতিক (এক সময় ভারত সচিব ছিলেন) লর্ড স্যালিসবারি ১৮৭৫ সালে বলেছিলেন —“ভারতবর্ষের রক্ত আমাদের বার করে যখন নিতেই হবে, ছুরিটা এমন সব জায়গায় বেছে ঢোকাও যেখানেঅনেক রক্ত জমে আছে।”

মোঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর ময়ুর সিংহাসনে হীরাটি স্থাপন করেছিলেন। বিখ্যাত ময়ুর সিংহাসন ছিল অমূল্য রত্নরাজি খচিত রাজাসন, ১৭৩৯ সালে পারশ্য সম্রাট নাদির শাহ ময়ুর সিংহাসন কোহিনূরসহলুট করে নিয়ে যায়। ১৭৪৭ সালে নাদির শাহের মৃত্যুর পর এক সময় তাঁর এক উত্তসূরী শাহ সুজা দুররানি কোহিনূর হীরা ১৮১৩ সালে ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন এবং শিখ রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা রনজিত শিং কেহস্তান্তর করেন এই প্রত্যাশায় যে, আফগান রাজ সিংহাসন ফিরে পেতে শিখ রাজা তাদের সহায়তা করবেন ।

কোহিনূর কখনো ক্রয় বিক্রয় হয়নি, কেবল যুদ্ধ আর উপহারের মাধ্যমে হাত বদল হয়েছে। কোহিনূর ভারতের মালিকানায় বিশ্বের এক পুরাণ ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে মানুষের দর্শণীয় বস্তু হতে পারে। কোহিনূর তাঁর আপন ঘরে ফিরে আসা কেবল এই উপমহাদেশের জনগণের বিজয় নয়, বিশ্ব জনীন ন্যায্যতার বিজয়।


লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।