ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

হারিয়ে গেছে বোয়ালমারীর টাবুরে নাও

২০২২ অক্টোবর ৩১ ১৬:২৬:৪৬
হারিয়ে গেছে বোয়ালমারীর টাবুরে নাও

কাজী হাসান ফিরোজ, বোয়ালমারী : ধান, নদী, খালের এই বাংলাদেশ থেকে রাস্তাঘাটের অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফাঁদে পড়ে ইতোমধ্যে ৫২০টি নদী হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে নদী নির্ভর জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বলছে, নদী, নালা, খাল-বিল হারিয়ে যাবার সাথে দেশ থেকে প্রায় একশত প্রজাতির সুস্বাদু দেশি মাছ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বহু জাতের পাখি৷ এখোন আর শীতের আগমনে পরিযায়ী অতিথি পাখি বৈশাখি মেঘের মতো কালো করে আকাশে ভীড় করেনা। আশ্রয় হীনতায় হারিয়ে গেছে সে সব অতিথি পাখি। সেই সাথে হারিয়ে গেছে অনেক পেশাজীবি মানুষ।

আমাদের ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার মাঝ দিয়ে মধুমতি, কুমার নদ ও চন্দনা- বারাসিয়া নদী থেকে বের হয়ে শতশত খাল গ্রামের মধ্য দিয়ে জালের মতো বিস্তার লাভ করেছিলো। যার অধিকাংশ ভূমি খেকোরা খেয়ে ফেলেছে। এই খালগুলো মানুষের রক্তনালির মতোই গ্রামে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের কাজ করতো।

খালগুলো হারিয়ে যাবার সাথে সাথে প্রধান যে পেশাটি হারিয়ে গেছে তাহলো টাবুরে নাও এর নাইয়ে বা মাঝির পেশা। টাবুরে নাও ছিলো সত্তরের দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত গাঁও-গ্রামের প্রধান যাত্রী বাহন। প্রতিটি ইউনিয়নে বিশেষ বিশেষ গ্রাম ছিলো নাইয়ের জন্যে বিখ্যাত। বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা, তেলজুড়ি, কদমি, ভুলবাড়িয়া, ডহর নগর, রুপাপাত, বাবুর বাজার গ্রামে ছিলো বেশ কিছু পেশাদার নাইয়ে। তারা বছরের ছয় মাস কাজ করতো আর বাকি ছয় মাস বাড়িতে অলস সময় কাটাতো। কারণ টাবুরে নৌকায় সে সময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন যাতায়াত করতো। তাঁরা টাবুরে নাওয়ের মাঝিদের বিশেষভাবে সন্তুষ্ট করতো, যা দিয়ে বাকি সময় চলতে অসুবিধা হতোনা। অথবা বাকি সময়টাও তাঁদের বাড়িতে ঘুরে ফিরেই পেট চালিয়ে নিতো।

বর্ষার শুরুতে নতুন বধূদের নায়রে যাবার ধূম পড়ে যেতো। তখোন ব্যস্ত হয়ে পড়তো টাবুরে নাওয়ের নাইয়েরা। এ ব্যস্ততা চলতো অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত। বোয়ালমারী উপজেলার কয়েকজন নাম করা নায়ের মধ্যে ছিলো আব্দুল হামেদ, কালাম মোল্লা, মাহতাব মোল্লা, ছব্দুল, আওয়াল, মঘু মোল্লা, আলাউদ্দীন, আজিজার, আঃ ছামাদ , আঃ ছালাম, ফেলু, মেলাই, মকছেদ সহ আরো বেশ কিছু ব্যক্তি। যাদের মধ্যে এখোন শুধু বেঁচে আছে সেই সময়ের নাইয়েদের মধ্য থেকে ভুলবাড়িয়া গ্রামের মাহতাব মোল্লা (৭৫), কদমি গ্রামের আলাউদ্দিন (৭৫), গুনবহা গ্রামের আঃ ছালাম (৬৭) এবং মকছেদ (৬৬)।

ভুলবাড়িয়া গ্রামের মাহতাব মোল্লা সেই যৌবনেই নাও বাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার নাও বাওয়া ছাড়ার পিছনে আছে এক ভীতিকর করুণ ইতিহাস। একাত্তর সালে সারা বাংলার মতো বোয়ালমারীতেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যুবকদেরকে রাজাকাররা পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিলো। ভুলবাড়িয়া গ্রামের দুই যুবক সুলতান খাঁ এবং ছিরু কাজীকেও তুলে দেয়া হয় পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে। ফরিদপুর আর্মি ক্যাম্প থেকে তাদের দুইজনকেই নিয়ে দাড় করানো হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে। সেখান থেকে তাদেরকে বাঁচিয়ে আনেন শান্তি কমিটির প্রভাবশালী সদস্য বারিক মোক্তার (উকিল)। সুলতান খাঁ এবং ছিরু কাজীকে ফরিদপুর থেকে টাবুরে নাওয়ে করে ফিরিয়ে এনেছিলো মাহতাব মোল্লা। ফরিদপুর থেকে ভুল বাড়িয়া আসার পথে মাহতাব মোল্লা সেদিন পথে পথে দেখেছিলো রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক হত্যা করা নারী পুরুষের শতশত লাশ। বিভৎস দৃশ্য দেখে মাহতাব মোল্লার আত্মা কেঁপে গিয়েছিলো। মাহতাব মোল্লা সেই যে লগি-বৈঠা ছেঁড়েছেন, আর কোনদিন হাতে ছুঁয়ে দেখেননি।

বার্ধক্য জনিত রোগাক্রান্ত গুনবহা গ্রামের আঃ ছালাম বলেন,"প্রথম যৌবনে যখোন টাবুরে নাওয়ে নতুন - পুরাতন বধূদের নিয়ে তাদের নাওরে যেতাম, তখোন মধুমতি, গড়াই নদী আর ইছামতী (মাগুরা ও নড়াইল জেলায় অবস্থিত) বিলের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নাও চালাতাম। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নদীর উত্তাল ঢেউ দেখে চীৎকার করতো। আমরা বদর বদর বলে স্রোতের দোলায় নাগর দোলার মত দুলে দুলে নাও চালাতাম । চন্দনা-বারাসিয়ার তখোন পুরো যৌবন। গুন টেনে ছাড়া চন্দনা-বারাসিয়ায় উজান পাড়ি দেয়া যেতোনা। নদীর ঢেউ ছাড়াও লগি বেয়ে আমন ধানের ক্ষেত পাড়ি দিয়ে সারাদিন শেষে গন্তব্যে পৌঁছতাম। খরস্রোতা নদীর তুলনায় একেবারে কম কষ্ট ছিলোনা ধানের মাঠ পাড়ি দেয়া। ঘন সবুজ সেই যে দেশি জাতের আমন ধানের ক্ষেত আজকাল আর চোখে পড়েনা। নৌকায় বসে খাবার খেতে বসে ভুলে যেতাম পথের ক্লান্তির কথা। নৌকায় বসে খাবারের যে স্বাদ পেতাম এখোন খাবারের সেই স্বাদ আর ঘ্রাণ খুঁজে পাইনা। আমরা যখোন টাবুরে নাও বাইতাম, তখোন ছেলেমেয়েদের মধ্যে বছরে অন্তত একবার স্কুল ছুটির পর মামা বাড়ি যাবার ধূম পড়ে যেতো। শ্বশুর বাড়ি থেকে মেয়েদের বাপের বাড়ি আসার খবরে চারদিকে সাজসাজ রব পড়ে যেতো। নদী বা বাড়ির ঘাটে বাড়ি ও পাড়ার ময়মুরুব্বি ও ছেলেমেয়েরা এসে জড় হতো। এখোন মানুষের মধ্যে সেই আন্তরিকতা নেই। মেয়েরা এখনো বাবার বাড়ি যায়, কিন্তু বাবার বাড়ি যাবার কোন মৌসুম নেই। মন চাইলেন যন্ত্র চালিত যানে চড়ে চলে যায়। জীবনটাও তাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে।"

আঃ ছালাম শেখকে জিজ্ঞেস করলাম, টাবুরে নাওয়ের ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাবার কারণ কী? তিনি বললেন, আগের মতো বর্ষা না হওয়াটা মূল কারণ। জিজ্ঞেস করলাম বর্ষা বা বন্যা হয়না ক্যান? আগের দিনের অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষ হলেও ফারাক্কা বাঁধের খবর তিনি রাখেন। ফারাক্কা বাঁধকে মূল দায়ী করে বলেন, নদী-নালা-খাল শুকিয়ে গেছে। এখোন চাইলেও টাবুরে নাও বাওয়া যেতোনা।

বোয়ালমারী উপজেলার শতাধিক খাল মানুষে দখল করে নেয়ায় সেগুলির মৃত্যু ঘটেছে। হরিহরনগর গ্রামে রাজা সীতারাম রায়ের স্মৃতিবিজড়িত রাজবাড়ির খালটা এখোন ভূমিদস্যুদের জবর দখলে। চন্দনা-বারাসিয়া নদী থেকে সালথা উপজেলায় যাবার চালিনগরের খালটি এখোন নিঃচিহ্ন। হারিয়ে গেছে বাগুয়ানের খাল। গুনবহা পালবাড়ির খালটির উপর এখোন অবৈধ বসতি। চতুল মৃধা বাড়ির খাল, হাসামদিয়া মুন্সি বাড়ির খাল, দূর্গাপুর কুঠিবাড়ির খাল, ভুলবাড়িয়ার খাল, বাইখীরের খাল, সহস্রাইলের খাল সহ তেলজুড়ি, কদমী, সূর্যোগ, ডহর নগর, রুপাপাতের প্রায় শতাধিক খাল পলি ভরাট এবং মানুষের অত্যাচারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই খালগুলো হারিয়ে যাবার পিছনে রাস্তা-ঘাটের অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রধানত দায়ি। নদীগুলো ব্রিজ আর উৎসমুখে পলির কারণে হারিয়েছে নাব্যতা। নদীর নাব্যতা হারানোর কারণে অকেজো হয়ে পড়ায় নদী খেকোরা সুযোগ পেয়েছে সংযোগ খালগুলো খেয়ে ফেলার। খাল-নদী হারিয়ে যাবার কারণে হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী টাবুরে নৌকা।

(কেএফ/এসপি/অক্টোবর ৩১, ২০২২)