ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বুকের মধ্যে সামুদ্রিক কড়ি ঝম ঝম করে বাজে

২০২৩ জানুয়ারি ১২ ১৭:৪৮:০০
বুকের মধ্যে সামুদ্রিক কড়ি ঝম ঝম করে বাজে

পীযূষ সিকদার


আচার্য সেলিম আল দীন-এর কথা মনে পড়লেই সামুদ্রিক কড়ি বুকের মধ্যে ঝম ঝম করে বাজে! বাবাকে দেখিনি। আমার জন্ম পিতাকে মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীরা ধরে নিয়ে যায়। তাঁর লাশও আমরা খুঁজে পাইনি। বাবা হারানো কিযে ব্যথা যার বাবা নেই সেই বোঝে বাবা কী জিনিস! অন্যের রঙিন শার্ট, আমারও তো দরকার কিন্তু মা যোগান দেবে কী করে! অন্যের মা রঙিন কাপড় পড়ে। আমার মার জন্য বরাদ্দ সাদা শাড়ি। অন্যের মায়ের কপালে সিঁদূর। আমার মায়ের কপালে লাল টুকটুকে সিঁদূর নেই! অন্যরা কত সুন্দর জুতা পড়ে। আমার ভাগ্যে রঙিন জুতা ও রঙিন শার্ট জুটেনি! কষ্ট হয় বাবার জন্য! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমাকে যিনি বাবার কষ্ট ভুলিয়েছে তিনি আচার্য সেলিম আল দীন। বাবা ডাকটি যখন মুখে ফুটেছে তখন আমার আরেক জনমের পিতা মহাপ্রয়াণে চলে যান। ভীষণ কষ্ট হয়! এলোমেলো হয়ে যায় আমার জীবন! মনে হতে থাকে কোথাও আমার কেউ নেই! আমি শূণ্য, পাথর! আমি নাই হয়ে যাই। মহা হাহাকার আমার জীবনে জেকে বসে। বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে পথ চলি। আমার জীবনের প্রথম পিতার কথা আমার মনে নেই অথবা মনে করতে পারিনে। দ্বিতীয় জনমের পিতাকে মনে করতে পারি। তাঁর প্রতি আমার অগাধ অভিমান ছিলো। তা তিনি বুঝতেন। আমাকে কাছে ডাকতেন। কাছে রাখতেন। হঠাৎ কেমন করে যেনো পিতা পুত্রের ফাঁরাক হয়ে গেলো! শেষ দেখার দিনে বাবা কলা ভবনের দোতলার রেলিং-এর উপর বসে কী যেনো ভাবছেন! আমার সাথে থাকা মেয়েটিকে দেখে খুশী হতে পারলেন না। বাবাকে প্রণাম করে সোজা ঢাকা। তার কিছুদিন পর স্যার একুশে পদকে ভূষিত হলেন। আমার আনন্দ আর ধরে না! বাবাকে ফোন দিলাম তাঁর আনন্দ আর ধরে না।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিলো। আমার ভাই-বোন, মা সবাই টাকা দিতেন। এমনকি কখনো আচার্য সেলিম আল দীন-এর কাছ থেকে টাকা নিতাম। স্যার বাবা মরা ছেলেটাকে ভীষণ ভালো বাসতেন। কিন্তু স্যার জানতেন না তাঁর অলক্ষ্যে আমি সন্তান হয়ে বসে আছি। আচার্য সেলিম আল দীন আমার গুরু, পিতা, আরো কত অভিধায় কত বিশেষণে বিশেষিত করা যায়। আমি আচার্য সেলিম আল দীনের কাছে বড় একটা প্রশ্রয়ের নাম। তাঁর কাছ থেকে জেনেছি অনেক। বুঝেছি অনেক। দুই হাত ভরে বিদ্যে দিতেন। তার খানিকটা বুঝেছি। এক সমুদ্র জ্ঞানীর কাছ থেকে কতটুকুই আমার মতো হীন শিক্ষার্থী জলস্বরুপ জ্ঞান নিতে পারে। শেষে দেখা গেলো আমি এক অভিমান হয়ে বসে আছি। স্যার বুঝতেন আমার কোন কিছুতেই মনযোগ নেই। স্যারের প্রয়াণে আমি বুঝেছি কী হারালাম! সেলিম বাবার মৃত্যু মুখ আমি দেখেছি। সে মুখে মৃত্যুর ছায়া নেই। দেখেছি শান্তির রেখা।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আমার বাবা থিয়েটার করতেন। আর আমার দ্বিতীয় জনমের বাবা থিয়েটার পড়ান। যেনো দুজন এক অমোঘ সুতোয় বাঁধা। একজন শিল্পদ্রষ্টার নাম আচার্য সেলিম আল দীন। অলক্ষ্যে তাঁর চোখে আমি নিজেকে চিনে নিয়েছি। নিজে নিজে বলতাম আপনার তো কোনো সন্তান নেই দেখেন আমিই আপনার সন্তান হয়ে উঠবো। এখন আমি আচার্য সেলিম আল দীনকে নিয়ে বাঁচি। আমার চোখে বাবা আমার দেবতা। কী সুন্দর নাচতেন! নেচে নেচে আমাদের নাচ দেখিয়ে দিতেন। একজন অসাধারণ শিল্পী¯্রষ্টা। কী সুন্দর গানের কথা ও সুর দিতেন। এসব কথা শোনার কেউ নেই! বলছি এ কারণেই যে আজকে নাট্যকার সেলিম আল দীন-এর প্রয়াণ দিবস। জন্ম ১৮ আগস্ট ১৯৪৯ এবং প্রয়াণ ১৪ জানুয়ারি ২০০৮।

আচার্য সেলিম আল দীন শিল্পের সুধা আজলা ভরে পান করেছেন। মাটির সোঁদা গন্ধ তাঁর সৃষ্টির পরতে পরতে। মা, মাটি, মানুষ তাঁর সৃষ্টির মূলে। এক লেখা থেকে আরেক লেখার দিকে গিয়েছেন শিল্পের অভিন্নতায়। আজ কত কথাইতো মনের তরঙ্গে খেলে যায়। সব কথা বলবার মতো। কী রেখে কী লিখি! সবটা লেখার মতো সাধ্য নেই আমার! কলমের কালি শেষ হয়ে আসে লেখা ফুরায় না!

আমার কোনো কালেই পড়াশোনার প্রতি মনযোগ ছিলো না। পাশ মার্ক পেয়ে পেয়ে এম.এ। বই পড়ার দিকে কোনো দিকে কোনরকম মন নেই আমার। তবে বই ছুঁয়ে দেবার প্রতি আমার অদম্য বাসনা ছিলো। যে টুকু বিদ্যে আমার থলিতে তা আচার্য সেলিম আল দীন-এর কথামালায় আমি বুঝে নিয়েছি। জীবনে আশা ছিলো শিক্ষক হবো। ছোট পরিসরে হলেও সৃষ্টিকর্তা আমার সে ইচ্ছে পূরণ করেছেন। স্কুলে সময় কম দিতে হয় বলে লেখালিখি করে যাই। জানি সরস্বতী দেবী আমার প্রতি কৃপন। তারপরও মা সরস্বতীর কৃপা নিয়ে বাঁচি। জানি লেখালেখি আমার এক স্পর্ধার নাম। স্পর্ধা ভরে লিখে যাই। বাবার লেখার অনুসরণই আমার লেখা তবে অনুকরণ নয়। যাক তবুতো লিখি কম কী!

পিতা, আমি যে লিখছি বুঝতে পারেন। আপনি মৃত্যুর হেইপারে আমি এপার-জীবন পানে। আমি জীবন পানে আছি বলে আমি কি জীবিত! মোটেও না। বহু আগে থেকেই শবদেহটা টেনে বেড়াচ্ছি। স্যার চলে যাবার পর থেকে আমিও শব হয়ে আছি। আহা! আমি যদি জাহাঙ্গীরনগরে একটি মাধবীলতা হয়ে জন্মাতে পারতাম! তাহলে স্যারের পায়ের স্পর্শটুকুর শব্দ শুনতে পেতাম! শুনতে পেতাম বাবার কথার আওয়াজ। হে, ঈশ্বর পরকাল বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে আমাকে মাধবী লতা হয়ে জনম দিও, জাহাঙ্গীরনগরে। বাবা, আমার কথা কি শুনতে পান? শুনতে পাচ্ছেন? এই তো আমি মাধবীলতা তোমার কবর স্পর্শ করি। তখন তুমি আবার কোন জনমে? নাকি জনম বলে কিছু নেই! জনমে জনমে যতটুকু এগিয়ে থাকা যায়। কেউ কেউ এগোয়। আর আমি এগোতেই চাই না। স্যারের কবরের পাশে মাধবীলতা হয়ে জন্মাতে চাই। এই ইচ্ছেটুকু ইচ্ছেরুপ ইচ্ছেয় জন্মাতে পারি মানবরুপ থেকে লতারুপে!

১৪ জানুয়ারি ২০০৮। আচার্যের মহাপ্রয়াণ দিবস। বুকভাঙা কষ্ট হচ্ছে। সংকটে পড়লে কার কাছে যাবো। নেই তো কেউ বলবে-বাবা কেমন আছিস! আছি স্যার। একই রকম থেকে গেলি। পাল্টালি না। আমি হাসি। আজ সে হাসি কান্না হয়ে ফিরে আসে। স্যার আমার জীবনটা এমন হলো কেন? উপর থেকে কথা ভেসে আসে। তুই-্ই এমন জীবন বেছে নিয়েছিস। আমি বলি না স্যার। আচম্বিতে ঘুম ভাঙে আমার। প্রচন্ড শীত। শিউলি তলায় যাই। বাবা আমিও আপনার মতো শিউলি ফুল ভালোবাসি। আর মাধবীলতা? আমি মাধবীলতা হয়ে আপনার কবরের পাশে জন্মাতে চাই। দেখছেন আমাকে। ওই তো মাধবীলতা। দোলে। খাপছাড়া কথা বলতে বলতে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। এ ঘুম যদি শেষ ঘুম হতো!
ইদানিং আমি বড্ড বেশী একা হয়ে গেছি। আগে আমাকে বন্ধু বান্ধব ঘিরে থাকতো। এখন সবাই অনেক দূরে।

হে ঈশ্বর, ফের জনম পেলে সত্যিই আমাকে মাধবীলতা হয়ে জনম দিও। স্যার, বাবা, পিতা, গুরু-আমার কথা কি শুনতে পান। তোমার কবরের পাশে ওই দেখো মাধবীলতা দোলে! ঘুমিয়ে কত কি যে স্বপ্ন দেখি। বুকের মধ্যে ঝনাৎ ঝনাৎ করে সামুদ্রিক কড়ি বাজে। কষ্ট হয়! ১৪ জানুয়ারি ২০০৮। আচার্য সেলিম আল দীন-এর মহাপ্রয়াণ দিবস। মৃত্যুর হেইপারে আমার কথা কি পৌঁছে যায়!

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।