ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

জ্ঞানপাপীরা পকেট ভরে দেশীয় শিক্ষা রসাতলে

২০২৩ জানুয়ারি ২০ ১৫:১৪:২৬
জ্ঞানপাপীরা পকেট ভরে দেশীয় শিক্ষা রসাতলে

মীর আব্দুল আলীম


ভুল দিয়ে শুরু; একেই বলে ‘গোড়ায় গলদ’। আমাদেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে যে বই তুলে দেয়া হয়েছে তাতে ভুলে ভরা। যখন শিক্ষার্থীরা শিখবে, তখন তাদের ভুল শিখানো হচ্ছে। বই গুলো ভুলে ভরা।লেখক সিলেকশনে হয়তো ভুল আছে। ওস বইয়ে যারা লিখেন তারা হয়তো লিখতে তদবীরে এসেছেন। তদবিরবাজরাতো গোটা বাংলাদেশটাই স্থবির হয়ে আছে।যে বই থেকে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা শিখবে সে পাঠ্যবইয়ে এতো ভুলে? কি শিখবে ওরা? এমন বইয়ের কি দরকার?প্রতি বছরই এই একই অভিযোগ- “ভুলে ভরা বই”। যারা বারবার ভুল করে ওসব জ্ঞানপাপিরা এ জায়গায় স্থান পায় কি করে?ষ্পষ্ট যে, এসব জ্ঞানপাপী; পকেট ভরতে দেশীয় শিক্ষাকে রসাতলে নিচ্ছে। সময় পেলেই ওরা বুদ্ধিটাকে বেচে। ভাবি ক’টা টাকার জন্য ওরা শিক্ষাটাকে কিভাবে নষ্ট করছে?

২০২৩ সালের অনেক শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ভুল আর ভুলে ভরা। ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি প্রথম পত্র বইয়ের কিছু সাধারণ ভুল দেখে রীতিমতো গতবাগ গতে হয়। প্রশ্ন উঠছে বইয়ের মান নিয়েও। বইয়ের কাগজ, সম্পাদনা আর ছাপার মান খুই খারাপ। ভুল তথ্য, ইতিহাস বিকৃতি, অন্যের লেখা চুরি, মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে অধিক গুরুত্ব দেয়া, বিতর্কিত তত্ত্ব, ইসলামবিরোধী ছবি, লেখা দিয়েই প্রকাশ করা হয়েছে নতুন বই। দেশের পাঠ্যপুস্তক এমন বেহাল হলে কি করে চলবে?

শিক্ষার অপরিহার্য উপকরণ বই। সরকার স্কুল পর্যায়ে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। সরকার যে এ কাজটা ভালো করছে তা বলতেই হয়।দেশে ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি যথাসময়ে বই দেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকার সফল দেখিয়েছে। বই ভুলে ভরা কেন? ২০২৩ সালে ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ৬৬ লাখের বেশি এবং মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বই দেওয়া হচ্ছে। শুরু থেকেই বই নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। বই যেহেতুক ভুলে ভরা থাকে সেহেতু যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বই লেখেন না এটাই থারনা কওে নেয়া যায়। আমরা জানি, শত শত কোটি টাকা খরচ করে অধিক পারিশ্রমিকে বড় বড় পন্ডিত, শিক্ষাবিদ দিয়ে বই লেখানো বা প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব কোন কাজেই এলো না। নিচের শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য যে বইটা বিতরণ করা হলো তাতে এতো ভুল! এসব বই থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে?ঐসব পন্ডিতদেও এখন আমরা কি বলব?

এখানে পত্রিকান্তে প্রাপ্ত বইয়ে প্রকাশিত কিছু ভুলে কথা তুলে ধরতে হয়। ষষ্ঠ শ্রেণির ২০২৩ সালের ইংরেজি বই ঘেটে এসব ভুল পাওয়া গেছে। ভুল উল্লেখ করা হলো: বইয়ের ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায়agesz লেখা, কিন্তু এটির শুদ্ধ বানান ages হবে এবং ১১ নম্বর পৃষ্ঠায়hingsলেখা, কিন্তু এটিThingsহবে। বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় ‘প্রাত্যাহিক’ লেখা, কিন্তু সঠিক বানান হবে ‘প্রাত্যহিক’। বইয়ের ৬৯ পৃষ্ঠায়modal verbলেখা, কিন্তু সঠিক হবেmodal verbs। বইয়ের ৪৪ পৃষ্ঠায়hand upলেখা, কিন্তু সঠিক হবেhands up। বইয়ের ৮২ পৃষ্ঠায়conversionলেখা, কিন্তু সঠিক বানান হবেconversation। বইয়ের ৮৪ পৃষ্ঠায়youngerলেখা, কিন্তু সঠিক হবেyoungers। বইয়ের ৮৫ পৃষ্ঠায় ঈ, উ প্রশ্নের মধ্যে কোনো শব্দের নিচে আন্ডারলাইন করা হয়নি। বইয়ের ১০৪ পৃষ্ঠায় ‘পরে’ লেখা হয়েছে, কিন্তু সঠিক হবে ‘পড়ে’। বইয়ের ১২৬ পৃষ্ঠায় লেখা ‘সব বন্ধুদের’, কিন্তু হবে ‘সব বন্ধুকে’ বা ‘বন্ধুদের’। বইয়ের ১৪৯ পৃষ্ঠায় ‘খুজে’ লেখা, কিন্তু সঠিক বানান হবে ‘খুঁজে’। বইয়ের ১৬৫ পৃষ্ঠায় ‘কৃত্তিমভাবে’ লেখা, কিন্তু সঠিক হবে ‘কৃত্রিমভাবে’। বইয়ের ১৪৯ পৃষ্ঠায়Four friend'sলেখা, কিন্তু শুদ্ধ হবেFour friends। বইয়ের শেষ কভার পেজের নিচেGovernment of the peoples' Republicলেখা, কিন্তু শুদ্ধ হবেGovernment of the people's Republic। পাঠ্য বইয়ে এতো ভুল থাকে কি করে?

চলতি বছর প্রকাশিত নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ১৮১ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি বড় ভুল ধরা পড়েছে। এখানে বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে। অথচ এখানে হবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে। ঐ বইয়ের ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে— ১২ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মাদ সায়েমের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অথচ বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়ান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এছাড়া বইটির ২০২ নম্বর পৃষ্ঠায় সংবিধান প্রণয়ন ও পটভূমিতেও অনেক তথ্য বাদ দেওয়া হয়েছে।নবম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ে ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় -ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ‘ক্যাম্প’ ও পিলখানা ইপিআর ‘ক্যাম্প’ ছাপা হয়েছে।

অথচ এখানে হবে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর। একই বইয়ের ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ৫৪ সালের নির্বাচনে চারটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো ৫৪ সালের নির্বাচনে পাঁচটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। একই বইয়ের ২৮ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো, সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার অধিকার সংরক্ষণ এ সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য।নবম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ের ৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কাজ অংশের ১ নম্বর অনুচ্ছেদেও প্রকৃত তথ্য বাদ দেওয়া হয়েছে। একই বইয়ের ৫৯ পৃষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কাজের বিষয়েও অসঙ্গতি তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. কায়কোবাদ পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য ও ভুল ইতিহাস লেখার বিষয়ে তার মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন- কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আমরা ভুল শিখাব এটা ভাবতেই পারি না। এই ভুল তথ্যের জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়, এনসিটিবি, পা-ুলিপি লেখকদের কেউই দায় এড়াতে পারবেন না। আর এতে প্রমাণ হয় আমরা যোগ্য লোককে সঠিক দায়িত্ব দিতে পারছি না। যার কারণেই শিক্ষা সেক্টরের আজ এই অবস্থা। আগামীতে যোগ্য লোকদের দিয়ে পাঠ্যবইয়ের পা-ুলিপি দেখার দায়িত্ব দেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।

পত্রিকায় একটি বিষয় নিয়ে খুব লেখালেখি হচ্ছে তা হলো ষষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ডারউইনের তত্ত্ব শেখানো নিয়ে। ফারুক হোসাইনের একটি লেখার উদৃতি দিতে হচ্ছে এখানে। তিনি এবারের বইয়ে ভুলের বিষয়টি সুন্দরভাবে তার লেখায় তুলে এনেছেন। ইসলামবিরোধী এই তত্ত্ব ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী বইয়ের ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে বানর ছিল, আর সেখান থেকেই কালের বিবর্তনে ধাপে ধাপে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। বইয়ের ১১৪ নং পৃষ্ঠায় শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘খুঁজে দেখি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস’ ঠিক তার পরের পৃষ্ঠায় অর্থাৎ ১১৫ পৃষ্ঠায় ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শিরোনাম দিয়ে চারটি ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে মূলত বানর ছিল। আর তার পরেই কয়েকটি ধাপে বানর থেকেই মানুষের আকৃতি রূপান্তরিত হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে যে অধ্যায় লেখা হয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে বানর থেকেই মানুষের জন্ম। এই তত্ত্বের কোনো ইসলামিক ব্যাখ্যা বা সত্যতা নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। তারা বলেন, ইসলাম প্রধান দেশে এমন একটি বিতর্কিত বিষয়ে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে এটা মেনে নেয়ার মতো নয়। বিক্ষুব্ধ অভিভাবকরা দাবি করেন আগামী শিক্ষাবর্ষ নয় বরং চলতি বছরেই অবিলম্বে এই বিতর্কিত বিষয় পাঠ্য বই থেকে বাতিল করতে হবে।

পাঠ্য বইগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাদরসার জন্য ছাপানো বইগুলোতে এদেশের মুসলমানদের তাহজীব-তামাদ্দুন, কৃষ্টি-কালচার বিশেষ করে মাদরাসা শিক্ষার উপযোগী নয়। মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা এ নয়টি বিষয়ের কোথাও কোরআন সুন্নাহ, মুসলিম মনীষী, বিজ্ঞানী, গবেষকদের কোনো বাণী বা জীবনী থেকে কিছুই নেয়া হয়নি। বরং ৯১ শতাংশ মুসলমানের দেশে বিবর্তনবাদ, প্রাচীন সভ্যতার নামে মূর্তি, হিজাববিহীন মেয়েদের ছবি, গান-বাজনা, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, খেলাধুলা, মোবাইল ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নামে নগ্ন অশ্লীল ছবি, কুকুরের ছবি, সভ্যতার নামে উলঙ্গ ও অর্ধউলঙ্গ মূর্তির ছবি ব্যাপবভাবে স্থান পেয়েছে। দেড় হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্য, নীতি-নৈতিকতা, কবি সাহিত্যিকগণের অবদানের কোনো বিষয় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আলোচনা খুবই কম। বইগুলোতে তিনশতাধিক মেয়ের ছবি পর্দাবিহীনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ (মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি), পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনায় এমনসব বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে যা কোরআন সুন্নাহ ও মুসলামানদের আকীদা বিশ্বাসের পরিপন্থি। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বর্ণনায় দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি, মৃত্যু ও পরকালের দেবতা ‘আনুবিষ’, সূর্য দেবতা ‘রা’, স্বর্গীয় মাতা ‘আইসিস’, কৃষি দেবতা ‘ওসাইরিস’, যুদ্ধ দেবতা ইত্যাদি দেবতার বর্ণনা দিয়ে পৌত্তলিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েদের উলঙ্গ ছবি, হিন্দুদের মন্দিরের ছবি দেয়া হয়েছে।

পাঠ্য বইয়ে নকল লেখা। পন্ডিতরা চুরি করে অন্যের লেখা হুবহু ছেপে দিয়েছেন। অন্যের লেখা চুরি, বিতর্কিত বিষয় উপস্থাপন, ভুলতথ্য,অসঙ্গতি, নীতি-নৈতিকতাহীন বিষয় প্রকাশ,মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে অধিক গুরুত্ব দেয়া, ইচ্ছকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃতি, ইসলামবিরোধী ছবি, লেখা দিয়েই প্রকাশ করা হয়েছে নতুন বই। নতুন বইয়ে বিতর্কিত ছবি ও লেখা, ভুল তথ্য পৌঁছে দেয়া হয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। ভুলের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীসহ এনসিটিবির কর্তারা বলছেন আগামী বছর সংশোধন করা হবে বলে জানিয়েনে। যা আমরা পত্রিকায় দেখেছি। রাষ্ট্রের শত শত কোটি কোটি টাকা খরচ সে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা ভুল শিখবে এর দায় কে নেবে?

ইংরেজি বইয়ে ইউরোপীয় কুকুর সংস্কৃতিরই অংশ হিসাবে একই বইয়ে ১২টি কুকুর ও ১৪টি নেকড়ে বাঘের ছবি দেয়া হয়েছে। কোন কোন বইয়ে যে সব মানুষের নাম ব্যবহৃত হয়েছে একটি মুসলিম দেশে সত্যিই আপত্তিকর। যেমন: অনিকা, মিনা, লিটল র্যাড, প্লাবন, রতন, মেধা, দীপক, স্কট, রুপা, নন্দিনী, এস্তি, মিসেল, মিতা, রন, শেলী, নিনা, জয়া, সুবর্ণা, রায়, মনিকা চাকমা, রিনা গোমেজ, রাতুল, রমা, রবিন, শিশির, ডেবিড, প্রিয়াঙ্কা, অরবিন্দু চাকমা, মন্দিরা, শিশু, মিলি, সুনীল, মিনু চিনুক ইত্যাদি। ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশের আত্মসামাজিক অবস্থা উপস্থাপন না করে মেসোপটেমিয় সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা ও হরপপা সভ্যতা ইত্যাদি বিষয় যা অনার্স বা ডিগ্রি শ্রেণিতে পড়ানো হয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

এসময় প্রথম শ্রেণির বাংলা বইতে লেখা আছে “ছাগল গাছে উঠে আম খাচ্ছে”–এই লেখা ও ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একজন মন্তব্য করেছেন, এতে কী আর এমন ভুল লেখা আছে? কারণ আমরাতো জানিই “ছাগলে কিনা খায়?” তাই এখানে দেখানো হচ্ছে ছাগল গাছে উঠে আম খাচ্ছে। ছাগলতো ঘাস লতাপাতা এসবই খায়, আর সুযোগ পেলেই ছাগল ছোট ছোট ফুল গাছ বা সবজি বাগানে ঢুকে পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। তবে ছাগল ঠিক এভাবে বানরের কায়দায় গাছের মগডালে বসে আম খায় কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ২০০ পৃষ্ঠায় একটি অংশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থার ধরন কী হবে, এই সম্পর্কে তখনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিনই ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভায় দীর্ঘ আলোচনার পর “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ” জারির মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই দিনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।’

এমন ভুল নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষে বিনা মূল্যের বই। শুধু এই বইয়েই নয়, আরও একাধিক বইয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য আছে। অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে বই হাতে পেয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণয়ন করা বইগুলোর মধ্যে কোনো বইয়ে এখনো ভুলভ্রান্তি রয়ে গেছে। যেমন নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যাবিষয়ক অংশে প্রথম লাইনে বলা হয়েছে, ‘২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল।’ প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাত থেকেই নিরীহ বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। যদিও আরেকটি বাক্যে ২৫ মার্চের রাতে অত্যাচারের কথা বলা আছে, কিন্তু প্রথম লাইনটি যেভাবে দেওয়া হয়েছে, তাতে বিভ্রান্তির অবকাশ রয়েছে।

ছাপাখানায় কি ভুত থাকে? তাহলে এতো ভুল আসে কোথ্থেকে? বরাবরই দেখেছি আমাদেও ছাপাখানাকিছু কিছু ভুলকে নিয়েই চলে। আমদেও কথিত বিজ্ঞজনরা যতই এডিটিং ও প্রুফরিডিং করিনা কেন, এইরকম কিছু ভুল থেকেই যায়, আর ছাপা হওয়ার পর তা দেশবাসীর চোখে পড়ে। তা নিয়ে হৈ চৈ হয়। এবার যেভাবে ভুল ছাপা হয়েছে তা কি ছাপাখানার ভুল? নাকি এটা আমাদের বই প্রণেতাদের অজ্ঞতা? এইসব ভুল বারবার হতে দেখে পাঠ্যবই প্রণেতাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। উঠতেই পারে। বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে, আর তারা ভুলে ভরা পাঠ্যবই শিশুদের হাতে তুলে দিবে তা কি করে হয়। এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না। এ বিষয়টি নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের অনেক বেশি ভাবতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

hings