ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

পদোন্নতিতে তদবির ঠেকানো যাবে না, নীতিমালা বদলাতে হবে 

২০২৩ জানুয়ারি ১৬ ১৫:২০:০২
পদোন্নতিতে তদবির ঠেকানো যাবে না, নীতিমালা বদলাতে হবে 

চৌধুরী আবদুল হান্নান


সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রার্থীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করলে তা হবে অসদাচরণের শামিল এবং সেক্ষেত্রে প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক নির্দেশনায়।

রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে দেওয়া চিঠিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

তদবির ছাড়া পদোন্নতি হয় না, এমন বিশ্বাস ব্যাংকারদের মনে এখন বদ্ধমূল হয়ে আছে আর যেখানে মেধা, যোগ্যতার মাপ কাঠিতে স্বাভাবিক পন্থায় পদোন্নতি হয় না, সেখানে ক্ষমতার প্রভাব খাটানোর প্রবণতা না থেকেই পারে না।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আসা তদবিরই সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর, কারণ ব্যাংক ব্যবস্থা ওই মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন।

বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সাম্প্রতিক সময় এ ধরনের তদবির ও প্রভাব খাটানোর প্রবণতা অসহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় মন্ত্রণালয় থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়া হলো। এ নির্দেশনার ফলে অর্থ মন্ত্রণালয় কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারে বটে কিন্ত পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় মেধা ও যোগ্যতা যাচাইয়ের নিশ্চয়তা দেয় না।

তদবির আর দুর্নীতির কারণে পদোন্নতি প্রক্রিয়া সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ থাকে এবং এভাবেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হয়ে আসছে।

ফলে অসৎ ও অযোগ্য কর্মকর্তাদের বিজয় হচ্ছে, একচেটিয়া দৌরাত্ম্য বাড়ছে, মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পিছনের সারিতে। তদবির বা টেলিফোনটা ক্ষমতার এমন কেন্দ্র থেকে আসে যে, একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওই অনৈতিক সুপারিশটি নানা কারণে প্রত্যাখান করার সৎ সাহস দেখাতে পারেন না।

পদোন্নতিতে যোগ্য, দক্ষ, সৎ কর্মকর্তাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করার ফলে ব্যাংকগুলোর আজকের এ দুরবস্থা, এটা বলাই যায়। তাদের সুরক্ষা দেওয়া হলে ব্যাংক ব্যবস্থা সুশাসনের দিকে অগ্রসর হবে, সন্দেহ নেই।সদিচ্ছা থাকলে এ সকল কর্মকর্তাকে মূল্যায়ন করার সুযোগ রয়েছে।

কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বিবেচনার জন্য একটি ক্রাইটেরিয়া রয়েছে। সিনিয়রিটি, বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত যোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর সুনির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্ধ থাকে যেখানে স্বজনপ্রীতি বা বৈষম্য করার কোনো সুযোগ নেই।

প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বিবেচনার জন্য একটি মেধা তালিকা তৈরি করা হয়। তবে পদোন্নতির জন্য গঠিত কমিটির হাতে কিছু নম্বর রিজার্ভ রাখা হয় যা কমিটির সদস্যগণ ন্যায় বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থেকে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে দেওয়ার সুযোগ থাকে। বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপকে সুবিধা দেওয়ার জন্যও এ নীতিমালা মাঝে মাঝে পরিবর্তন করতে দেখা যায়। যাদের প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা আছে তারাই পদোন্নতির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে।

কমিটির হাতে থাকা নম্বরই যত অনাসৃষ্টির মূল এবং এখানেই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির আসল উৎস। একজনকে বাড়তি সুবিধা দিতে হলে তো অন্য একজনকে বঞ্চিত করতেই হবে। এভাবে কমিটির হাতেমুখ চিনে নম্বর দেওয়ার সুযোগ থাকায় এক পর্যায়ে একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে এক পর্যায়ে জুনিয়র কর্মকর্তার অধীনে কাজ করতে হয়। চাকুরি জীবনে এমন অবস্থার থেকে বিভীষিকাময় কর্ম জীবন আর কিছু হতে পারে না।এমনও হয়েছে যে, কেবল একজন ব্যক্তিকে পদোন্নতির আওতায় আনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পদোন্নতির নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে।

ব্যাংক পাড়ায় এটাকে “আবদুর রহিম ক্রাইটেরিয়া” বলে রসিকতা চালু আছে। কমিটির হাতে কোনো নম্বর না রেখে বিভিন্ন বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে তৈরি করা মেধা তালিকা থেকে ক্রমান্বয়ে পদ শূণ্য হওয়া সাপেক্ষে পদোন্নতি দিলে তদবির আর প্রভাব খাটানোর সুযোগ থাকবে না। মেধা তালিকাটি গোপনীয় থাকবে না, প্রার্থীদের নিজ নিজ অবস্থান জানার সুযোগ রাখা যেতে পারে। এতে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা থাকবে এবং প্রত্যেক কর্মকর্তা জানতে পারবে তার পদোন্নতির সম্ভাব্য দিন ক্ষণ। এ ব্যবস্থায় পদোন্নতিতে কেবল প্রভাব খাটানোই বন্ধ হবে না, বন্ধ হবে তদবির বানিজ্যও।

লেখক : অপসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।