প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত
পৌষ পার্বন উপলক্ষে নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী সীতাতলার মেলা ও গুজিশহর মেলা শুরু
২০২৩ জানুয়ারি ১৫ ১৭:১২:১০
নওগাঁ প্রতিনিধি : পৌষ পার্বন উপলক্ষে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার গুজিশহর গ্রামে শনিবার থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ‘প্রেম গোসাই মেলা’। মাসব্যাপী এই গ্রামীণ মেলাটি স্থানীয়দের কাছে ‘প্রেমতলীর মেলা’ নামেও পরিচিত। মেলাটি বসছে একশ’ বছরের বেশি সময় ধরে। আশপাশের উপজেলা ও জেলার মানুষ আসে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই মেলার অংশী হতে।
মেলায় এসেছেন মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামের মাহফুজ আলম। তিনি বললেন, ‘পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে নিয়ামতপুরের গুজিশহরের এই মেলাটি। এখন গ্রামে-গঞ্জেও আধুনিক সব পণ্যের দোকানপাট গড়ে উঠেছে। তারপরেও কাঠের আসবাবসহ গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে এখনও প্রচুর দর্শনার্থী এই মেলায় আসেন। মাসব্যাপী এই মেলায় প্রতিবারই আসি। প্রথম দিন মেলায় এসেছি কেমন দোকানপাট বসেছে তা দেখতে। পরে আরেকদিন এসে দরকারি জিনিসপত্র কিনবো। আজকে ছেলে-মেয়েদের কিছু মিষ্টি কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরবো।’
অপরদিকে ঘন কুয়াশা ও উত্তরের হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে রবিবার কাকডাকা ভোর থেকে নওগাঁর আত্রাইয়ে শুরু হয়েছে দু’দিন দিনব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সীতা দেবীর স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক ‘সীতাতলার মেলা’। নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার সর্ববৃহৎ এ মেলাকে ঘিরে এখন জামগ্রামসহ আশপাশের গ্রাম গুলোতে চলছে উৎসবের আমেজ।
প্রতিবছর নিয়ামতপুরের গুজিশহর উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন ফাঁকা জায়গায় মূল মেলার আয়োজন করা হয়। তবে মেলাটি শুধু মেলা প্রাঙ্গণেই সীমিত থাকেনি। আমন ধান কেটে নেয়ার পর ফাঁকা পড়ে থাকা কৃষি জমির মাঠেও বসেছে মেলার বিভিন্ন দোকানপাট। চিত্তবিনোদনের জন্য বসানো হয়েছে সার্কেসের প্যান্ডেল। এছাড়া শিশু-কিশোরদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য একাধিক নাগরদোলা ও বিভিন্ন রাইড বসানো হয়েছে।
এই দুটি মেলাকে ঘিরে জামায়- মেয়েসহ আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ রয়েছে স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে বহুদিনের। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় বাহারি রকমের পিঠা, পায়েস, পুলি। মেলা থেকে মিষ্টি কিনে এনে জামাই-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়ানোর রেওয়াজও ধরে রেখেছে এলাকাবাসী।
গুজিশহর গ্রামের বাসিন্দা জুলেখা বিবি (৭০) বলেন, ‘হামাগের জন্মের পর থ্যাকে এই মেলা দেখে আসোছি। হামাগের বাপ-দাদারাও কতে পারেনি কবে থেকে এই মেলা শুরু হছে। আগে এই মেলায় মাটির তৈরি বাসন-কোসন পাওয়া য্যাত। এখনও মাটির তৈরি বাসন-কোসন লিয়ে কিছু কিছু দোকান বসে, কিন্তু আগের মতো লয়। মাটির হাড়ি-পাতিল ঝোলানোর জন্য পাটের তৈরি শিকি পওয়া য্যাত আগে। সেই শিকি এ্যাকন আর পাওয়া যায় না।’
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা মহেন্দ্রনাথ বর্মণ বলেন, ‘গুজিশহর উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে একটি শতবর্ষী বট গাছ আছে। শত বছর আগে সেই গাছের তলায় একজন ঠাকুর বসতেন। তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর কাছে মানুষজন এসে কোনো প্রার্থণা করলে তাঁদের সেই প্রার্থনা পূর্ণ হতো। এখনও মানুষের মাঝে এই বিশ্বাস রয়েছে, ঠাকুর যে গাছের নিচে বসতেন সেই গাছের কাছে গিয়ে কেউ কোনো কিছু প্রার্থনা করলে তাঁর সেই মনোবাসনা পূর্ণ হবে।’
মেলাটির আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ও গুজিশহর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিনে এই মেলাটি বসে। চলে এক মাস ধরে। এ জন্য আগাম কোনে ঘোষণা দেওয়া হয় না। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে একই দিনে মেলাটি বসছে। দূর-দূরান্তের মানুষ এখনো আসে মেলায় যোগ দিতে। সে কারণে সব রকমের সুবিধা রাখতে আয়োজক কমিটি প্রায় এক মাস আগে থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এবারও সে রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মেলার নিরাপত্তার জন্য সারা দিন পুলিশ মোতায়েন থাকবে।
আত্রাই উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নিভৃত পল্লী জামগ্রাম। আত্রাইয়ের আহসানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন পার হয়ে ভোঁপাড়া তিলাবদুরী হয়ে মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, ইজিবাইক, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে যাওয়া সম্ভব। এই জামগ্রামেই সেই যুগ যুগ থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সীতাতলার মেলা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও রবিবার থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী সীতাতলার মেলা।
কথিত আছে, শত শত বছর পূর্বে শ্রী রামচন্দ্র তার স্ত্রী সীতা দেবীকে নওগাঁর এই আত্রাই উপজেলার গহীন বন জামগ্রামে বনবাস দিয়েছিলেন। আর সীতা বনবাসের এক পর্যায় জামগ্রামের এ বনে একটি প্রকান্ড বটগাছের নিচে আশ্রয় নেন এবং জীবনের বাঁকি সময় এই বট গাছটির নিচেই তিনি কাটিয়ে দেন। গাছটির পার্শে রয়েছে এক বিরাট ই›ঁদারা। সীতা এই ই›ঁদারার পানিতেই স্নান করতেন। বিশ্বকর্মা এক রাতেই নাকি নির্মাণ করেছিলেন এই ইঁদারাটি। সেই রেশ ধরেই সীতা রাণীর নামেই মেলার নামকরন করা হয়েছে ‘সীতাতলার মেলা’। কথিত আছে বনবাসে থাকাকালী সীতাদেবী খোনকার প্রকান্ড এই বট গাছের ডাল ধরে কায় রাম, হায় রাম বলে কেঁদেছেন। গাছটির অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান।
শত বছরের ঐতিহ্যবাহী সীতাতলার মেলা জমজমাট ভাবে প্রতি বছর হয়ে আসছে। শুরুর দিকে এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের মেলা থাকলেও বর্তমানে আর তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন এ মেলা হিন্দু, মুসলিম সকলের এক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। মেলাকে ঘিরে নওগাঁসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয় এই মেলায়। মূল মেলা তিনদিন হলেও মেলার আগেও পরে কয়েকদিন ব্যাপী চলে মেলার বেচা-কেনা। মেলাকে ঘিরে উপজেলার জামগ্রামসহ পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে এখন সাজসাজ রব পড়ে গেছে। মেলা উপলক্ষে যেন আশপাশের গ্রামগুলোতে উৎসবের ধুম পড়েছে। দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনে ভরে গেছে প্রায় প্রতিটি বাড়ি। প্রতি বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের মিঠাই মিষ্টান্ন পিঠা ও ভালো খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মেলাকে ঘিরে আশপাশের গ্রামে জামাই আদর রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ঘরে ঘরে শীতের রস-পাটালির নানান পিঠা-পায়েস তৈরির ধুম। ঈদে না হলেও অন্তত এই মেলা উপলক্ষে জামাই-মেয়েকে দাওয়াত দেওয়া এ এলাকার রেওয়াজ। জামাই মেলা থেকে বড় মাছ-মিষ্টি নিয়ে শশুরালয়ে যান। আর শশুর জামাইকেও উপহার দিয়ে থাকেন। তাই জামগ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে এখন জামাই, মেয়ে বিয়াই, বিয়ানসহ আতœীয় স্বজনের পদচারণায় মুখরিত।
সীতারাণীর স্মৃতি বিজড়িত সীতাতলার মেলাকে ঘিরে আইন শৃংঙ্খলার কথা জানালেন আত্রাই থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. তারেকুর রহমান সরকার, বলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সীতারাণীর স্মৃতি বিজড়িত সীতাতলার এই মেলাটির ঐতিহ্য রক্ষার জন্য গ্রামবাসী প্রতি বছর এই মেলার আয়োজন করে থাকে। এ মেলাকে ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। আনন্দঘন পরিবেশে মেলাই আসা লোকজনের নিরাপত্তার জন্য সেচ্ছাসেবক, গ্রাম পুলিশ ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আশাকরছি প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মেলাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না।
(বিএস/এসপি/জানুয়ারি ১৫, ২০২৩)
