ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাহীন জীবন মুক্তিযুদ্ধের করুণ অপমান

২০২২ সেপ্টেম্বর ২৬ ১৬:৪৭:০৭
মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাহীন জীবন মুক্তিযুদ্ধের করুণ অপমান

আবীর আহাদ


দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্যে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এদেশ স্বাধীন করিনি। অথচ আমাদের ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত স্বাধীন দেশটি আজ দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও স্বেচ্ছাচারীদর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে, আর অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছেন! তাদের অনেকেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। চিকিত্সার অভাবে নানান রোগে ধুকে ধুকে মরছেন। তেমন অবস্থা তাদের সন্তানদের। অর্থের অভাবে তাদেরকে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। যদিও বা কেউ কেউ কায়ক্লেশে কিছু সন্তানের উচ্চশিক্ষা লাভ করাতে পেরেছে কিন্তু তাদের বেশির ভাগই বেকার। মুক্তিযোদ্ধা কোটা যখন ছিলো, বলা চলে তখনো তাদের চাকরি হয়নি, আর এখন তো সেই কোটাটি নেই। বিশাল অর্থই চাকরি প্রাপ্তির একমাত্র কার্যকরি যোগ্যতা! সে-যোগ্যতা তো মুক্তিযোদ্ধাদের নেই!

মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে আছে প্রকৃতপক্ষে তাদের সততা ও দেশপ্রেমের কারণে। একদিন এ দেশটি তাদের কবলে ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা ইচ্ছা করলে কয়েক লক্ষ স্বচ্ছল স্বাধীনতাবিরোধী লোকদের অর্থসম্পদ দখল করে রাতারাতি ধনী হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি বলেই আজ তাদের কপালে দারিদ্র্যের অভিশাপ নেমে এসেছে। অথচ সেই স্বাধীনতাবিরোধী এবং অন্যান্য পেশার লোকজনসহ সুবিধাবাদী রাজনৈতিক টাউটরা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। দেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে।দেশের মাটিতে দুর্নীতিবাজ লুটেরাচক্র রাজকীয় জীবনযাপন করছে!

মুক্তিযোদ্ধারা আজ তাদেরই সৃষ্ট দেশে পরবাসী। তাদের ত্যাগ ও বীরত্বের মর্যাদা নেই। সরকার করুণা করে একটি যৎকিঞ্চিত মাসিক ভাতা দেন, এটিই যেনো তাদের প্রাপ্য ! সর্বোপরি প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কানে বাজে বিভিন্ন সরকারের গোঁজামিলের সংজ্ঞায় তৈরি মুক্তিযোদ্ধাদেরই বীরত্বে ভাগবসানো প্রায় ৬০/৭০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অট্টহাসি। এসবই মুক্তিযুদ্ধের অপমান, স্বাধীনতার অপমান, বাঙালি জাতির অপমান। মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বিসহ জীবন-এটা সভ্যতার অপমান!

বিএনপি জামায়াত জোট সরকার তাদের আদর্শিক পীড়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস, চেতনা ও মর্যাদা বিকৃতি করতেই পারে, যা তারা করেছেও। তারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে গোঁজামিল সংজ্ঞায় হাজার হাজার রাজাকার আলবদর আলশামস ও দলীয় কর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, যা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরাও জাতীয় সংসদের পবিত্র কক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছেন যে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ষাট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে! তারা আজ একনাগাড়ে চোদ্দ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেও সেই সব হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদের তো কোনো ব্যবস্থা করেইনি, উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে তারাও গোঁজামিলের সংজ্ঞা সৃষ্টি করেছে, যে সংজ্ঞার সুযোগে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে ! বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই দেড় লক্ষ হবে না, অথচ আজ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাদের সংখ্যা দু'লক্ষের অনেক ওপরে, যার মধ্যে প্রায় ষাট হাজারই ভুয়া! জামুকা মুক্তিযোদ্ধা বানানোর প্রকল্পটি চলমান রেখে প্রায় প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে চলেছে ! এভাবেই আওয়ামী লীগের হাতেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে!

অপরদিকে বাহাত্তর সালে হয়তো তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংবিধান রচনার সময় সংবিধানের প্রস্তাবনায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা আসেনি, যা সংবিধানের যথাযথ স্থানে তা সন্নিবেশিত করার জন্য আমিসহ আমরা অনেকেই বার বার সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছি। সংবিধান কোনো কোরান নয় যে তাতে কোনো কিছু সংযোজন ও সংশোধন করা যাবে না! অতীতে বহুবার এমনকি ব্যক্তিস্বার্থে সংবিধানে অনেক কিছু সংযোজন সংশোধন ও বিয়োজন করা হয়েছে তাতে যদি সংবিধানের মর্যাদা ক্ষুন্ন না হয়, তাহলে যে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেটি সংবিধানে সংযোজন করতে আওয়ামী লীগেরই তো এগিয়ে আসা উচিত। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা তো তাদের সৃষ্টি; তাদের কৃতিত্ব! অন্যান্য অনেকের মুক্তিযুদ্ধে অবদান নেই, অনেকেই বিরোধিতা করেছিলো বলে তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার গুরুত্ব নেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের নাম শুনলে তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার সৃষ্টি হয়! তাই বলে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তা কেনো কার্পণ্য হবে? তবে কি তারাও মুক্তিযুদ্ধ, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান স্বীকার করার ক্ষেত্রে কোনো হীনমন্যতা ও পরশ্রীকাতরতায় ভোগে? মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি সংবিধানে লিপিবদ্ধ হলে তাদের গুরুত্ব কমে যাবে? গ্রামীণ ৯০% ভাগ চাষাভুষা শ্রমিক ও দরিদ্র শ্রেণী থেকে আগত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা বেড়ে গেলে তাদের মর্যাদা হারিয়ে যাবে? যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া থেকে সরে এসে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র, লুটেরা ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির যোগসাজশে চলতে স্বচ্ছন্দবোধ করছে! এটা অন্যায়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করে তারা আপাত: সুখ ও পরিতৃপ্তি লাভ করলেও ইতিহাসের পাতায় তা কলঙ্কিত অধ্যায় বলে পরিগণিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আজ দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জিত হলেও, মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধারা সমাজ ও রাষ্ট্রে অবজ্ঞা অবহেলা ও অমর্যাদার শিকার! পঞ্চাশ বছরের স্বাধীনতার পাদপীঠে দাঁড়িয়ে যাদের এদেশে হাসার কথা নয়, তারা লুটপাট ও ভোগের আতিশয্যে প্রাণ খুলে হাসছে, আর স্বাধীনতার রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা অপমানে অসম্মানে অবজায় দারিদ্র্যে রোগেশোকে ধুকে ধুকে মরছে! হায় মুক্তিযুদ্ধ ! হায় স্বাধীনতা!

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।