ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা

২০২৩ জানুয়ারি ০৯ ১৫:১৮:১৮
মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা

মোহাম্মদ ইলিয়াস


১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে (১০ জানুয়ারি) দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন মুক্তির মহানায়ক। পূর্ণতা পায় মহান স্বাধীনতা। প্রিয়নেতাকে কাছে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা পেয়েছিল। সেদিনই তারা শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তোলার দীপ্তমন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন-‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ হিসাবে। সেই থেকে দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসাবে পালিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি-ত্রিশ লাখ শহিদ ও দুলাখ নির্যাতিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখব।’

বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক কালজয়ী মহাপুরুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরে পায়। মহান নেতার আগমনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের আনন্দ পরিপূর্ণতা লাভ করে।’

জাতির পিতা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য দীর্ঘ ২৪ বছর সংগ্রাম করেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম সব ক্ষেত্রেই তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, সব সময় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দলকে সুসংগঠিত করেছেন।

আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর তার প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ৫১ বছর পূর্তির দিন। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দীর্ঘদিনের সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষার একটি মাত্র লক্ষ্য ও উদ্দশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি একটি নতুন প্রেরণা লাভ করেছিল।

মহানায়কের ফেরা : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত বাঙালি নিধনযজ্ঞের নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন শুরু করে। লাখ লাখ নিরীহ বাঙালির ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা চালায় তারা। এ প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পর পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পরপরই তিনি বাংলাদেশে ছুটে আসতে চান। ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে তেহরান বা অন্য কোনো এয়ারলাইন্স বেছে নিতে বললে তিনি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে আসার সিদ্ধান্ত নেন। লন্ডন পৌঁছে তিনি বিবিসিতে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। তিনি যখন ভরাট কণ্ঠে তার সুস্থতার কথা জানান, ঠিক সেই মুহূর্তটিতে লাখ লাখ বাঙালি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। তখন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ব্রিটিশ বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারাল্ড উইলসনও তাকে স্বাগত জানাতে সাক্ষাৎ করেন। তাকে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা।

লন্ডন থেকে দিল্লিতে পৌঁছান অবিস্মরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র দেশবাসী তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেন। এ সময় তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকার জন্য ভারতবাসী ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এরপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে তিনি পা রাখেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত লাখ লাখ বাঙালি সেই মুহূর্তে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে। পুরো দেশই তাকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত ছিল, তার কিছুটা চিত্র ধরা পড়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে। জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠা বিমানবন্দর যেন বাংলার আকাশ-বাতাসকেই প্রতিনিধিত্ব করছিল। পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ সেই মুহূর্তে অবিস্মরণীয় এই নেতাকে গ্রহণ করতে অংশ নিয়েছিলেন। মহান এই নেতাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ব্যাকুলতা কাজ করছিল। তাকে বহনকারী ট্রাকটিও সে সময় ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের গণহত্যার সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমবেত লাখো মানুষের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জনতার উদ্দেশে দেওয়া প্রথম সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে সবাইকে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালি জাতির এই ভালোবাসার ঋণ শোধ করে যাব।’ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের মাত্র তিন বছর সাত মাসের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কুচক্রী মহলের চক্রান্তে সপরিবারে নিহত হন তিনি। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শোধ করে যান বাঙালি জাতির ঋণ।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট) অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।